লগইন করুন
ঈদের দিনে আনন্দ ও খুশীর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো দ্বীনের অন্যতম প্রতীক। এ দিনে পরিবার-পরিজনের প্রতি বিভিন্ন প্রকার খরচ ও প্রশস্ততা প্রদর্শন করা উচিত, যাতে তাদের মন-প্রাণ আনন্দিত হয় এবং ইবাদতের কষ্ট থেকে দেহ সবস্তি, বিরতি ও প্রশান্তি লাভ করতে পারে।[1]
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ঈদের দিন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমার নিকট এলেন। সেই সময় আমার কাছে দুটি কিশোরী ‘দুফ’ ([2]) বাজিয়ে বুআষ (যুদ্ধের বীরত্বের) গীত গাচ্ছিল। অবশ্য তারা গায়িকা ছিল না। তা দেখে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নিজ চেহারা ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর তিনি কাপড় ঢাকা দিয়ে বিছানায় শুয়ে গেলেন। ইত্যবসরে আবূ বাক্র (রাঃ) প্রবেশ করলেন এবং আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘শয়তানের সুর আল্লাহর রসূলের কাছে?’
(এ কথা শুনে) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নিজ চেহারা খুলে আবূ বাক্রের দিকে ঘুরে বললেন, ‘‘ওদেরকে ছেড়ে দাও, হে আবূ বাক্র। আজ তো ঈদের দিন। প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে। আর আজ হল আমাদের ঈদ।’’ অতঃপর তিনি একটু অন্যমনস্ক হলে আমি তাদেরকে চলে যেতে ইঙ্গিত করলাম। তখন তারা বেরিয়ে গেল।
মা আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন, হাবশীগণ ঈদের দিন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর মসজিদে যুদ্ধাস্ত্র (বর্শা) নিয়ে খেলা করত। কখনো বা আমি তাঁর কাছে ঐ খেলা দেখতে চাইতাম, আর কখনো বা তিনি নিজে বলতেন, ‘‘তুমি কি দেখতে চাও?’’ আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি আমাকে আমার হুজরার দরজায় তাঁর পিছনে দাঁড় করাতেন। আমি (তাঁর আড়াল থেকে) তাঁর কাঁধের উপর দিয়ে ঐ খেলা দেখতাম। তিনি তাঁর কাঁধকে নিচু করে দিতেন। আর আমার গাল তাঁর গালের সাথে লেগে যেত। নিজ চাদর দিয়ে আমাকে পর্দা করতেন। আর খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন, ‘‘শাবাশ! হে বানী আরফিদাহ!’’ আর ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের খেলা দেখতাম, যতক্ষণ না আমি নিজে তা দেখা বন্ধ করতাম এবং দেখতে ক½vন্ত হয়ে পড়তাম। তখন তিনি প্রশ্ন করতেন, ‘‘যথেষ্ট হয়েছে?’’ আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলতেন, ‘‘অতএব চলে যাও।’’ সুতরাং তোমরা আন্দাজ কর খেলা-প্রিয়া উদীয়মানা নব কিশোরীর খেলার প্রতি আগ্রহ কত![3] আর সেদিন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন, ‘‘মদ্বীনার ইয়াহুদ জেনে নিক যে, আমাদের দ্বীনে উদারতা আছে (এবং সংকীর্ণতা নেই)। নিশ্চয় আমি সুদৃঢ় উদার দ্বীনসহ প্রেরিত হয়েছি।’’[4]
বলা বাহুল্য, মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, তারা তাদের ঈদ পালন করে খুশী করবে এবং সেই খুশী প্রকাশের ফলে তারা সওয়াব-প্রাপ্তও হবে! কেননা, আনন্দের এই বহিঃপ্রকাশ দ্বীনের একটি প্রতীক।
কিন্তু জ্ঞাতব্যের বিষয় যে, ঐ খুশী প্রকাশ হতে হবে শরীয়তের গন্ডীর ভিতরে সীমাবদ্ধ উপকরণের মাধ্যমে; আর তা হল কেবল দুফ বাজিয়ে ছোট ছোট মেয়েদের এমন গীত গেয়ে, যা অসার বা অশ্লীল নয়, শির্কী বা বিদআতী তথা শরীয়ত-বিরোধী নয়। আর তা শোনার মাধ্যমেও আনন্দ উপভোগ করায় দোষ নেই। বলা বাহুল্য, এ ছাড়া গান-বাজনা করা ও শোনা হারাম।
