লগইন করুন
নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাসূল (ﷺ) মানুষদেরকে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ করতে বাধ্য করেন নি। বরং তিনি তাঁর আনুগত্য করা আবশ্যক করে দিয়েছেন। কেননা রাসূল (ﷺ) যা নিয়ে এসেছেন, হক্ব তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ। সুতরাং কোন একনিষ্ঠ ব্যক্তি যদি একটু ভেবে দেখেন, তাহলে তার কাছে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে যে, দলীল ছাড়া নির্দিষ্ট কোন ইমামের মাযহাবের তাক্বলীদ করা বড় অজ্ঞতা ও ভয়াবহ বিপদের নামান্তর। বরং তা নিছক প্রবৃত্তির অনুসরণ ও স্বজনপ্রীতি বৈ কিছু নয়। মুজতাহিদ ইমামগণও এর বিরোধিতা করেছেন। যেমনটি তাদের উক্তিতে আমরা দেখেছি।
অতএব যে ব্যক্তি দলীলের অনুসরণ করবে সে স্বীয় ইমামসহ সকল ইমামেরই অনুসরণ করবে এবং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) এর অনুসারী হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যদি দলীল ছাড়া তাক্বলীদকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে ও মেনে নেয়, তাহলে সে তাদের মাযহাব থেকে বহির্ভূত বলে গণ্য হবে। কেননা তার ইমাম যখন দুর্বল হাদীসের পরিবর্তে সহীহ হাদীস পেয়ে যান, তখন তিনি স্বীয় অভিমত ত্যাগ করে হাদীসের অনুসরণ করেন। সুতরাং এক্ষেত্রে তাক্বলীদের গোঁড়া অনুসারী; আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর অবাধ্যকারী ও প্রবৃত্তির অনুসারী হিসেবে বিবেচিত হবে।[1]
আল্লাহ্ বলেন:
﴿أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ﴾
তবে তুমি কি তাকে লক্ষ করেছ যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন (সূরা জাসিয়া-২৩)।
আল্লাহ্ আরও বলেন:
﴿فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾
অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ্ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ (সূরা : আন-নিসা-৫৯)।
ইবনে হাযাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:[2] ‘‘তাক্বলীদ করা হারাম। দলীল ব্যতীত রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যের কথাকে গ্রহণ করা কারও জন্য বৈধ নয়’’।
কেননা আল্লাহ্ বলেন:
﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ﴾
তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হতে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না (সূরা : আল আ‘রাফ-৩)।
আল্লাহ্ আরও বলেন:
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا﴾
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা অনুসরণ কর, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন, তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তার অনুসরণ করব (সূরা বাকারা-১৭০)।
যারা তাক্বলীদ করেন না, আল্লাহ্ তাদের প্রশংসা করে বলেন:
﴿فَبَشِّرْ عِبَادِ ۞ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
অতএব আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দাও। যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে অতঃপর এর যা উত্তম তা অনুসরণ করে তাদেরকেই আল্লাহ্ হিদায়াত দান করেন আর তারাই বুদ্ধিমান (যুমার-১৭,১৮)।
আল্লাহ্ বলেন:
﴿فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾
অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ্ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ (সূরা : আন-নিসা-৫৯)।
সুতরাং দ্বন্দ্ব নিরসনকে কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কারও দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে আল্লাহ্ বৈধ করেন নি। এ ব্যাপারে প্রথম ও শেষ যুগের সাহাবাদের, প্রথম ও শেষ যুগের তাবেঈদের এবং প্রথম ও শেষ যুগের তাবে-তাবেঈনদের ইজমা রয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোন মানুষের দিকে কিংবা তাদের পূর্ববর্তীদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।
