লগইন করুন
রমাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় সংখ্যার রাত্রিগুলোতে শবেকদর অনুসন্ধান করা মুস্তাহাব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এর অনুসন্ধানে উক্ত রাত্রিগুলিতে বড় মেহনত করতেন। আর এ কথা পূর্বে বলা হয়েছে যে, রমাযানের শেষ দশক এসে উপস্থিত হলে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) (ইবাদতের জন্য) নিজের কোমর (লুঙ্গি) বেঁধে নিতেন, সারারাত্রি জাগরণ করতেন এবং আপন পরিজনকেও জাগাতেন। তাছাড়া শবেকদরের সন্ধানে ও আশায় তিনি ঐ শেষ দশকের দিবারাত্রে ই’তিকাফ করতেন।
আসুন! আমরা দেখি শবেকদর কি? তার কদর কতটুক? এবং তার আহকাম কি?
- শবেকদরের নাম শবেকদর কেন?
আরবীতে ‘লাইলাতুল ক্বাদর’-এর ফারসী, উর্দু, হিন্দী ও বাংলাতে অর্থ হল শবেকদর। আরবীতে ‘লাইলাহ’ এবং ফারসীতে ‘শব’ শব্দের মানে হল রাত। কিন্তু ‘ক্বাদর’ শব্দের মানে বিভিন্ন হতে পারে। আর সে জন্যই এর নামকরণের কারণও বিভিন্ন। যেমনঃ-
১। ক্বাদর মানে তকদীর। সুতরাং লাইলাতুল ক্বাদর বা শবেকদরের মানে তকদীরের রাত বা ভাগ্য-রজনী। যেহেতু এই রাতে মহান আল্লাহ আগামী এক বছরের জন্য সৃষ্টির রুযী, মৃত্যু ও ঘটনাঘটনের কথা লিপিবদ্ধ করে থাকেন। যেমন তিনি এ কথা কুরআনে বলেন,
(فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْم)
অর্থাৎ, এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।
(কুরআনুল কারীম ৪৪/৪)
আর এই তকদীর; যা বাৎসরিক বিস্তারিত আকারে লিখা হয়। এ ছাড়া মাতৃগর্ভে ভ্রূণ থাকা অবস্থায় লিখা হয় সারা জীবনের তকদীর। আর আদি তকদীর; যা মহান আল্লাহ আসমান-যমীন সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর পূর্বে ‘লাওহে মাহফূয’-এ লিখে রেখেছেন।
২। ক্বাদরের আর একটি অর্থ হল, কদর, শান, মর্যাদা, মাহাত্ম্য ইত্যাদি। যেমন বলা হয়ে থাকে, সমাজে অমুকের বড় কদর আছে। অর্থাৎ, তার মর্যাদা ও সম্মান আছে। অতএব এ অর্থে শবেকদরের মানে হবে মহিয়সী রজনী।
৩। উক্ত কদর যে রাত জেগে ইবাদত করে তারই। এর পূর্বে যে কদর তার ছিল না, রাত জেগে শবেকদর পাওয়ার পর আল্লাহর কাছে সে কদর লাভ হয় এবং তাঁর কাছে তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। আর তার জন্যই একে শবেকদর বলে।
৪। ঐ কদরের রাতে আমলেরও বড় কদর ও মাহাত্ম্য রয়েছে। সে জন্যও তাকে শবেকদর বলা হয়।
৫। ক্বাদরের আর এক মানে হল সংকীর্ণতা। এ রাতে আসমান থেকে যমীনে এত বেশী সংখ্যক ফিরিশ্তা অবতরণ করেন যে, পৃথিবীতে তাঁদের জায়গা হয় না। বরং তাঁদের সমাবেশের জন্য পৃথিবী সংকীর্ণ হয়। তাই এ রাতকে শবেকদর বা সংকীর্ণতার রাত বলা হয়।
- শবেকদরের মাহাত্ম্যঃ
১। শবেকদরের রয়েছে বিশাল মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। মহান আল্লাহ এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং সে রাতের মাহাত্ম্য ও ফযীলত বর্ণনা করার জন্য কুরআন মাজীদের পূর্ণ একটি সূরা অবতীর্ণ করেছেন এবং সেই সূরার নামকরণও হয়েছে তারই নামে। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ، وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ، لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ)
অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি ঐ কুরআনকে শবেকদরে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জান, শবেকদর কি? শবেকদর হল হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
(কুরআনুল কারীম ৯৭/১-৩)
