লগইন করুন
পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে আমরা যুদ্ধ বিষয়ে বাইবেলের নির্দেশনা আলোচনা করেছি। বাইবেল থেকে আমরা দেখি যে, বাইবেলীয় নবীরা ও ধার্মিক প্রজারা পরিপূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে এ সকল নির্দেশ পালন করেছেন। কখনো কেউ গণহত্যা ও নিবির্চার হত্যার ক্ষেত্রে অবহেলা করলে ঈশ্বর তাকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। বাইবেলীয় সকল যুদ্ধই বাইবেলীয় ঈশ্বরের নির্দেশিত ও অনুমোদিত এবং বাইবেল অনুসারীদের জন্য আদর্শ ধার্মিকতা ও মানবতা বলে গণ্য। কারণ:
প্রথমত: ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাস অনুসারে পবিত্র বাইবেল বনি-ইসরাইলের ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ইতিহাস নয়; এটা একটা ধর্মগ্রন্থ, যা ঈশ্বরের অভ্রান্ত বাণী। ঈশ্বর বা পবিত্র আত্মা যা রচনা করেছেন। কাজেই এ গ্রন্থে যা বলা হয়েছে সবই ঐশ্বরিক ও ঈশ্বর অনুমোদিত। বাইবেলের মধ্যে কোনো পাপের কথা উল্লেখ করা হলে বলা হয়েছে যে, এগুলো ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অন্যায় ছিল। বনি-ইসরাইলের মূর্তি পূজা ও অন্যান্য অনেক অনাচারের কথা উল্লেখ করে বাইবেল বলেছে যে, এগুলো ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অন্যায় ছিল। কিন্তু যুদ্ধের নামে গণহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, প্রতারণামূলক হত্যা, অযোদ্ধা পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু ও নারী হত্যা, অবলা পশু-প্রাণি হত্যা, শত শত জনপদে অগ্নি সংযোগ ইত্যাদি কর্মকে বাইবেলে অন্যায় বলে উল্লেখ করা হয়নি। কোথাও এরূপ কর্ম করতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও এগুলোকে ঈশ্বরের মনোনীত জাতির কর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ঐশ্বরিক অনুমোদন বলে গণ্য।
দ্বিতীয়ত: বাইবেল পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, ঈশ্বর তাঁর প্রিয় ও মনোনীত প্রজাদের ভুল, অন্যায় ও পাপের জন্য তাৎক্ষণিক শাস্তি দিচ্ছেন। বাইবেল নামক পুস্তকটা মূলত ঈশ্বরের প্রজাদের বারবার অবাধ্যতা ও বারবার শাস্তির বিবরণ। মূর্তিপূজা, ব্যভিচার, প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন, ঈশ্বরের নির্দেশ লঙ্ঘন ইত্যাদি বিভিন্ন পাপের জন্য ঈশ্বর বনি-ইসরাইলের নেতা, রাজা, ইমাম, মাসীহ, নবী ও অন্যান্যদের শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলো আমরা যুদ্ধ নামীয় যেসব গণহত্যার আলোচনা করব সেগুলোর জন্য ঈশ্বর তাঁর প্রিয় জাতিকে কখনো শাস্তি দেননি।
তৃতীয়ত: বাইবেলের বর্ণনায় ঈশ্বর বহু বার মূর্তিপূজা ও অন্যান্য অপরাধের কারণে তাঁর প্রিয় মনোনীত প্রজাদের শাস্তি দিলেও এ সকল মহাপাপে লিপ্ত অবস্থাতেই যুদ্ধ ও হত্যার ক্ষেত্রে প্রজাদেরকে অলৌকিকভাবে সাহায্য করেছেন। এ বিষয়ক কিছু নমুনা আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব। একটা নমুনা দেখুন। ইসরাইল রাজ্যের বাদশাহ যিহোয়াশ (Jehoash) সম্পর্কে বাইবেল বলছে: ‘‘মাবুদের চোখে যা খারাপ তিনি তা-ই করতেন এবং নবাটের ছেলে ইয়ারাবিম ইসরাইলকে দিয়ে যে সব গুনাহ করিয়েছিলেন যিহোয়াশ তা-ই করতে থাকলেন। তা থেকে ফিরলেন না।’’ (২ বাদশাহনামা ১৩/১১) কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈশ্বরের মহা-অলৌকিক ক্ষমতাধারী মহা-ভাববাদী বা নবী ইলিশায় বা আল-ইয়াসা শত্রু হত্যায় তার বিজয়ের জন্য অলৌকিক দুআ করলেন এবং ঈশ্বরও তা বাস্তবায়ন করলেন: ‘‘তিনি (আল-ইয়াসা/ ইলিশায়) মারা যাওয়ার আগে ইসরাইলের বাদশাহ যিহোয়াশ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘হে আমার পিতা, আমার পিতা, রথ আর ঘোড়সওয়ারদের মত আপনি ইসরাইলের রক্ষাকারী। সেই সময় আল-ইয়াসা তাঁকে বললেন, ‘আপনি তীর-ধনুক নিয়ে আসুন।’ তিনি তা আনলে পর আল-ইয়াসা বললেন, ‘ধনুক হাতে নিন’। তাতে তিনি তা হাতে নিলেন। পরে আল-ইয়াসা বাদশাহ্র হাতের উপর তাঁর হাত রেখে বললেন, ‘পূর্ব দিকের জানালাটা খুলে দিন।’ তিনি খুললেন। তারপর আল-ইয়াসা বললেন, ‘তীর ছুঁুড়ুন।’ যিহোয়াশ জানালা খুলে তীর ছুঁড়লেন। তখন আল-ইয়াসা ঘোষণা করলেন, ‘এটা হল মাবুদের জয়লাভের তীর, সিরিয়ার উপর জয়লাভের তীর। আপনি অফেকে সিরীয়দের হারিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবেন।’ তারপর আল-ইয়াসা বললেন, ‘আপনি তীরগুলো হাতে নিন।’ বাদশাহ সেগুলো হাতে নিলে পর আল-ইয়াসা বললেন, ‘মাটিতে আঘাত করুন।’ বাদশাহ তিনবার আঘাত করে থামলেন। তখন আল্লাহর বান্দা রাগ করে বললেন, ‘পাঁচ বা ছয়বার মাটিতে আঘাত করা আপনার উচিত ছিল; তাহলে আপনি সিরীয়দের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারতেন। কিন্তু এখন আপনি মাত্র তিনবার তাদের হারিয়ে দিতে পারবেন।’’ (২ বাদশাহনামা ১৩/১৪-১৯)
এভাবে আমরা দেখছি যে, মূর্তিপূজা, ব্যভিচার ও পাপাচার অব্যাহত থাকার কারণে বিরক্ত হলেও যুদ্ধ ও হত্যার ক্ষেত্রে ঈশ্বর তাঁর প্রজাদের পাশেই থেকেছেন।
চতুর্থত: পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে আমরা দেখেছি যে, ঈশ্বর নিজেই তাঁর পবিত্র পুস্তকে যুদ্ধের নামে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও আমরা দেখব যে, অধিকাংশ যুদ্ধের সময় বনি-ইসরাইল ঈশ্বরের সাথে পরামর্শ করেই যুদ্ধ করতেন। নবীদের মাধ্যমে বা যোগাযোগ-কোরবানির মাধ্যমে তাঁরা ঈশ্বরের নিকট থেকে যুদ্ধের অনুমতি ও দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করতেন।
পঞ্চমত: যে সকল ক্ষেত্রে ঈশ্বর যুদ্ধ অপছন্দ করতেন সে সকল ক্ষেত্রে ঈশ্বর নিজেই তাঁর প্রিয় প্রজাদেরকে নিষেধ করতেন এবং প্রজারা যুদ্ধ বর্জন করতেন। একটা নমুনা দেখুন: ‘‘জেরুজালেমে পৌঁছে রহবিয়াম এহুদা ও বিনইয়ামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে যুদ্ধের জন্য জমায়েত করলেন। তাতে এক লক্ষ আশি হাজার সৈন্য হল। এটা করা হল যাতে ইসরাইলীয়দের সংগে যুদ্ধ করে রাজ্যটা আবার সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামের হাতে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু আল্লাহর বান্দা শময়িয়ের উপর আল্লাহর এই কালাম নাজেল হল, ‘তুমি এহুদার বাদশাহ সোলায়মানের ছেলে রহবিয়ামকে, এহুদা ও বিনইয়ামীন-গোষ্ঠীর সমস্ত লোককে এবং বাকী সব লোকদের বল যে, মাবুদ বলছেন, তারা যেন নিজের ভাই বনি-ইসরাইলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না যায়। তারা প্রত্যেকে যেন বাড়ি ফিরে যায়, কারণ এটা মাবুদেরই কাজ।’ কাজেই তারা মাবুদের কথা মেনে নিয়ে মাবুদের হুকুম মত বাড়ি ফিরে গেল।’’ (১ বাদশাহনামা ১২/২১-২৪)
এ থেকে জানা যায় যে, নিম্নে আলোচিত সকল যুদ্ধই ঈশ্বর অনুমোদিত; ঈশ্বর এগুলো নিষেধ করেননি; বরং পবিত্র পুস্তকে চিরন্তন বিধান হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন।