লগইন করুন
(১) নতুন নিয়মের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে যীশু খ্রিষ্টের বংশ তালিকায় মূলত পুরুষদেরই নাম লেখা। সামান্য কয়েকজন সৌভাগ্যবান নারীর নাম এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। নতুন নিয়মের মধ্যে প্রথম যে মহিয়সী সৌভাগ্যবান নারীর নামটা স্থান পেয়েছে তিনি ‘তামর’: ‘‘এহুদার ছেলে পেরস ও সেরহ- তাদের মা ছিলেন তামর।’’ (মথি ১/৩)। এ নারীর বিষয়ে দুটো বিষয় লক্ষণীয়: (১) তিনি বনি-ইসরাইল বংশের ছিলেন না এবং (২) তিনি তাঁর শশুর এহুদার সাথে ব্যভিচারের মাধ্যমে পেরস ও সেরহ নামক দুটো ছেলে লাভ করেন । আর এ ব্যভিচারী মহিলা তামর ও ব্যভিচারী পুরুষ এহুদা এবং ব্যভিচার-জাত যারজ সন্তান পেরস যীশু খ্রিষ্টের পূর্বপুরুষ। (পয়দায়েশ/ আদিপুস্তক ৩৮ অধ্যায়)। যিহূদা/ এহুদা নিজে বেশ্যাগমন করেছেন এবং নিজের পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করেছেন। তিনি কখনো এ পাপ থেকে তাওবা করেননি এবং এ পাপের ঐশ্বরিক শাস্তি ভোগ করেননি। তামর বেশ্যা সেজে শ্বশুরের সাথে ব্যভিচার করেছেন। তিনি কখনো এ পাপ থেকে তাওবা করেননি এবং এ পাপের জন্য নির্ধারিত ঐশ্বরিক শাস্তি গ্রহণ করেননি।
(২) নতুন নিয়মের প্রথম অধ্যায়ে দ্বিতীয় যে মহিয়সী নারীর নাম আমরা দেখতে পাই তিনি ‘রাহব’: ‘‘সলমোনের ছেলে বোয়াস, তাঁর মা ছিলেন রাহব’’ (মথি ১/৫)। রাহব ভিন্ন গোষ্ঠীর নারী ও প্রতিমাপূজারী ছিলেন এবং তিনি ছিলেন একজন পেশাদার পতিতা, বেশ্যা বা যৌনকর্মী (harlot, prostitute, hooker)। যিহোশূয় বা ইউশার নেতৃত্বে বনি-ইসরাইল ফিলিস্তিনের জেরিকো শহরটাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন এবং তথাকার সকল মানুষ ও জীব-জানোয়ার হত্যা করেন। যিহোশূয় জেরিকো শহর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াব জন্য দুজন গুপ্তচর প্রেরণ করেন। যেহেতু একজন বেশ্যার বাড়িতে যে কোনো পুরুষের প্রবেশের অধিকার থাকে, সেহেতেু জেরিকো পৌঁছে তাঁরা খরিদ্দার হিসেবে বেশ্যা রাহবের বাড়িতে প্রবেশ করেন। বেশ্যা রাহব নিজ দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বনি-ইসরাইলকে তাদের দেশে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সাহায্য করেন। এ বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবে বনি-ইসরাইলরা রাহব ও তাঁর পিতামাতার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখে। (ইউশা/ যিহোশূয় ২য় ও ৬ষ্ঠ অধ্যায়)
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তথ্য অনুসারে দুজন গুপ্তচরের একজন ছিলেন শলমোন (Salmon), যিনি খরিদ্দার হিসেবে রাহবের নিকট গমন করেছিলেন। পরবর্তীতে শলমোনের ঔরসেই দাউদের দাদা বোয়াসের জন্ম হয় বলে মথি নিশ্চিত করেছেন। পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম উভয় নিয়মেই বার বার রাহবকে দেহব্যবসায়িনী, পতিতা বা বেশ্যা (harlot/prostitute) বলে নিশ্চিত করা হয়েছে (যিহোশূয়/ ইউশা ২/১; ৬/১৭; ৬/২২; ৬/২৫; ইব্রীয় ১১/৩১; যাকোব ২/২৫)। হিব্রুতে তার উপাধি (zoonah) জুনাহ বা জিনাকারিণী। গ্রিক বাইবেলে তার উপাধি (porne) ‘পর্ন’, অর্থাৎ অশ্লীল। এ শব্দ থেকেই ইংরেজি পর্নোগ্রাফি (pornography) শব্দটা গৃহীত। বিস্তারিত জানতে উইকিপিডিয়ায় ‘রাহব’ (Rahab) প্রবন্ধটি পড়ুন।