ঈদের এই পবিত্র খুশীতে অবৈধ খেলা ও ফিল¹& দর্শন-প্রদর্শন, যুবক-যুবতীর খেলা ও অবাধ-ভ্রমণ, ছবি তোলা এবং হারাম গান-বাদ্য ব্যবহার করার মাধ্যমে অবশ্যই বিধেয় খুশীর বহিঃপ্রকাশ হয় না। আসলে খুশীর নামে তা হয় শয়তানী কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী বিলাস-কর্ম।[5] সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে পানাহ দিন। আমীন।
প্রকাশ থাকে যে, আতশ বা ফটকাবাজি করে খুশী প্রকাশ করা কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। যেহেতু এ খেলাতে রয়েছে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন, এতে অহেতুক অর্থ অপচয় হয়, এতে আগুন নিয়ে খেলা করা হয় এবং বিপদের আশঙ্কা থাকে অনেক বেশী।
কোন কোন আল্লাহ-ওয়ালা লোক বলেছেন, মানুষ আল্লাহ থেকে গাফেল হয় বলেই গায়রুল্লাহ নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। অতএব গাফেল নিজ খেল-তামাশা ও কুপ্রবৃত্তি নিয়ে আনন্দিত হয়। আর জ্ঞানী নিজ মাওলাকে নিয়ে আনন্দিত হয়।[6]
জ্ঞাতব্য যে, কিছু লোক আছে যারা ঈদ নিয়ে এই জন্য আনন্দিত হয় যে, রমাযান শেষ হয়ে গেছে এবং রোযা আর রাখতে হবে না। অনেকের মাথা থেকে রমাযান ও রোযার যেন বোঝ নেমে যায়। অথচ এমন আচরণ বড় ভ্রান্ত। আসলে মুমিনগণ ঈদ নিয়ে খুশী হয় এই জন্য যে, মহান আল্লাহ তাদেরকে রোযার মাস পূর্ণ করার এবং সম্পূর্ণ মাস রোযা রাখার তওফীক দান করেছেন। যেহেতু তারা এরই মাধ্যমে তাদের মহান প্রভুকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস লাভ করেছে। পক্ষান্তরে তারা এই জন্য আনন্দিত হয় না যে, রোযা শেষ করে ফেলেছে, যে রোযাকে বহু লোকে একটি বড় বোঝা মনে করে থাকে।[7]
দ্বীন-দরদী ভাই মুসলিম! এই খুশীর মুহূর্তে সম্ভব হলে পার্শববর্তী গরীবদেরকে ভুলে যাবেন না। কত গরীব শুধু এই জন্য খুশী করতে পারে না যে, তার ছোট ছেলে-মেয়ের নতুন জামা নেই, কারো বা গোসল করার জন্য সাবান নেই অথবা শখের একদিন মাখার মত আতর নেই। এগুলি ছোট হলেও যদি ঐ দিন তাদেরকে দান করা হয়, তাহলে সেই দিনে খুশী হয় তারা, সেই সাথে খুশী হয় তাদের মা-বাপরা। অতএব আল্লাহ আপনাকে সামর্থ্য দিলে আপনি তাদের সেই শ্রেণীর খুশীর উপকরণ করে দিতে ভুল করবেন না। আল্লাহ আপনাকে নেক বদলা দিন। আমীন।
ঈদ হল একটি অপূর্ব সুযোগ, যে সুযোগে মুমিন তার অন্তর-মন থেকে সেই সকল বিদ্বেষ ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত করতে পারে, যা সে ইতিপূ©র্ব তার কোন মুসলিম ভায়ের প্রতি পোষণ করেছিল। সুতরাং ঈদ হল, মুসলমানদের আপোসে সম্প্রীতি ও একে অন্যের জন্য মন-প্রাণ পরিষ্কার ও উদার করে দেওয়ার এক পরম অবকাশ।
([2]) ঢপঢপে আওয়াজ বিশিষ্ট একমুখো ঢোলক বিশেষ।
[3] (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী ৯৫০, ৫২৩৬, মুসলিম ৮৯২, নাসাঈ)
[4] (আহমাদ, মুসনাদ ৬/১১৬, ২৩৩, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/২/১০২৩, আদাবুয যিফাফ, আলবানী ২৭৪পৃঃ)
[5] (মাজাল্লাতুল বায়ান ১৩৬/২৭)
[6] (ইতহাফু আহলিল ইসলাম বিআহকামিস সিয়াম ৮৪পৃঃ)
[7] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ১০০পৃঃ)