ঐ ব্যক্তির জেনে রাখা উচিৎ, যে ব্যক্তি ইমাম আবূ হানীফার (রাহিমাহুল্লাহ) সমস্ত মতামত গ্রহণ করে অথবা মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) সমস্ত মতামত গ্রহণ করে, কিংবা শাফেঈর (রাহিমাহুল্লাহ) সমস্ত কথা গ্রহণ করে অথবা আহমাদের (রাহিমাহুল্লাহ) সমস্ত কথা গ্রহণ করে ও স্বীয় অনুসৃত মাযহাবের ইমামের কোন কথাকে বাদ দেয় না অথবা এক জনের মতামতের কারণে অন্য জনের মতামতকে পরিত্যাগ করে না এবং হুবহু মানুষের কথার উপর ভরসা করে; কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর উপর নির্ভর করে না, সে নিশ্চিতভাবে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল উম্মতের ইজমার বিরোধিতা করল। আর এতে কোন সন্দেহ নেই। এর সমর্থনে সে তিন প্রশংসিত যুগের কোন সালফে সালেহীন ও কোন মানুষকে পাবে না। এ ক্ষেত্রে সে মু’মিনদের বিরোধী পন্থা অবলম্বন করল। তাছাড়া এ সমস্ত ফক্বীহদের প্রত্যেকেই অন্য মানুষের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন ইমামের তাক্বলীদ করবে সে যেন তার ইমামেরই বিরোধিতা করল।
মাসূমী বলেন:[3] আশ্চর্য লাগে যে, এ সমস্ত বিস্তৃত বিদ‘আতপন্থি মাযহাবের গোঁড়া অনুসারীদের জন্য যারা স্বীয় মাযহাবের দিকে সম্পৃক্ত ইমামের মতামতেরই অনুসরণ করে, অথচ তা দলীল থেকে অনেক দূরে। তাকে এমনভাবে বিশ্বাস করে যে, তিনি যেন একজন প্রেরিত নাবী! অথচ এটা সত্য ও বিশুদ্ধতার মাপকাঠি থেকে অনেক দূরে। আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে, এ সমস্ত অন্ধ অনুসারীগণ তাদের ইমামদের এমনভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা এ সব ভুলের ঊর্ধ্বে এবং তারা যা বলে তা অবশ্যই সঠিক। আর মনের মধ্যে এ বিষয়টি ভাবে যে, প্রকাশ্য দলীলের বিরোধী হলেও সে তাক্বলীদ (দলীল বিহীন অনুসরণ) পরিহার করবে না।
এরা এমন শ্রেণীর লোক যাদের ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী ও অন্যরা আদী বিন হাতেম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (হাতেম) বলেন, আমি নাবী (ﷺ) কে পাঠ করতে শুনেছি:
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ﴾
তারা আল্লাহ্কে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে (তাওবা-৩১)। ফলে আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! তারা তো তাদের ইবাদাত করে না। তখন আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) বললেন:
إِذَا أَحَلُّوا لَهُمْ شَيْئًا اسْتَحَلُّوهُ وَإِذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوهُ
তারা যখন তাদের জন্য কোন কিছু হালাল করে তখন তারা সেটাকে বৈধ মনে করে। আর তারা যখন তাদের জন্য কোন কিছু হারাম করে তখন তারা সেটাকে হারাম মনে করে। সুতরাং এটাই তাদের ইবাদাত করা হলো।[4]
ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত আছে যে,[5] ‘‘হাদীস বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোন হালাল কিংবা হারামের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করবে এবং তাক্বলীদ তাকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে বাধা দিবে সে যেন আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া তাক্বলীদকৃত ব্যক্তিকে প্রভু হিসেবে মেনে নিল। আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা সে তার জন্য হালাল করে নিল। আর আল্লাহ্ যা হালাল করেছেন তা হারাম করে নিল’’।