[1] এছাড়া বাইবেল গেটওয়ে ওয়েবসাইটে ‘All the Women of the Bible – Rahab’ প্রবন্ধ পড়ুন।[2]
বেশ্যা রাহব কখনো নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন অথবা পাপ থেকে তাওবা করেছেন বলে বাইবেলে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বাইবেলে কোথাও বলা হয়েছে যে, তিনি বিশ্বাসের কারণে এবং কোথাও বলা হয়েছে যে, তিনি কর্মের কারণে জোরিকোবাসীর সাথে নিহত হননি। সাধু পল বলেন: ‘‘By faith the harlot Rahab perished not with them that believed not, when she had received the spies with peace: বিশ্বাসের কারণেই বেশ্যা রাহব অবিশ্বাসীদের সাথে ধ্বংস হলেন না; যখন তিনি শান্তির সাথে গুপ্তচরদের অভ্যর্থনা করলেন।’’ কি. মো.-০৬: ‘‘ঈমানের জন্যই রাহব বেশ্যা জেরিকো শহরে বসবাসকারী অবাধ্য লোকদের সংগে ধ্বংস হননি, কারণ তিনি সেই গোয়েন্দাদের বন্ধুর মত গ্রহণ করেছিলেন।’’ (ইব্রীয়/ ইবরানী ১১/৩১)
পক্ষান্তরে যাকোব দাবি করেছেন যে, রাহব বিশ্বাসে বাঁচেন নি; বরং কর্মে বেঁচেছেন: ‘‘Likewise also was not Rahab the harlot justified by works, when she had received the messengers, and had sent them out another way?: বেশ্যা রাহবও কি একইভাবে কর্ম দ্বারা ধার্মিক বলে গণ্য হননি, যখন তিনি দূতদের অভ্যর্থনা করলেন এবং অন্য পথে বের করে দিলেন?’’ কেরি? ‘‘রাহব বেশ্যাও কি সেই প্রকারে কর্ম হেতু ধার্মিক গণিতা হইল না? সে ত দূতগণকে অতিথি করিয়াছিল এবং অন্য পথ দিয়া বাহিরে পাঠাইয়া দিয়াছিল।’’ (যাকোব ২/২৫)
উভয় বক্তব্যেই আমরা দেখছি যে, রাহবের বিশ্বাস ও কর্ম একটাই ছিল: ইউসার গোয়েন্দা বা গুপ্তচরদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ ও তাঁদের পলায়নের ব্যবস্থা করা। আর রাহবের বিশ্বাসের বিবরণ নিম্নরূপ: জেরিকো শহর সম্পর্কে খোঁজ নিতে ইউসা দুজন গোয়েন্দা প্রেরণ করেন। তারা রাহব বেশ্যার খরিদ্দার হয়। বেশ্যা তাদেরকে জানায় যে, বনি-ইসরাইলরা যেভাবে বিভিন্ন দেশ ধ্বংস করেছে তা জেনে জেরিকোবাসীরা অত্যন্ত আতঙ্কিত। তাদের সাহস হারিয়ে গেছে। যদি গোয়েন্দারা রাহব ও তার পরিবারের নিরাপত্তা দেন তবে তিনি তাদেরকে সহযোগিতা করবেন (ইউসা ২/১-১৪)। ‘‘এই সব শুনে আমাদের দিলের সব আশা-ভরসা ফুরিয়ে গেছে এবং আপনাদের ভয়ে সবাই সাহস হারিয়ে ফেলেছে। আপনাদের মাবুদ আল্লাহই বেহেশতের এবং দুনিয়ার আল্লাহ।’’ (ইউসা ২/১১)