এক হাজার মাস সমান ৩০ হাজার রাত্রি। অর্থাৎ এই রাতের মর্যাদা ৩০,০০০ গুণ অপেক্ষাও বেশী! সুতরাং বলা যায় যে, এই রাতের ১টি তসবীহ অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ তসবীহ অপেক্ষা উত্তম। অনুরূপ এই রাতের ১ রাকআত নামায অন্যান্য রাতের ৩০,০০০ রাকআত অপেক্ষা উত্তম।
বলা বাহুল্য, এই রাতের আমল শবেকদর বিহীন অন্যান্য ৩০ হাজার রাতের আমল অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ। সুতরাং যে ব্যক্তি এই রাতে ইবাদত করল, আসলে সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাস অপেক্ষাও বেশী সময় ধরে ইবাদত করল।
২। শবেকদরের রাত হল মুবারক রাত, অতি বর্কতময়, কল্যাণময় ও মঙ্গলময় রাত। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ)
অর্থাৎ, আমি এ কুরআনকে বর্কতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি।
(কুরআনুল কারীম ৪৪/৩)
উক্ত বর্কতময় রাত্রি হল ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ বা শবেকদর। আর শবেকদর নিঃসন্দেহে রমাযানে। বলা বাহুল্য, ঐ রাত্রি শবেবরাতের রাত্রি নয়; যেমন অনেকে মনে করে থাকে এবং ঐ রাত্রে বৃথা মনগড়া ইবাদত করে থাকে। কারণ, কুরআন (লাওহে মাহফূয থেকে) অবতীর্ণ হয়েছে (অথবা তার অবতারণ শুরু হয়েছে) রমাযান মাসে। কুরআন বলে,
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ)
অর্থাৎ, রমাযান মাস; যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর তিনি বলেন,
(إِنا أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ)
অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি ঐ কুরআনকে শবেকদরে অবতীর্ণ করেছি।
(কুরআনুল কারীম ৯৭/১-৩)
আর এ কথা বিদিত যে, শবেকদর হল রমাযানে; শা’বানে নয়।
(فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ)
৩। এই রাত সেই ভাগ্য-রাত; যাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (কুরআনুল কারীম ৪৪/৪)
৪। এটা হল সেই রাত; যে রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফিরিশ্তাকুল তাঁদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ, যে কাজের ফায়সালা ঐ রাতে করা হয় তা কার্যকরী করার জন্য তাঁরা অবতরণ করেন। মহান আল্লাহ বলেন,
(تَنَزَّلُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ)
৫। এ রাত হল সালাম ও শান্তির রাত। মহান আল্লাহ বলেন,
(سَلاَمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ)
অর্থাৎ, সে রজনী ফজর উদয় পর্যন্ত শান্তিময়।
পূর্ণ রাতটাই শান্তিতে পরিপূর্ণ; তার মধ্যে কোন প্রকার অশান্তি নেই। রাত্রি জাগরণকারী মুমিন নারী-পুরুষের জন্য এ হল শান্তির রাত্রি। শয়তান তাদের মাঝে কোন প্রকার অশান্তি আনয়ন করতে পারে না। অথবা সে রাত্রি হল নিরাপদ। শয়তান সে রাত্রে কোন প্রকার অশান্তি ঘটাতে পারে না। অথবা সে রাত হল সালামের রাত। এ রাতে অবতীর্ণ ফিরিশ্তাকুল ইবাদতকারী মুমিনদেরকে সালাম জানায়।[1]
৬। এ রাত্রি হল কিয়াম ও গোনাহ-খাতা মাফ করাবার রাত্রি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান রেখে ও নেকী লাভের আশা করে শবেকদরের রাত্রি কিয়াম করে (নামায পড়ে), সে ব্যক্তির পূর্বেকার গোনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়।’’[2]
বলা বাহুল্য, এ রাত্রি হল ইবাদতের রাত্রি। এ রাত্রি ধুমধাম করে পান-ভোজনের, আমোদ-খুশীর রাত্রি নয়। আসলে যে ব্যক্তি এ রাত্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সেই সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
- শবেকদর কোন্ রাতটি?