মারদাবী শাইখুল ইসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করে বলেন[6] ‘‘যে স্বীয় ইমামের প্রতি তাক্বলীদ করাকে আবশ্যক করে নিল, সে যেন এ থেকে তাওবা করে। নইলে তাকে হত্যা করা হবে। কেননা সে তাক্বলীদকে আবশ্যক করে নেয়ার মাধ্যমে শরীয়াতের একনিষ্ঠ রবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সাথে অন্যকে অংশীদার করলো।’’
কামাল বিন হুমাম হানাফী বর্ণনা করেন যে, বিশুদ্ধ অভিমত হলো, নির্দিষ্ট কোন মাযহাবকে আবশ্যক করে নেয়া অপরিহার্য নয়। কেননা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যা ওয়াজিব করেছেন তা ছাড়া আর কিছু ওয়াজিব নয়। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কারও প্রতি এটা ওয়াজিব করেন নি যে, ইমামদের মধ্যে কোন ব্যক্তির মাযহাবের অনুসরণ করতে হবে এবং দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করতে হবে ও অন্য কিছু বর্জন করতে হবে। অতীতের গৌরবময় শতাব্দীগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে সময় নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ করার আবশ্যকতা ছিল না।[7]
করাফী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ‘‘সাহাবাগণ এ কথার উপর ঐকমত্য হয়েছেন যে, যে ব্যক্তি শুধু আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) এর কাছে ফাৎওয়া চায় এবং শুধু তাদের দুজনের তাক্বলীদ করে তার উচিৎ, আবূ হুরাইরা (রাঃ), মুয়ায বিন জাবালসহ অন্যান্যদের থেকেও ফাৎওয়া গ্রহণ করা এবং তাদের সকলের কথাকে কোন দ্বিধা ছাড়াই মেনে নেয়া’’।[8]
‘‘সাহাবাদের যুগে একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না, যে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির সকল কথার উপর তাক্বলীদ করেছেন এবং তার একটি কথাকেও বাদ দেন নি। আবার এমন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না, যিনি কোন ব্যক্তির সকল কথাকে বাদ দিয়েছেন এবং তার কোন কিছুই গ্রহণ করেন নি’’।
জানা আবশ্যক যে, এরূপ গোঁড়ামী তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের যুগেও ছিল না। সুতরাং রাসূল (ﷺ) যে শতাব্দীকে মর্যাদাবান শতাব্দী হিসেবে গণ্য করেছেন সেই শতাব্দীতে তাদের এই অশুভ (তাক্বলীদী) পদ্ধতি চালু ছিল বলে মুকাল্লিদদের কেউ কোন একজন ব্যক্তির বরাত দিয়ে হলেও আমাদের এ কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক। মূলতঃ রাসূল (ﷺ) যে শতাব্দীকে নিন্দনীয় শতাব্দী হিসেবে অবহিত করেছেন, সেই ৪র্থ শতাব্দীতে এ বিদ‘আতের প্রচলন ঘটে।[9]
দারুল হিজরের ইমাম মালিকের উপর আল্লাহ্ রহম করুন! যার মহৎ জ্ঞান, মহিমা ও অনুগ্রহে ‘‘মুওয়াত্ত্বা’’ সংকলিত হয়েছে। খলীফা মানসূর যখন সকল মানুষকে শুধু ‘‘মুওয়াত্ত্বায় সংকলিত সমস্ত হাদীসের উপর আমল করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করলেন, তখন ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তা গ্রহণ করেন নি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছেন!!
[2] এটাকে তার (ইবনে হাযম) থেকে দেহলভী ‘হুজ্জাতুলস্নাহিল বালিগাহ’ (পৃ:১/১৫৪-১৫৫) তে নকল করেছেন। মুহালস্না অথবা আল-ইহকাম এর সম্ভাব্য স্থানে আমি এটা পাই নি।
[3] ‘হাদিইয়্যাতুস সুলতান’ (পৃ:৫২-৫৩)
[4] আলবানী হাসান বলেছেন: তিরমিযী ৩০৯৫, বায়হাক্বী (১০/১১৬) যঈফ সনদে, এর শাহিদ রয়েছে। তবে তা সাহাবী হুযাইফা পর্যমত্ম মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত। অপর একটি হাদীস রয়েছে সে টি মুরসাল, আলবানী তার ‘আল-মুসতালাহাতুল আরবাআহ’ গ্রন্থে (পৃ:১৮-২০) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[5] ‘হাদিইয়্যাতুস সুলতান’ (পৃ:৬৯)
[6] মারদাবী প্রণীত ‘আল-ইনসাফ’ (১১/১৭০)
[7] হাদিইয়্যাতুস সুলতান’ (পৃ:৫৬)
[8] ‘আযওয়াউল বায়ান’ (৭/৪৮৮)।
[9] ‘আযওয়াউল বায়ান’ (৭/৫০৯)।