লগইন করুন
একজন মুসলিমের উপর যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব, তার মধ্যে আখেরাত তথা শেষ দিবসের প্রতি এবং সেখানকার নেয়ামত ও আযাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। মানুষ পার্থিব জগত এবং তার ভোগ-বিলাসের মাঝে ডুবে থেকে কিয়ামত, পরকাল এবং তথাকার শাস্তি ও নেয়ামতের কথা ভুলে যেতে পারে। ফলে আখেরাতের মঙ্গলের জন্য আমল করাও ছেড়ে দিতে পারে। এ জন্য মহান আল্লাহ কিয়ামতের পূর্বে এমন কতগুলো আলামত নির্ধারণ করেছেন, যা আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অকাট্য প্রমাণ বহন করে এবং সকল প্রকার সন্দেহ দূর করে দেয়।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বাভাস স্বরূপ যে সমস্ত আলামতের কথা বলেছেন, একজন মুমিন ব্যক্তি যখন ঐ সমস্ত আলামতসমূহের কোন একটি আলামত দেখতে পাবে তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে, নিশ্চিতভাবে কিয়ামতের আগমণে বিশ্বাস স্থাপন করবে, ঈমান শক্তিশালী হবে, মন থেকে সমস্ত সন্দেহ দূর হবে, কিয়ামতের জন্যে প্রস্ত্ততি নিবে এবং সময় শেষ হওয়ার আগেই সৎকাজে আত্মনিয়োগ করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের যে সমস্ত আলামতের বর্ণনা দিয়েছেন তার অনেক আলামত হুবহু প্রকাশিত হয়েছে। এ সমস্ত আলামত দেখে মুমিনদের ঈমান প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নবুওয়াতের প্রমাণগুলো দেখে ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন তা হবেনা? আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত গায়েবী বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন, তা আজ হুবহু বাস্তবায়িত হতে দেখছে। আফসোস ঐ ব্যক্তির জন্য! দিবালোকের মত সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো দেখেও যে কিয়ামত দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল অথবা তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করল।
কিয়ামত একটি বিরাট গায়েবী ঘটনা। তা অস্বীকারকারী কিংবা তাতে সন্দেহ পেষাণকারীর সন্দেহ দূর করার জন্য এসব আলামত বর্ণনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলামতগুলো দেখে কিয়ামতে বিশ্বাস করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে। সন্দেহকারী যখন তার চোখের সামনে আলামতগুলো দেখতে পাবে তখন তার কাছে এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে যে, যিনি কিয়ামত হবে বলে সংবাদ দিয়েছেন, তিনিই তো কিয়ামতের আলামত আসার কথা বলেছেন। কুরআন ও হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক আলামতগুলো যখন এসে যাবে তখন এ বিষয়ের সংবাদদাতাকে মিথ্যুক বলার কোন সুযোগ অবশিষ্ট থাকবেনা। কারণ সংবাদের বিষয়বস্ত্ত বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সংবাদদাতার অধিকাংশ সংবাদ সত্যে পরিণত হওয়ার অর্থ এই যে, তার বাকী সংবাদগুলোও সত্য হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে যে সমস্ত আলামত আসবে বলে ঘোষণা করেছেন বড় আলামতগুলো ব্যতীত অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। যেগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি অদূর ভবিষ্যতে তা অবশ্যই বাস্তবে পরিণত হবে এবং সকল আলামত প্রকাশ হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে মহাপ্রলয় তথা রোজ কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে।
হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক ভবিষ্যৎ বাণীগুলো সত্যে পরিণত হলে ঈমান দৃঢ়, মজবুত ও শক্তিশালী হবে। এই তো মুসলমানেরা প্রতি যুগেই বিভিন্ন ঘটনা হুবহু বাস্তবায়িত হতে দেখে আসছে। কুরআন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল যে, অচিরেই রোমানরা পারস্যবাসীদের উপর বিজয় লাভ করবে। অতঃপর পুনরায় তারা পরাজিত হবে। সাহাবীগণ পারস্যবাসীদের উপর রোমানদের বিজয় প্রত্যক্ষ্য করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ওফাতের পর মুসলমানগণ রোম ও পারস্য জয় করেছেন। সকল দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় অবলোকন করেছেন। এমনিভাবে আরো অনেক ঘটনা সত্যে পরিণত হচ্ছে এবং মুমিনদের ঈমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া আগামীতে যে সমস্ত ফিতনার আগমণ ঘটবে তাতে একজন মুসলমান কিভাবে চলবে, কিভাবে তা থেকে পরিত্রাণ পাবে, অনাগত পরিস্থিতিতে শরীয়তের বিধান কি হবে, তা জানার জন্যে এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্যে কিয়ামতের আলামতগুলো সম্পর্কে প্রতিটি মুসলিমের জ্ঞান থাকা জরুরী।
কিয়ামতের অন্যতম বড় আলামত হচ্ছে দাজ্জালের আগমণ। সে পৃথিবীতে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মত লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে একমাসের মত। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মত। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে। সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাযই যথেষ্ট হবে? উত্তরে তিনি বললেনঃ ‘‘না; বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে নামায পড়বে’’।[1] এমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় কিয়ামতের পূর্বে মুসলিমগণ পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে’’। তিনি এ সমস্ত যুদ্ধে শরীক হতে নিষেধ করেছেন এবং ফিতনা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।
মোটকথা, ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় কিয়ামতের আলামতগুলো সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা রাখা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। এই বইটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে তা সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
কিয়ামত কখন হবে?