রমাযান মাসের শেষ দশকের যে কোন একটি রাত্রি শবেকদরের রাত্রি। একদা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) শবেকদরের অ‡¦বষণে রমাযানের প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলেন। অতঃপর মাঝের দশকে ই’তিকাফ করে ২০শের ফজরে বললেন, ‘‘আমাকে শবেকদর দেখানো হয়েছিল; কিন্তু পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত্রে তা অনুসন্ধান কর। আর আমি দেখেছি যে, আমি পানি ও কাদাতে সিজদা করছি।’’[3] অতঃপর ২১শের রাত্রিতে বৃষ্টি হয়েছিল। অতএব সে বছরে ঐ ২১শের রাতেই শবেকদর হয়েছিল।
পূর্বোক্ত হাদীসের ইঙ্গিত অনুসারে শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিগুলোতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। সুতরাং ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ এই ৫ রাত হল শবেকদর হওয়ার অধিক আশাব্যঞ্জক রাত। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, বিজোড় রাত্রি ছাড়া জোড় রাত্রিতে শবেকদর হবে না। বরং শবেকদর জোড়-বিজোড় যে কোন রাত্রিতেই হতে পারে। তবে বিজোড় রাতে শবেকদর সংঘটিত হওয়াটাই অধিক সম্ভাবনাময় ও আশাব্যঞ্জক।[4]
শেষ দশকের মধ্যে শেষ সাত রাত্রিগুলো অধিক আশাব্যঞ্জক। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমি দেখছি যে, তোমাদের সবারই স্বপ্ন শেষ সাত রাতের ব্যাপারে একমত হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি শবেকদর অনুসন্ধান করতে চায়, সে যেন শেষ সাত রাতগুলিতে করে।’’[5]
অবশ্য এর অর্থ যদি ‘কেবল ঐ বছরের রমাযানের শেষ সাত রাতের কোন এক রাতে শবেকদর হবে’ হয় এবং তার অর্থ ‘আগামী প্রত্যেক রমাযানে হবে’ না হয় তাহলে। কারণ, এরূপ অর্থ হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করা যায় না। তাছাড়া যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর শেষ জীবন অবধি রমাযানের শেষ দশকের পুরোটাই ই’তিকাফ করে গেছেন এবং এক বছর শবেকদর ২১শের রাত্রিতেও হয়েছে - যেমন এ কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।[6]
শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিগুলির মধ্যে ২৭শের রাত্রি শবেকদরের জন্য অধিক আশাব্যঞ্জক। কেননা, উবাই বিন কা’ব (রাঃ) ‘ইন শাআল্লাহ’ না বলেই কসম খেয়ে বলতেন, ‘শবেকদর রাত্রি হল ২৭শের রাত্রি; ঐ রাত্রিতে কিয়াম করতে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ করেছেন।’[7]
অনুরূপভাবে মুআবিয়া (রাঃ) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘২৭শের রাত্রি হল শবেকদরের রাত্রি।’[8]
কিন্তু ঐ রাতে হওয়াই জরুরী নয়। কারণ, এ ছাড়া অন্যান্য হাদীস রয়েছে, যার দ্বারা বুঝা যায় যে, শবেকদর অন্য তারীখের রাতেও হয়ে থাকে।
বলা বাহুল্য, শবেকদরের রাত প্রত্যেক বছরের জন্য একটি মাত্রই রাত নয়। বরং তা বিভিন্ন রাত্রে সংঘটিত হতে পারে। সুতরাং কোন বছরে ২৯শে, কোন বছরে ২৫শে, আবার কোন বছরে ২৪শের রাতেও শবেকদর হতে পারে। আর এই অর্থে শবেকদর প্রসঙ্গে বর্ণিত সমস্ত হাদীসের মাঝে পরস্পর-বিরোধিতা দূর হয়ে যাবে।
শবেকদর একটি নির্দিষ্ট রাত না হয়ে এক এক বছরে শেষ দশকের এক এক রাতে হওয়ার পশ্চাতে হিকমত এই যে, যাতে অলস বান্দা কেবল একটি রাত জাগরণ ও কিয়াম করেই ক্ষান্ত না হয়ে যায় এবং সেই রাতের মর্যাদা ও ফযীলতের উপর নির্ভর করে অন্যান্য রাতে ইবাদত ত্যাগ না করে বসে। পক্ষান্তরে অনির্দিষ্ট হলে এবং প্রত্যেক রাতের মধ্যে যে কোন একটি রাতের শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বান্দা শেষ দশকের পুরোটাই কিয়াম ও ইবাদত করতে আগ্রহী হবে। আর এতে রয়েছে তারই লাভ।[9]
