তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য তাক্বদীর বিষয়ে বিস্তারিত আব্দুল আলীম ইবনে কাওসার
তাক্বদীরের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত ফের্কাসমূহ

তাক্বদীরকে কেন্দ্র করে অনেকগুলি দল বিভ্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে ক্বাদারিইয়াহ, জাবরিইয়াহ, ইবলীসিইয়াহ, ছূফীদের চরমপন্থী গ্রুপ, আশা‘য়েরাহ, রাফেযাহ উল্লেখযোগ্য। আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে প্রসিদ্ধতম দু’টি ফের্কা ক্বাদারিইয়াহ এবং জাবরিইয়াহ্‌দের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

১. ক্বাদারিইয়াহঃ এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের পুরোধা মা‘বাদ জুহানী, গায়লান দিমাশক্বী, ওয়াছেল ইবনে আত্বা প্রমুখের অনুসারী।‌ তাদের মতে, তাক্বদীর বলতে কিছু নেই, সবকিছু এমনি এমনি হয়। তারা বলে, আল্লাহ কর্তৃক বান্দার কর্ম সৃষ্ট নয়; বরং বান্দা নিজেই নিজের কর্ম সৃষ্টি করে। বান্দার স্বতন্ত্র  ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি রয়েছে, এতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং ক্ষমতার কোন প্রভাব পড়ে না। যে ব্যক্তি হেদায়াতপ্রাপ্ত হতে চায়, সে নিজেই নিজেকে পথ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হতে চায়, সে নিজেই নিজেকে পথভ্রষ্ট করে। ভাল-মন্দ সব ধরনের ইচ্ছার মূল নায়ক সে নিজে, এতে আল্লাহ্‌র কোন হাত নেই।

ক্বাদারিইয়াহদের চরমপন্থী গ্রুপের বিশ্বাস মতে, মানুষ কর্তৃক কোন কর্ম সম্পাদিত হওয়ার আগে আল্লাহ সে সম্পর্কে যেমন কোন জ্ঞান রাখেন না; তেমনি বান্দার কর্মও তিনি সৃষ্টি করেন না। তাক্বদীর অস্বীকারের এই মতবাদটিকে চরমপন্থী মতবাদ বলা হয় এবং এই মতের ধ্বজাধারীদেরকে চরমপন্থী তাক্বদীর অস্বীকারকারী (غلاة نفاة القدرية) বলা হয়।[1]

‘বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌র সৃষ্ট নয়’ এমন আক্বীদা পোষণের মাধ্যমে তারা একাধিক সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য সাব্যস্ত করেছে। কারণ বান্দা নিজেই যদি তার কর্ম সৃষ্টি করে, তাহলে আল্লাহ্‌র সাথে সেও দ্বিতীয় স্রষ্টা হিসাবে পরিগণিত হবে। আর একারণেই তাদেরকে মাজূসী বা অগ্নিপূজকদের সাথে তুলনা করা হয়। কারণ মাজূসীরা বলে, পৃথিবীর ইলাহ দু’জন: একজন নূর বা আলোর ইলাহ এবং অপরজন অন্ধকারের ইলাহ; প্রথম জন যাবতীয় কল্যাণের স্রষ্টা এবং দ্বিতীয় জন্য যাবতীয় অকল্যাণের স্রষ্টা।[2]


২. জাবরিইয়াহঃ এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সাংঘর্ষিক মতবাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে, মানুষ ইচ্ছা এবং কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত একটি জীব। সে তার কাজ-কর্মে জড়পদার্থ সদৃশ। সে বায়ূপ্রবাহে ভাসমান পালকের ন্যায়। গাছ-গাছালির নড়াচড়া, পানির স্রোতধারা, নক্ষত্ররাজির আবর্তন এবং সূর্যের অস্তগমণকে যেমনিভাবে রূপক অর্থে সেগুলির দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, ঠিক একইভাবে বান্দার কাজ-কর্মকেও রূপক অর্থে তার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়; প্রকৃত অর্থে নয়। যেমনঃ রূপক অর্থে বলা হয়, সূর্যোদয় হয়েছে, বাতাস প্রবাহিত হয়েছে, বৃষ্টি হয়েছে; বান্দার ক্ষেত্রেও ঠিক ঐ একই অর্থে বলা হয়, সে ছালাত আদায় করেছে, ছওম পালন করেছে, হত্যা করেছে, চুরি করেছে ইত্যাদি।

জাবরিইয়াহরা তাক্বদীর সাব্যস্ত করতে গিয়ে চরম ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছে। তারা আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে যুলমের অপবাদ দিয়েছে। এরা ক্বাদারিইয়াদের চেয়ে বেশী নিকৃষ্ট এবং ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। কারণ তাদের এই মতবাদ আল্লাহ্‌র আদেশ-নিষেধ তথা ইসলামী শরী‘আতকে অকার্যকর গণ্য করে। অনুরূপভাবে শরী‘আতের বিধিবিধান ও আদেশ-নিষেধের মাধ্যমে মহান আল্লাহ যে বান্দার প্রতি অতিশয় দয়া এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, সেটিকেও এই মতবাদ অস্বীকার করে।[3]

[1]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৬৫-১৬৬; আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/২২-২৩ এবং আক্বীদার অন্যান্য বই।

[2]. ড. সা‘ঊদ ইবনে আব্দুল আযীয খালাফ, ‘আল-ইনতেছার ফির-রদ্দি আলাল-মু‘তাযিলাতিল ক্বাদারিইয়াতিল আশরার’ নামক গ্রন্থের ভূমিকা, (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা, তৃতীয় প্রকাশ: ২০০৮ইং), ১/৫৯।

[3]. প্রাগুক্ত।