কিয়ামত কখন হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। এ বিষয়টি ইলমুল গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়ের অন্তর্গত। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে অসংখ্য দলীল রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশী বেশী আলোচনা করতেন। তাই লোকেরা তাঁকে কিয়ামতের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করতো। তিনি তাদেরকে সংবাদ দিতেন যে, কিয়ামতের বিষয়টি একটি গায়েবী বিষয়। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কেউ কিয়ামতের নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে অবগত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
)يَسْأَلُونَكَ عَنْ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ(
‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে যে, কিয়ামত কখন প্রতিষ্ঠিত হবে? আপনি বলে দিন যে, এই বিষয়ে আমার প্রতিপালকই জ্ঞানের অধিকারী। শুধু তিনিই কিয়ামতকে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করবেন। আকাশ রাজ্যে ও পৃথিবীতে তা হবে একটি ভয়াবহ ঘটনা। তোমাদের উপর তা হঠাৎ করেই চলে আসবে। এমনভাবে ওরা আপনাকে প্রশ্ন করছে আপনি যেন এ বিষয়ে সবিশেষ অবগত। অর্থাৎ তারা এটা মনে করে আপনাকে প্রশ্ন করছে যে, আপনি কিয়ামতের সময় সম্পর্কে পূর্ণ অবগত আছেন। অথচ এ বিষয়ে আপনার কোন জ্ঞান নেই আপনি বলে দিন যে, এ সম্পর্কে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এ সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখেনা।’’ (সূরা আরাফঃ ১৮৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
)يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنْ السَّاعَةِ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُونُ قَرِيبًا(
‘‘লোকেরা আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলুনঃ এর জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই। আপনি এটা কি করে জানবেন যে, সম্ভবত কিয়ামত শীঘ্রই হয়ে যেতে পারে!’’। (সূরা আহযাবঃ ৬৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
)يَسْأَلُونَكَ عَنْ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا فِيمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا إِلَى رَبِّكَ مُنتَهَاهَا(
‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে কিয়ামত সম্পর্কে যে, ওটা কখন ঘটবে? এর আলোচনার সাথে আপনার সম্পর্ক কি? (সূরা নাযিআতঃ ৪২-৪৪) এর চরম জ্ঞান আছে আপনার প্রতিপালকের নিকটেই’’। আল্লাহ তাআলা আরো আরো বলেনঃ إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ‘‘কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর নিকট রয়েছে’’। (সূরা লুকমানঃ ৩৪)
উপরোক্ত আয়াতগুলো এবং অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ দিচ্ছেন তিনি যেন কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারীদেরকে বলে দেন, কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই। তিনিই তার সঠিক সময় সম্পর্কে অবগত আছেন। আসমান-যমীনের কারো কাছে কিয়ামতের কোন জ্ঞান নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিবরাঈল (আঃ) যখন প্রশ্ন করলেনঃ কিয়ামত কখন হবে? তিনি উত্তর দিলেনঃ
مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ
‘‘এ ব্যাপারে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে প্রশ্নকারী অপেক্ষা অধিক অবগত নন’’।[2] সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের সময় সম্পর্কে জানতেন না, জিবরীল (আঃ)ও নয়, এমন কি যেই ফেরেশতা শিঙ্গা মুখে নিয়ে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় আছেন, তিনিও কিয়ামতের সময় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।