ঠিক হুবহু একই যুক্তি হল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর হৃদয় থেকে শবেকদর (তারীখ) ভুলিয়ে দেওয়ার পিছনে।[10] আর এতে রয়েছে সেই মঙ্গল; যার প্রতি ইঙ্গিত করে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘আমি শবেকদর সম্বন্ধে তোমাদেরকে খবর দেওয়ার জন্য বের হয়ে এলাম। কিন্তু অমুক ও অমুকের কলহ করার ফলে শবেকদরের সে খবর তুলে নেওয়া হল। এতে সম্ভবতঃ তোমাদের জন্য মঙ্গল আছে। সুতরাং তোমরা নবম, সপ্তম এবং পঞ্চম রাত্রে তা অনুসন্ধান কর।’’[11]
শবেকদরের সওয়াব অর্জনের জন্য শবেকদর কোন্ রাতে হচ্ছে তা জানা বা দেখা শর্ত নয়। তবে ইবাদতের রাতে শবেকদর সংঘটিত হওয়া এবং তার অনুসন্ধানে সওয়াবের আশা রাখা শর্ত। শবেকদর কোন্ রাতে ঘটছে তা জানা যেতে পারে। আল্লাহ যাকে তওফীক দেন, সে বিভিন্ন লক্ষণ দেখে শবেকদর বুঝতে পারে। সাহাবাগণ (রাযি.) একাধিক নিদর্শন দেখে জানতে পারতেন শবেকদর ঘটার কথা। তবে তা জানা বা দেখা না গেলে যে তার সওয়াব পাওয়া যাবে না -তা নয়। বরং যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশা রেখে সে রাত্রিতে ইবাদত করবে, সেই তার সওয়াবের অধিকারী হবে; চাহে সে শবেকদর দেখতে পাক বা না-ই পাক।
বলা বাহুল্য, মুসলিমের উচিত, সওয়াব ও নেকী অর্জনের উদ্দেশ্যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ ও নির্দেশমত রমাযানের শেষ দশকে শবেকদর অ‡¦বষণ করতে যত্নবান ও আগ্রহী হওয়া। অতঃপর দশটি রাতে ঈমান ও নেকীর আশা রাখার সাথে ইবাদত করতে করতে যে কোন রাতে যখন শবেকদর লাভ করবে, তখন সে সেই রাতের অগাধ সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে; যদিও সে বুঝতে না পারে যে, ঐ দশ রাতের মধ্যে কোন্ রাতটি শবেকদররূপে অতিবাহিত হয়ে গেল। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান রেখে ও নেকী লাভের আশা করে শবেকদরের রাত্রি কিয়াম করে (নামায পড়ে), সে ব্যক্তির পূর্বেকার গোনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়।’’[12] অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে তার খোঁজে কিয়াম করল এবং সে তা পেতে তওফীক লাভ করল তার পূর্বেকার গোনাহসমূহ মাফ হয়ে গেল।’’[13] আর একটি বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি শবেকদরে কিয়াম করবে এবং সে তা ঈমান ও নেকীর আশা রাখার সাথে পেয়ে যাবে, তার গোনাহসমূহ মাফ হয়ে যাবে।’’[14]
আর এ সব সেই ব্যক্তির ধারণাকে খন্ডন করে, যে মনে করে যে, যে ব্যক্তি শবেকদর মনে করে কোন রাতে কিয়াম করবে, তার শবেকদরের সওয়াব লাভ হবে; যদিও সে রাতে শবেকদর না হয়।[15]
- শবেকদরের আলামতসমূহঃ
শবেকদরের কিছু আলামত আছে যা রাত মধ্যেই দেখা যায় এবং আর কিছু আলামত আছে যা রাতের পরে সকালে দেখা যায়। যে সব আলামত রাতে পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নরূপঃ-
- শবেকদরের রাতের আকাশ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল থাকে। অবশ্য এ আলামত শহর বা গ্রামের ভিতর বিদ্যুতের আলোর মাঝে থেকে লক্ষ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু যারা আলো থেকে দূরে মাঠে-ময়দানে থাকে, তারা সে ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করতে পারে।
- অন্যান্য রাতের তুলনায় শবেকদরের রাতে মুমিন তার হৃদয়ে এক ধরনের প্রশস্ততা, সবস্তি ও শান্তি বোধ করে।
- অন্যান্য রাতের তুলনায় মুমিন শবেকদরের রাতে কিয়াম বা নামাযে অধিক মিষ্টতা অনুভব করে।
- এই রাতে বাতাস নিস্তব্ধ থাকে। অর্থাৎ, সে রাতে ঝোড়ো বা জোরে হাওয়া চলে না। আবহাওয়া অনুকূল থাকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘শবেকদরের রাত উজ্জ্বল।’’[16] অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘‘নাতিশীতোষ্ণ; না ঠান্ডা, না গরম।’’[17]
- শবেকদরের রাতে উল্কা ছুটে না।[18]
