লগইন করুন
প্রশ্ন: ফ্রিল্যান্সিং কাজ করার জন্য রাত জাগতে হয়। এতে কি গুনাহ হবে? আর রাতজাগার ক্ষতিকর দিক সমূহ এবং এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যরক্ষায় করণীয় কী?
আল্লাহ তাআলা রাতকে আমাদের জন্য বিশ্রাম গ্রহণ এবং দিনকে জীবিকা উপার্জনের সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا- وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
"তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী, রাত্রিকে করেছি আবরণ এবং দিনকে করেছি জীবিকা উপার্জনের সময়।" [সূরা নাবা: ৯, ১০ ও ১১]
তিনি আরও বলেন,
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُورًا
"আর তিনিই তো তোমাদের জন্যে রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে বিশ্রাম এবং দিনকে করেছেন বাইরে গমনের জন্যে।" [সূরা ফুরকান: ৪৭]
তিনি আরও বলেন,
وهُوَ الذي جعلَ لَكمُ الليلَ لِتَسكنوا فيهِ والنهارَ مُبصرا إِنَّ في ذلكَ لآَياتٍ لقوم يَسمعون
“তিনি তোমাদের জন্য তৈরি করেছেন রাত, যাতে করে তোমরা তাতে প্রশান্তি লাভ করতে পার, আর দিন দিয়েছেন দর্শন করার জন্য। নিঃসন্দেহে এতে নিদর্শন রয়েছে সে সব লোকের জন্য যারা শ্রবণ করে।” [সূরা ইউনুস: ৬৭]
তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একান্ত জরুরি কাজ ছাড়া ইশার সালাতের পূর্বে ঘুম এবং ইশার সালাতের পরে কথাবার্তা বলা অপছন্দ করতেন এবং তিনি আগেভাগে ঘুম এবং আগেভাগে ঘুম থেকে জাগার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাই আমাদের কতর্ব্য, যথাসম্ভব দিনের বেলায় কাজ করা এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানো এবং শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া। কিন্তু বর্তমান যুগে অনেক মানুষকে নানা কারণে রাত জেগে কাজ করতে হয়। যদি চাকরি বা পেশাগত প্রয়োজনে রাতে জেগে কাজ করা আবশ্য হয় তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে তা নাজায়েজ নয়। তবে এ জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। সেগুলো লক্ষ্য রেখে রাত জেগে কাজ করা জায়েজ রয়েছে। যেমন:
১. কাজটা জীবিকা উপার্জন বা মানব কল্যাণের বৃহত্তর স্বার্থে জরুরি হওয়া আবশ্যক। অপ্রয়োজনীয় কাজে রাতজাগা বৈধ নয়।
২. কাজটা হালাল হওয়া। সুতরাং ফ্রিল্যান্সিং বা অন্য যে কাজ করবেন তা অবশ্যই হালাল হতে হবে। হারাম কাজের জন্য রাতজাগা হারাম।
৩. রাতজাগার কারণে মাগরিব, ইশা ও ফরজের সালাত আর দিনের বেলায় ঘুমের কারণে জোহর/জুমা, আসর সালাত ইত্যাদি কাজা না করা।
৪. রাতজাগার ফলে যথাসময়ে মসজিদে জামাতে সালাত মিস না করা। (পুরুষদের জন্য)।
৫. রাত জেগে কাজ করার প্রয়োজন থাকলে দিনে পর্যাপ্ত ঘুমের মধ্যমে শরীরের চাহিদা পূরণ করা জরুরি। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম গ্রহণ মানুষের উপর তার নফসের হক। তাছাড়া শারীরিক ও মানসিক সুস্থ থাকার জন্যও পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি।
৬. রাতজাগার কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়-ক্ষতির আশংকা থাকলে অনতিবিলম্বে রাতজাগা পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময় রাতজাগা মানুষের দেহে নানা রোগ-ব্যাধির সৃষ্টির কারণ হয়। সুতরাং এ বিষয়ে সচেতনতা কাম্য।
শাইখ আলবানি রাহ. কে রাতে কাজ করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন,
إذا كنت لا تضيع أي صلاة عن وقتها المشروع أولا ثم لا تضيع حضور الصلاة في مساجد المسلمين ثانيًا ثم لا تستطيع أن تجد عملًا في النهار ثالثًا بهذه الشروط يجوز فإذا اختل شرط من هذه الشروط لا يجوز
“তুমি যদি প্রথমত: নির্ধারিত সময়ে কোন সালাত মিস না করো, দ্বিতীয়ত: তুমি যদি মসজিদে নামাজ পড়া মিস করো, তারপর তৃতীয়ত: তুমি দিনে করার মত কোনও কাজ খুঁজে পান না, তাহলে এসব শর্ত সাপেক্ষে রাত জেগে কাজ করা জায়েজ। কিন্তু যদি এই শর্তগুলোর কোনও একটি লঙ্ঘিত হয় তাহলে তা জায়েজ নয়।” [al-fatawa]
রাতে কাজ করা এবং দিনের অধিকাংশ সময় ঘুমানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে islamweb-এর উত্তরে বলা হয়েছে,
فإذا كان نومك لا يترتب عليه تضييع الصلوات المفروضة وإخراجها عن وقتها بحيث تستيقظ وتصلي الصلاة لوقتها، ثم تعود للنوم فإنه لا حرج عليك، وإن كنت تضيع الصلوات فتخلط الظهر مع العصر مثلا أو تصلي الفجر بعد وقتها فهذا لا يجوز، وتلزمك التوبة إلى الله تعالى
“আপনার ঘুমের কারণে যদি ফরজ সালাত ছুটে না যায় বা সময় অতিবাহিত করে না পড়া হয় অর্থাৎ আপনি ঘুম থেকে জাগবেন এবং যথাসময়ে সালাত পড়ে পুনরায় ঘুমাবেন তাহলে এতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সালাত ছুটে যায়-যেমন: জোহরকে আসরের সাথে যুক্ত করে দেন বা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফজর সালাত পড়েন তাহলে তা জায়েজ নয়। আপনার জন্য তওবা করা আবশ্যক।” [ফতোয়া নং-১১২৭৮৫]
❑ রাতজাগার ৮ মারাত্মক ক্ষতি:
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, টানা কয়েকদিন রাত জাগলে শরীর ভিতর থেকে ভাঙতে শুরু করে। ফলে এমন সব রোগ ঘাড়ে চেপে বসে যে আয়ু কমে চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয়, মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া, সঙ্গে রাতজাগা লেজুড় হলে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ভয়ও থাকে। তাই শরীরের এসব মারাত্মক ক্ষতি বাঁচতে রাত জাগবেন না।
❑ রাতজাগার ফলে শরীরের যে ৮টি মারাত্মক ক্ষতি হয়:
১.উচ্চ রক্তচাপ: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে টানা ২-৩ দিন ঠিক করে না ঘুমলে শরীরের অন্দরে এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে যে তার প্রভাবে রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে। আর এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত যদি ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা না যায়, তাহলে শরীরের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
২.ওজন বাড়ে: ২০১৪ সালে হওয়া একটি স্টাডিতে দেখা গেছে টানা কয়েকদিন ৬ ঘণ্টার থেকে কম সময় ঘুমালে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কারণ ঘুম কম হলে স্বাভাবিকভাবেই খিদে বাড়তে থাকে। আর বেশি মাত্রায় খেলে যে স্বাভাবিকভাবেই ভাবে ওজন বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! আর ওজন যখন মাত্রা ছাড়ায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই একে একে শরীরে এসে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস, কোলেস্ট্ররল, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের মতো নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ। তাই তো বলি বন্ধু, ওবেসিটির মতো মরণ পরিস্থিতির খপ্পরে পড়তে যদি না চান, তাহলে রাতজাগার প্ল্যান বাদ দিতে হবে।
৩. ব্রেনের পাওয়ার কমে: আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক নিজেকে রিজুভিনেট করতে থাকে। সেই সঙ্গে সারা দিন ধরে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং তথ্য ব্রেনে স্টোর করার কাজটাও এই সময় ঘটে থাকে। তাই তো ঠিক মতো ঘুম না হলে প্রথমেই স্মৃতিশক্তির উপর প্রভাব পরে। সেই সঙ্গে কগনিটিভ ফাংশন কমে যাওয়ার কারণে মনোযোগ এবং বুদ্ধি কমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলিও ঘটে থাকে।
প্রসঙ্গত: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের কোনও কিছু শেখার ক্ষমতার সঙ্গে ঘুমের সরাসরি যোগ রয়েছে। তাই তো ঠিক মতো ঘুম না হলে এই ক্ষমতাও কমে যেতে শুরু করে। তাই সাবধান!
