লগইন করুন
তিনি যে সমস্ত শব্দ ও বাক্য পছন্দ করতেন না তার অন্যতম হচ্ছে, خبثت نفسي ‘খাবুছাত নাফসী’ অর্থাৎ আমার চরিত্র নোংরা হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে তিনি لقست نفسي ‘লাকিসাত নাফসী’ বলার উপদেশ দিয়েছেন। উভয় বাক্যের অর্থ কাছাকাছি। তা হচ্ছে অভ্যাস ও চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। নাবী (ﷺ) خبث শব্দটি প্রয়োগ করা অপছন্দ করেছেন। কারণ তা কদর্যতা ও নোংরামীর মাত্রাতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে। তিনি আঙ্গুর ফলকে কারাম বলতেও নিষেধ করেছেন। কারণ কারাম হচ্ছে মুমিনের গুণ। তিনি কাউকে এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন যে, هَلَكَ النَّاسَ ‘মানুষেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’। নাবী (ﷺ) বলেন- যে ব্যক্তি এরূপ বলল, মূলতঃ সেই যেন লোকদেরকে ধ্বংস করে দিল। এমনি فَسَدَ النَّاسُ وَفَسَدَ الزَّمَانُ ‘লোকেরা নষ্ট হয়ে গেছে, যামানা খারাপ হয়ে গেছে’ বলাও অপছন্দনীয়। তিনি অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি বলতেও নিষেধ করেছেন।[1]
আর তিনি ما شاء الله وشئت ‘আল্লাহ্ যা চান’ এবং ‘তুমি যা চাও’ বলতেও নিষেধ করেছেন।[2] রসূল (ﷺ) আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন-
مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ أَشْرَكَ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল সে শিরক করল’’।[3] এমনি শপথের মধ্যে এ কথাও বলা নিষিদ্ধ যে, সে যদি এমন করে তাহলে ইহুদী হয়ে যাবে। তিনি বাদশাহকে মালিকুল মুল্ক তথা শাহানশাহ বা রাজাধিরাজ বলতে নিষেধ করেছেন। চাকর ও খাদেমকে আমার বান্দা বা আমার বান্দী বলাও নিষিদ্ধ। বাতাসকে গালি দেয়া, জ্বরকে (রেসূকে) দোষারোপ করা, মোরগকে গালি দেয়ার ব্যাপারেও নিষিদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে।
আইয়্যামে জাহেলীয়াত তথা অন্ধকার যুগের সকল আহবান ও শেস্নাগানকে তিনি বর্জন করার আদেশ দিয়েছেন। মুসলিমদেরকে গোত্র, বংশ এবং জাতীয়তাবাদের দিকে আহবান করতে এবং এর ভিত্তিতে বিভক্ত হতে নিষেধ করেছেন। অনুরূপ মাজহাব ভিত্তিক দলাদলি, বিভিন্ন তরীকা ও মাশায়েখের অনুসরণ করাও নিষিদ্ধ।
তিনি অধিকাংশ মুসলিমের নিকট পরিচিত ‘এশা’ সলাতের নাম বর্জন করে ‘আতামাহ’ রাখাকে অপছন্দ করেছেন।[4] এমনি মুসলিমকে গালি দেয়া, তিনজন এক সাথে থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দুইজন মিলে গোপনে আলাপ করা এবং মহিলাকে তার স্বামীর কাছে অন্য মহিলার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন।
তিনি اللهُمَّ اغْفِرْ لِي إِنْ شِئْتَ ‘‘হে আল্লাহ! তুমি ইচ্ছা করলে আমাকে ক্ষমা কর’’- এইভাবে দু’আ করতে নিষেধ করেছেন এবং আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দৃঢ়তার সাথে চাওয়ার আদেশ করেছেন। তিনি বেশী বেশী শপথ করা, কাওসে কাযাহ (রংধনু) বলা, আল্লাহর চেহারার উসীলায় কিছু চাওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি মদ্বীনাকে ইয়াছরিব বলতে নিষেধ করেছেন। তিনি বিনা প্রয়োজনে কোন লোককে এ কথা জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছেন যে, কেন সে তাঁর স্ত্রীকে প্রহার করেছে। তবে প্রয়োজন বশত জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। আমি পূর্ণ রমযান মাস সিয়াম রেখেছি এবং পূর্ণরাত তাহাজ্জুদ সলাত পড়েছি- এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
যে সমস্ত বিষয় ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলা উচিৎ, তা সুস্পষ্ট করে এবং খোলাখুলিভাবে বলাও অপছন্দনীয়। কথা-বার্তার অন্তর্ভুক্ত। أطال الله بقاءك আল্লাহ্ তোমাকে দীর্ঘ দিন জীবিত রাখুক বা অনুরূপ কথা বলা মাকরূহ। সায়িমকে তিনি এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন যে, ঐ আল্লাহর শপথ যার সীলমোহর আমার মুখের উপর রয়েছে। কেননা কাফেরের মুখের উপরই রয়েছে আল্লাহর সীলমোহর। জোরপূর্বক আদায়কৃত সম্পদকে হক বা অধিকার বলা অন্যায়। আল্লাহর রাস্তায় ও আল্লাহর আনুগত্যে খরচ করার পর এ কথা বলা অন্যায় যে, আমি এত এত সম্পদ নষ্ট করেছি, দুনিয়াতে আমি অনেক সম্পদ খরচ করেছি ইত্যাদি। ইজতেহাদী মাসআলায় মুফতীর এ কথা বলা নিষিদ্ধ যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এটি হালাল করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা এটি হারাম করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহর কোন দলীলকে মাজায (রূপকার্থবোধক) বলা ঠিক নয়। এমনিভাবে দার্শনিকদের সন্দেহসমূহকে অকাট্য যুক্তি বলা অযৌক্তিক। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, উপরোক্ত দু’টি বাক্য ব্যবহার করার কারণে দ্বীন ও দুনিয়ার অসংখ্য ক্ষতি হয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সমস্ত কাজ (সহবাস বা অন্যান্য বিষয়) হয় তা মানুষের মাঝে বলে বেড়ানো নিষিদ্ধ। যেমনটি করে থাকে নির্বোধ ও নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা।
আরও যে সমস্ত অপছন্দনীয় শব্দ লোকেরা উচ্চারণ করে থাকে তার মধ্যে এও রয়েছে যে, তারা ধারণা করে থাকে, তারা বলে থাকে, তারা আলোচনা করে থাকে ইত্যাদি। শাসককে خليفة الله অর্থাৎ আল্লাহর খলীফা (প্রতিনিধি) বলা নিষিদ্ধ। কেননা খলীফা মূলতঃ অনুপস্থিত লোকের পক্ষ হতে নিযুক্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ নিজেই তো অনুপস্থিত মুমিন ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের খলীফা (দেখাশুনাকারী)। সুতরাং মানুষ আল্লাহর খলীফা হয় কিভাবে?
আমি, আমার, আমার নিকট ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করা থেকে সতর্ক থাকা উচিৎ। কেননা এই তিনটি শব্দ বলার কারণেই ইবলীস, ফেরাউন এবং কারুন ধ্বংস হয়েছে। ইবলীস বলেছিল-
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ
‘‘আমি তার (আদম) থেকে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে। আর তাঁকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে’’। (সূরা আরাফ-৭:১২) ফেরাউন বলেছিল- أَلَيْسَ لِيْ مُلْكُ مِصْرَ ‘‘মিশরের রাজত্ব কি একমাত্র আমার নয়?’’। (সূরা যুখরুফ-৪৩:৫১) কারুন বলেছিল- إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِيْ ‘‘এই ধন আমার নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছি’’। (সূরা কাসাস-২৮:৭৮)
أنَا‘আমি’ শব্দটি সবচেয়ে অধিক সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে ঐ বান্দার কথার মধ্যে, যে বান্দা বলেছিল-
أنَا العَبْدُ المُذْنِبُ المُخْطِئُ المُسْتِغْفِرُ المُعْتَرِفُ
‘‘আমি অপরাধী, পাপী, অপরাধ স্বীকারকারী ক্ষমাপ্রার্থী একজন বান্দা’’।لي ‘আমার’ শব্দটিও খুবই সুন্দর রূপে ব্যবহৃত হয়েছে ঐ বান্দার কথায়, যে বলেছিল-
لِيَ الذَّنْبُ وَلِيَ الْجُرْمُ وَلِيَ الْمَسْكَنَةُ وَلِيَ الْفَقْرُ وَالذُّلُّ
‘‘গুনাহ, অপরাধ, অভাব, দারিদ্র এবং হীনতা এ সবের সবই আমার মধ্যে রয়েছে’’। এমনি عندي ‘আমার নিকট’ কথাটিও নিম্নের দু’আয় অতি সুন্দরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِىْ خَطِيئَتِى وَجَهْلِىْ وَإِسْرَافِىْ فِىْ أَمْرِىْ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّى اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِىْ جِدِّىْ وَهَزْلِىْ وَخَطَئِىْ وَعَمْدِىْ
‘‘হে আল্লাহ্! তুমি আমার অসতর্কতা বশতঃ কৃত গুনাহ, অজ্ঞতা বশতঃ অপরাধ, আমার কাজের ক্ষেত্রে সীমালংঘন এবং তুমি আমার ঐ সমস্ত অপরাধও ক্ষমা করে দাও যে সম্পর্কে তুমি আমার চেয়ে অধিক অবগত আছ। হে আল্লাহ্! তুমি আমার উদ্দেশ্যমূলক, হাসি-ঠাট্টা প্রসূত, ভুলবশত এবং ইচ্ছাকৃত সকল গুনাহ্ মা’ফ করে দাও।
[2]. এতে (এবং) শব্দের মাধ্যমে বান্দা ও আল্লাহর ইচ্ছাকে সমান করে দেয়া হয়। তাই (এবং) শব্দ পরিহার করে অতঃপর শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ এভাবে বলতে হবে যে, আল্লাহ্ যা চান অতঃপর সে যা চায়।
[3]. মুসনাদে আহমাদ।
[4]. গ্রাম্য লোকেরা সে সময় এশার সলাতকে আতামার সলাত বলত। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমগণ তখন এশার সলাত বলত। তাই নাবী সাঃ) গ্রাম্য লোকদের অভ্যাস মোতাবেক এশার সলাতের নাম বর্জন করে আতামার সলাত বলা অপছন্দ করেছেন।