এ-ই তাঁর বিশ্বাস। তিনি বনি-ইসরাইলদের বিজয় থেকে অনুভব করেছেন যে, বনি-ইসরাইলের ঈশ্বর আসমান-যমিনের ঈশ্বর। এরূপ বিশ্বাসের সাথেই বনি-ইসরাইলরা মূর্তিপূজা এবং সকল পাপাচারে লিপ্ত হতেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, বনি-ইসরাইলদের ভয়ে নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং নির্মমতম গণহত্যায় সহযোগিতা করাই বেশ্যা রাহবের একমাত্র পুণ্যকর্ম। রাহব বেশ্যাবৃত্তি, মুর্তিপূজা বা নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করেছেন বলে বাইবেলে বলা হয়নি। রাহবের এ পুণ্যকর্মের অনেক পরেও নবী ইউসা তাকে বেশ্যা হিসেবে উল্লেখ করেই বলেছেন: ‘‘কেবল বেশ্যা রাহব ও তার ঘরে যে সব লোক রয়েছে তারা বেঁচে থাকবে, কারণ আমাদের পাঠানো লোকদের সে লুকিয়ে রেখেছিল।’’ (ইউসা ৬/১৭)।
তাহলে মূর্তিপূজারী ও বেশ্যা হওয়া সত্ত্বেও শুধু বনি-ইসরাইলের চর দুজনকে লুকিয়ে রাখার পুণ্যকর্মের জন্যই সে বেঁচে গেল। শুধু বাঁচলই না; ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহদের দাদী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করল। আমরা দেখেছি দাউদ, শলোমন ও যীশু তিনজনকেই বাইবেলে বার বার ‘ইবনুল্লাহ’ বা ঈশ্বরের পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দাউদ ও যীশুকে ‘মসীহ’ বলা হয়েছে এবং বিশেষ করে দাউদকে প্রথম পুত্র বা ‘ইবনুল্লাহ আওয়াল’ এবং ঈশ্বরের জাত বা একজাত পুত্র বলা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে যীশুই স্বয়ং ঈশ্বর। আর এ সকল ইবনুল্লাহ, মাসীহ, প্রথমপুত্র, জাত পুত্র এবং স্বয়ং ঈশ্বর সকলেরই দাদী বেশ্যা রাহব।
(৩) নতুন নিয়মের মধ্যে স্থান পাওয়া তৃতীয় সৌভাগ্যবান মহিলা ‘রূত’: ‘‘বোয়াসের ছেলে ওবেদ, তার মা ছিলেন রূত; ওবেদের ছেলে ইয়াসি, ইয়াসিরের ছেলে বাদশাহ দাউদ।’’ (মথি ১/৫-৬) এ মহিয়সী নারীর বিষয়ে দুটো বিষয় লক্ষণীয়: (ক) তিনি ভিন্ন বংশের নারী ছিলেন এবং (খ) তিনি জারজ বংশের নারী ছিলেন।
ইতোপূর্বে আমরা লোটের সাথে তার দুই মেয়ের ঘৃণ্য ব্যভিচারের কথা জেনেছি। এ ঘৃণ্য ও অবৈধ সম্পর্কের ফসল যে জারজ সন্তান, তাঁরই বংশধর ছিলেন রূত। লোটের সাথে ব্যভিচারের ফলে বড় মেয়ে যে পুত্র সন্তান লাভ করলেন তার নাম রাখা হয় ‘মোয়াব’, যার অর্থ পিতার কাছ থেকে। অর্থাৎ যে পুত্রের পিতা ও নানা একই ব্যক্তি। (আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ১৯/৩৭) এ মোয়াবের বংশেরই একজন নারী ‘রূত’। বাদশাহ দাউদের দাদা ওবেদের মা ছিলেন তিনি। বিস্তারিত জানতে পুরাতন নিয়মের অষ্টম পুস্তক ‘রূত’ পড়ুন। বিশেষত ৪র্থ অধ্যায় পড়ুন। আর এভাবে ভিন্ন বংশের এবং অবৈধ সম্পর্কজাত বংশের মেয়ে হয়েও তিনি ‘ইবনুল্লাহ’দের বা ঈশ্বরের পুত্রদের ও ঈশ্বরের দাদী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলেন।
