লগইন করুন
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নাবীর প্রতি সর্বপ্রথম যেই অহী প্রেরণ করেন তা হচ্ছে,
إقرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ خَلَقَ الإنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ أقْرَأْ وَرَبُّكَ الأَكْرَمُ
‘‘তোমার রবের নামে পড়, যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাট রক্ত থেকে যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড় তোমার রব সবচেয়ে বেশী সম্মানিত। (সূরা আলাক-৯৬:১-৩) এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে নবুওয়াতের সূচনা হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করলেন-
يَا أيُّهاَ الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأنْذِرْ وَ رَبَّكَ فَكَبِّرْ ......وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ
‘‘হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি!। উঠ, সতর্ক কর। তোমার পালনকর্তার বড়ত্ব ঘোষণা করো এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক’’। (সূরা মুদ্দাসি্সর-৭৪:১-৫) এর মাধ্যমে তাঁর উপর রেসালাতের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে আদেশ দিলেন তিনি যেন তার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
‘‘এবং তুমি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক কর’’। (সূরা শুআরা-২৬২১৪) সুতরাং তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করলেন। অতঃপর তিনি সমগ্র আরব সম্প্রদায়কে সতর্ক করলেন। অতঃপর সারা বিশ্ববাসীকেও সতর্ক করলেন। মক্কাতে তিনি ১৩ বছর অবস্থান করলেন। এ সময়ে শুধু দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেছেন। কোন প্রকার যুদ্ধ করেন নি। তখন তাকে সবর করার আদেশ দেয়া হত। তারপর তাঁকে হিজরতের অনুমতি প্রদান করা হল। এরপর যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ করবে, কেবল তাদের সাথেই যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হল। পরিশেষে আল্লাহর দ্বীন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সকল মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন।
জিহাদের আদেশ নাযিল হওয়ার পর কাফেররা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। (১) এক দল কাফের তাঁর সাথে সন্ধি ও চুক্তিতে আবদ্ধ হল। (২) এক দল কাফেরের সাথে যুদ্ধ চলতে থাকল এবং (৩) অন্য এক দল জিযিয়া প্রদান করতে রাজী হয়ে গেল। চুক্তিবদ্ধ কাফেররা যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষা করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা ততক্ষণ তাদের সাথে অঙ্গীকার পূর্ণ করার আদেশ দিলেন। তাদের পক্ষ হতে খেয়ানতের আশঙ্কা হলে অঙ্গীকার রক্ষা করা জরুরী নয়। যারা তাঁর সাথে চুক্তি করার পর তা ভঙ্গ করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। উপরোক্ত তিন প্রকার মুশরিকদের ব্যাপারে সূরা তাওবা নাযিল হয়। জিযিয়া প্রদান না করা পর্যন্ত তিনি আহলে কিতাবদের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে মুনাফেক ও কাফেরদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং তিনি অস্ত্র দ্বারা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। মুনাফেকদের সাথে যুদ্ধ করেছেন দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করার মাধ্যমে। এই সূরায় তিনি কাফেরদের সাথে সকল প্রকার চুক্তির বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন এবং তাদেরকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। এক প্রকার কাফেরের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। এরা হচ্ছে চুক্তি ভঙ্গকারী। আরেক প্রকার হচ্ছে, যাদের সাথে স্বল্প মেয়াদী চুক্তি হয়েছিল। তারা সেই চুক্তি ভঙ্গ করেনি এবং তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কাউকে সাহায্যও করেনি। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে সেই চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করার আদেশ দিয়েছেন। তৃতীয় আরেক প্রকার কাফের হচ্ছে, যাদের সাথে কোন চুক্তিই ছিল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করে নি। এই প্রকার কাফেরেদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা চার মাস সময় দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। এই মেয়াদ চলে গেলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। সেই মেয়াদ ছিল মাত্র চার মাস। নিম্ন লিখিত আয়াতে এই চুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللهِ وَأَنَّ اللهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ
‘‘অতঃপর তোমরা পরিভ্রমন কর এ দেশে চার মাসকাল। আর জেনে রেখো, তোমরা আল্লাহ্কে পরাভূত করতে পারবেনা, আর নিশ্চিয়ই আল্লাহ্ কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত করেন’’। (সূরা তাওবা-৯: ২) মেয়াদ শেষ হলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়ে বলেন-
فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক। কিন্তু যদি তারা তাওবা করে, সলাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। (সূরা তাওবা-৯: ৫) এই চার মাস মেয়াদের শুরু হচ্ছে যুল-হাজ্জ মাসের ১০ তারিখ আর শেষ হচ্ছে রবীউল আওয়াল মাসের ১০ তারিখ। আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করোনা। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ্ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা তাওবা-৯:৩৬) সুতরাং এখানে যে চার মাসের কথা বলা হয়েছে, পূর্বের আয়াতে সেই চার মাস উদ্দেশ্য নয়। কেননা হারাম মাস সমূহের তিনটি আসে ধারাবাহিকভাবে (পরপর)। যুল-কাদ, যুল-হাজ্জ এবং মুহার্রাম। আরেকটি হচ্ছে রজব, তা আসে আলাদাভাবে। সুতরাং এই চারমাসে তাদেরকে ভূপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করতে বলা হয়নি। কারণ হারাম সমূহের সবগুলো একসাথে না আসার কারণে তাতে পরিভ্রমণ করা সম্ভবও নয়। চারমাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং চুক্তি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন, যাদের সাথে কোন অঙ্গিকার ছিলনা, তাদেরকে চারমাস সময় দিয়েছেন। আর যারা অঙ্গিকার পূর্ণ করবে, তাদের সাথে কৃত চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করার আদেশ দিয়েছেন। পরিশেষে সকল কাফের মুসলমান হয়ে গেল। কোন কাফেরই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত কুফরীর উপর অবিচল রইল না। যিম্মীদের উপর তিনি জিযিয়া নির্ধারণ করে দিলেন। সুতরাং লোকেরা তিনভাবে বিভক্ত হয়ে গেল। (১) নাবী (ﷺ) এর সাথে যুদ্ধরত কাফের সম্প্রদায়। (২) নাবী (ﷺ) এর সাথে চুক্তিবদ্ধ কাফের সম্প্রদায়। (৩) জিযিয়া প্রদানকারী। অতঃপর চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমরা মুসলমান হয়ে গেল। এখন দুই প্রকারের লোক বাকী থাকল। যুদ্ধকারী ও যিম্মী। পরিশেষে তৎকালে ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী সকল মানুষ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। মুসলিম, যিম্মী (কর প্রদানকারী) এবং যুদ্ধরত কাফের, যারা নাবী (ﷺ) এর পক্ষ হতে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল।
মুনাফেকদের সাথে নাবী (ﷺ) এর আচরণ এ রকম ছিল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের প্রকাশ্য দিকটি দেখেই সিদ্বান্ত নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং অন্তরের গোপন বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দিতে বলেছেন। আর দলীল-প্রমাণ পেশ করার মাধ্যমে তাদের সাথে জিহাদ করার হুুকম দিয়েছেন। সেই সাথে তাদের অন্তরে যেন পীড়া দায়ক হয় এমন শক্ত ও কঠিন কথা বলার আদেশ দিয়েছেন। তাদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযার সলাত পড়তে এবং কবরের কাছে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুনাফেকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করবেন না আর না করলেও ক্ষমা করবেন না।