৪. আয়ু কমে: প্রায় দশ হাজার ব্রিটিশ ছাত্রের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যারা ৫ ঘণ্টা বা তার কম সময় ঘুমায়, তাদের হঠাৎ করে মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষদের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ঘুমের সঙ্গে হার্ট এবং ব্রেনের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। তাই তো ঘুম ঠিক মতো না হলে শরীরেই সব থেকে দুটি ভাইটাল অঙ্গ দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে। আর এমনটা হতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই আয়ু চোখে পরার মতো কমে যায়।
৫. মানসিক অবসাদ: ২০০৫ সালে হওয়ার বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছিল দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তকের অন্দরে ফিল গুড হরমোনের ক্ষরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটির মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তাই হাজারো চাপের মাঝেও মনকে যদি চাঙ্গা রাখতে চান, তাহলে ভুলেও ঘুমের সঙ্গে আপোস করবেন না যেন!
৬. সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে: একাধিক কেস স্টাডিতে দেখা গেছে মাসের পর মাস ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশ এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরে যে ঠিক মতো কাজ করে উঠতে পারে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। সেই সঙ্গে কেরিয়ারে দ্রুত উন্নতি করার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।
৭. ত্বকের সৌন্দর্য কমে: দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হলে কর্টিজল নামক স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যেতে শুরু করে। ফলে একদিকে যেমন মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যা, সেই সঙ্গে ত্বকের অন্দরে কোলাজেনের মাত্রা কমতে শুরু করার কারণে সৌন্দর্যও হ্রাস পায়।
৮. হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়: একাধিক গবেষণার পর এই বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই যে ঘুমের সঙ্গে হার্টের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। সেই কারণেই তো চিকিৎসকেরা দৈনিক কম করে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আসলে এমনটা না করলে ধীরে ধীরে হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে হার্ট ফেলিওর, ইরেগুলার হার্ট বিট সহ আরও নানাবিধ হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। [উৎস: ekushey-tv]
❑ রাত জেগে কাজ করছেন, সুস্থ থাকতে খান ৫ খাবার:
রাত জেগে কাজ করে থাকেন অনেকেই। কেউ অভ্যাসবশত আবার কেউ জীবনের তাগিদেই এমনটি করেন। দীর্ঘদিন রাত জেগে কাজ করলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শরীরে।
টানা রাত জাগলে শরীরে ঘুমের ঘাটতি তৈরি হয়। দিনের বেলায় পর্যাপ্ত ঘুমালেও এই ঘাটতি পূরণ হয় না। আর রাত জাগার সবচেয়ে বাজে প্রভাব হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, রক্তচাপে স্বাভাবিক না থাকা এবং কাজে মনোযোগ না থাকা। এ ছাড়া শরীর দুর্বল লাগে ও কর্মোদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যায়। যারা রাত জাগেন, তাদের খাবারের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। তেল-মসলা, কফিজাতীয় খাবার খাবেন না। এমন কিছু খাবার খাওয়া উচিত, যা শরীর ভালো রাখবে (ইনশাআল্লাহ)।
আসুন জেনে নিই কী খাবেন-
১. রাত জাগলে খেতে পারেন খেজুর ও খেজুরের গুড়। এ ছাড়া গুড় দিয়ে রুটি খেতে পারে। খেজুরে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ থাকে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি খেজুর বা খেজুরের গুড় খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
২. রাত জেগে খিদে পেলে কাজুবাদাম কিংবা পেস্তাবাদাম খেতে পারেন। এতে পেট ভরবে আর শরীরও ভালো থাকবে। সেই সঙ্গে ঘুমও ভালো হয়।
৩. ঘি শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে। রাতে রুটি বা ভাতে এক চামচ ঘি খেতে পারেন। তবে কোলেস্টেরল থাকলে ঘি এড়িয়ে চলুন।
৪. রাতে কাজ করার সময় খেতে পারেন ফল বা ফলের রস। সফেদা, শাঁকআলু, আপেল, পেয়ারা, পেঁপে এসব ফল খেতে পারেন। খেতে পারেন দেশি ফলও।
৫. রাত জাগলে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। রাতে কাজ করলে এক ঘণ্টা পর পর এক গ্লাস পানি পান করুন। এতে ক্লান্তি দূর হবে। [jugantor]