(৪) ইঞ্জিল শরীফের প্রথম অধ্যায়ে স্থান পাওয়া চতুর্থ সৌভাগ্যবান নারী ‘উরিয়ার বিধবা স্ত্রী’ (মথি ১/৬)। তাঁর নাম ছিল বৎসেবা। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, তিনি ছিলেন দাউদের প্রতিবেশী উরিয়ার স্ত্রী। দাউদ তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে ব্যভিচার করেন। এরপর উরিয়াকে হত্যা করে তাকে বিবাহ করেন। দাউদের আরো অনেক স্ত্রী ছিলেন যাদের সাথে দাউদের সম্পর্ক বৈধতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল। পক্ষান্তরে বেৎশেবার সাথে তাঁর সম্পর্ক ব্যভিচার দিয়েই শুরু। তবে ঈশ্বর অন্য সকল বৈধ স্ত্রীকে বাদ দিয়ে ব্যভিচার দিয়ে শুরু করা এ স্ত্রীকেই বাছাই করলেন ‘ইবনুল্লাহ’দের ও মাসীহের দাদী হওয়ার জন্য।
(৫) যীশু খ্রিষ্টের পূর্ব পুরুষ শলোমন। আমরা দেখেছি যে, বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে তিনি নিজে মূর্তিপূজা করতেন, মূর্তিপূজারী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর স্ত্রীদের জন্য মূর্তি পূজার ব্যবস্থা করেন, ঈশ্বরের প্রজাদের রাজ্যের মধ্যে মূর্তি পূজা ও মূর্তির জন্য কোরবানির উদ্দেশ্যে অনেক মন্দির ও বেদি নির্মাণ করেন।
(৬) যীশুর পরবর্তী পূর্বপুরুষ শলোমন-পুত্র রহবিয়াম। ‘‘তাঁর মায়ের নাম ছিল নয়মা; তিনি জাতিতে একজন অম্মোনীয়’’ (১ বাদশাহনামা ১৪/২১, ৩১)। বাইবেলে বলা হয়েছে যে, রহবিয়াম ও তার রাজ্যের মানুষেরা প্রতিমাপূজক ও পাপাচারী ছিলেন (১ বাদশাহনামা ১৪/২১-৩০ ও ১৫/১-৪)। আর তাঁর মাতার অম্মোনীয় ধর্ম ছিল প্রতিমাপূজা নির্ভর। বাদশাহ শলোমন তাদের জন্য প্রতিমাপূজার ব্যবস্থা করেন।
আমরা আরো দেখছি যে, এ মহিলা ভিন্ন জাতির। লোটের সাথে ব্যভিচারের মাধ্যমে তাঁর দ্বিতীয় মেয়েটা যে পুত্র সন্তান লাভ করে তার নাম ছিল ‘বিন-অম্মি’। তাঁর বংশধরদেকেই অম্মোনীয় বলা হয়। (আদিপুস্তক ১৯/৩৮)। তাহলে যীশু খ্রিষ্টের এ দাদীর ক্ষেত্রে তিনটা বিষয় লক্ষণীয়: (১) তিনি ভিন্ন বংশের মহিলা, (২) তিনি জারজ বংশের মহিলা এবং (৩) তিনি প্রতিমাপূজারি। শলোমনের এক হাজার স্ত্রী ছিল। এরপরও ঈশ্বর অম্মোনীয় নারীকে যীশুর দাদী হওয়ার জন্য নির্বাচন করলেন।
বাইবেল বলেছে: ‘‘কোন অম্মোনীয় কিংবা মোয়াবীয় মাবুদের বান্দাদের সমাজে যোগ দিতে পারবে না; তার চৌদ্দ পুরুষেও কেউ তা কখনো করতে পারবে না।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩/৩, কি. মো.-০৬) কিন্তু এরপরও আমরা দেখছি যে, অম্মোনীয় ও মোয়াবীয় উভয় বংশের সন্তান হওয়ার পরেও দাউদ, শলোমন ও যীশু মাবুদের সমাজে প্রবেশ করেছেন, উপরন্তু মাবুদের সমাজের নেতা হয়েছেন। শুধু তাই নয়; মোয়াবীয় রূত এবং অম্মোনীয় নয়মার বংশে স্বয়ং ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্ররা (ইবনুল্লাহরা) জন্মগ্রহণ করেছেন।
এভাবে বাইবেল প্রমাণ করছে যে, ভিন্ন বংশের নারীর সাথে বিবাহের মাধ্যমে রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়া এবং পূর্বপুরুষদের মূর্তিপূজা ও ব্যভিচার উভয় বিষয়ই যীশুর বংশধারায় বিদ্যমান। তাহলে বাইবেলের এ নির্মম গণহত্যাকে ঈশ্বরের করুণা বলা বা এ গণহত্যার পক্ষে ওকালতি করা কি গণহত্যার চেয়েও অধিক অমানবিক নয়?
[2] https://www.biblegateway.com/resources/all-women-bible/Rahab