- এ রাতে বৃষ্টি হতে পারে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমাকে শবেকদর দেখানো হয়েছিল; কিন্তু পরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত্রে তা অনুসন্ধান কর। আর আমি দেখেছি যে, আমি পানি ও কাদাতে সিজদা করছি।’’[19] অতঃপর ২১শের রাত্রিতে সত্যই বৃষ্টি হয়েছিল।
- শবেকদর কোন নেক বান্দা স্বপ্নের মাধ্যমেও দেখতে পারেন। যেমন কিছু সাহাবা তা দেখেছিলেন।
পক্ষান্তরে যে সব আলামত রাতের পরে সকালে দেখা যায় তা হল এই যে, সে রাতের সকালে উদয়কালে সূর্য হবে সাদা; তার কোন কিরণ থাকবে না।[20] অথবা ক্ষীণ রক্তিম অবস্থায় উদিত হবে;[21] ঠিক পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মত। অর্থাৎ, তার রশি¹ চারিদিকে বিকীর্ণ হবে না।
আর লোক মুখে যে সব আলামতের কথা প্রচলিত; যেমনঃ সে রাতে কুকুর ভেকায় না বা কম ভেকায়, গাছ-পালা মাটিতে নুয়ে পড়ে আল্লাহকে সিজদা করে, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মিঠা হয়ে যায়, নূরের ঝলকে অন্ধকার জায়গা আলোকিত হয়ে যায়, নেক লোকেরা ফিরিশ্তার সালাম শুনতে পান ইত্যাদি আলামতসমূহ কাল্পনিক। এগুলি শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এ সব কথা নিশ্চিতরূপে অভিজ্ঞতা ও বাস্তববিরোধী।[22]
- শবেকদরের দুআঃ
মা আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি শবেকদর লাভ করলে তাতে কি দুআ পাঠ করব? উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘তুমি বলো,
اَللّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ.
উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন তুহিববুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নী।[23]
اَللّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيْمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ.
উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন কারীমুন তুহিববুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নী।[24]
অর্থঃ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল (মহানুভব), ক্ষমাকে পছন্দ কর। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
[2] (বুখারী : ৩৫, মুসলিম : ৭৬০ নং, সুনানে আরবাআহ; আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)।
[3] (বুখারী ২০১৬, মুসলিম ১১৬৭নং)
[4] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৯৬)
[5] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৬, বুখারী ২০১৫, মালেক, মুওয়াত্তা, মুসলিম ১১৬৫নং)
[6] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৯৩)
[7] (মুসলিম ৭৬২নং)
[8] (সহীহ আবূ দাঊদ ১২৩৬নং)
[9] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৯৪)
[10] (শারহুস সাদর বিযিক্রি লাইলাতিল ক্বাদর ৪৯পৃঃ)
[11] (বুখারী ২০২৩নং)
[12] (বুখারী ৩৫, মুসলিম ৭৬০ নং, সুনানে আরবাআহ; আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
[13] (আহমাদ, মুসনাদ ৫/৩১৮, ২২৬১২নং)
[14] (মুসলিম ৭৬০নং)
[15] (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ২০/১৮৬-১৮৭)
[16] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ ২১৯২, প্রমুখ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৫৪৭২, ৫৪৭৫নং)
[17] (ঐ)
[18] (ঐ)
[19] (বুখারী ২০১৬, মুসলিম ১১৬৭নং)
[20] (মুসলিম ৭৬২নং)
[21] (সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৫৪৭৫নং)
[22] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ৯২পৃঃ, আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৯৮-৪৯৯)
[23] (আহমাদ, মুসনাদ ৬/১৭১, ১৮২, ১৮৩, ২৫৮, নাসাঈ আমালুল ইয়াওমি অল-লাইলাহ ৮৭২নং, ইবনে মাজাহ ৩৮৫০, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৫৩০)
[24] (তিরমিযী ৩৫১৩নং)