লগইন করুন
আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের বিষয়টা বাইবেল ও কুরআন উভয় ধর্মগ্রন্থেই বিদ্যমান। কুরআনের বর্ণনায় শয়তানের ভুল ব্যাখ্যা ও প্ররোচনায় আদম ও হাওয়া ফল ভক্ষণ করেন। এটা তাঁদের ভুল ছিল, পাপ ছিল না। আদম ও হাওয়া উভয়েই তাৎক্ষণিক অনুতাপ ও তাওবার মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবং যে উদ্দেশ্যে তাঁদের সৃষ্টি, পৃথিবীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সে মর্যাদা ও দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।
পক্ষান্তরে বাইবেলের বর্ণনায় এটা হাওয়ার ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল। হাওয়া সাপ কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে ফল ভক্ষণ করেন। তিনি আদমকে তা দিলে তিনি কোনো আপত্তি ছাড়া তা ভক্ষণ করেন। আর আদম ও হাওয়া এজন্য কোনো তাওবা করেননি। বাইবেলে এটাকে হাওয়ার অপরাধে মানবতার পতন বলে গণ্য করা হয়েছে। সাধু পল আদমের পাপে সকলেই পাপী বলে দাবি করেছেন এবং এ পাপের কারণে লক্ষকোটি প্রজন্মের সকল আদম সন্তানের জন্য নরকবাসের বিধান দিয়েছেন।
পাঠকের জ্ঞাতার্থে দীর্ঘ ঘটনাটা আদিপুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি:
আর মাবুদ আল্লাহ পূর্ব দিকে, আদনে একটি বাগান প্রস্তুত করলেন এবং সেই স্থানে তাঁর সৃষ্ট ঐ মানুষটিকে রাখলেন। ... এবং সেই বাগানের মধ্যস্থানে জীবন-বৃক্ষ (the tree of life) ও নেকী-বদী-জ্ঞানের বৃক্ষ (the tree of knowledge of good and evil), উৎপন্ন করলেন।... পরে মাবুদ আল্লাহ আদমকে নিয়ে আদন বাগানে কৃষিকর্ম করার ও তা রক্ষা করার জন্য সেখানে রাখলেন। আর মাবুদ আল্লাহ আদমকে এই হুকুম দিলেন, তুমি এই বাগানের সমস্ত গাছের ফল স্বচ্ছন্দে ভোজন করো; কিন্তু নেকী-বদী-জ্ঞানের বৃক্ষর ফল ভোজন করো না, কেননা যেদিন তার ফল খাবে, সেদিন মরবেই মরবে। আর মাবুদ আল্লাহ বললেন, মানুষের একাকী থাকা ভাল নয়, আমি তার জন্য তার অনুরূপ সহকারিণী সৃষ্টি করব। ... কিন্তু মানুষের জন্য তার অনুরূপ সহকারিণী পাওয়া গেল না। পরে মাবুদ আল্লাহ আদমকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন; আর তিনি তাঁর একখানি পাঁজরের হাড় নিলেন এবং মাংস দিয়ে সেই স্থান পূর্ণ করলেন। মাবুদ আল্লাহ আদম থেকে নেওয়া সেই পাঁজরের হাড় দিয়ে এক জন স্ত্রীলোক সৃষ্টি করলেন ও তাঁকে আদমের কাছে আনলেন।’’... (পয়দায়েশ ২/৮-২২, মো.-১৩)
‘‘মাবুদ আল্লাহর সৃষ্ট ভূচর প্রাণীদের মধ্যে সাপ সবচেয়ে ধূর্ত ছিল। সে ঐ নারীকে বলল, আল্লাহ কি সত্যিই বলেছেন, তোমরা এই বাগানের কোন বৃক্ষর ফল খেও না? নারী সাপকে বললেন, আমরা এই বাগানের সমস্ত গাছের ফল খেতে পারি; কেবল বাগানের মাঝখানে যে গাছটি আছে তার ফলের বিষয় আল্লাহ বলেছেন, তোমরা তা ভোজন করো না, স্পর্শও করো না, করলে মরবে। তখন সাপ নারীকে বলল, কোন ক্রমে মরবে না; কেননা আল্লাহ জানেন, যেদিন তোমরা তা খাবে, সেদিন তোমাদের চোখ খুলে যাবে, তাতে তোমরা আল্লাহর মত হয়ে নেকী-বদীর জ্ঞান লাভ করবে। নারী যখন দেখলেন, ঐ গাছটির ফল সুখাদ্যদায়ক ও দেখতেও খুবই আকর্ষণীয়, আর সেটি জ্ঞানদায়ী বৃক্ষ বলে আকাঙ্খা করার মত, তখন তিনি তার ফল পেড়ে ভোজন করলেন। পরে সেই ফল তাঁর স্বামীকে দিলে তিনিও ভোজন করলেন। তাতে তাঁদের উভয়ের চোখ খুলে গেল এবং তাঁরা বুঝতে পারলেন যে তাঁরা উলঙ্গ; আর ডুমুরের পাতা সেলাই করে ঘাগ্রা প্রস্তত করে নিলেন। পরে তাঁরা মাবুদ আল্লাহর আওয়াজ শুনতে পেলেন, সন্ধ্যার বাতাস যখন বইতে শুরু করছিল তখন মাবুদ বাগানে বেড়াচ্ছিলেন। তাতে আদম ও তাঁর স্ত্রী মাবুদ আল্লাহর সম্মুখ থেকে চলে গিয়ে বাগানের গাছগুলোর মধ্যে লুকালেন। তখন মাবুদ আল্লাহ আদমকে ডেকে বললেন, তুমি কোথায়? তিনি বললেন, আমি বাগানে তোমার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়েছি, কারণ আমি উলঙ্গ, তাই নিজেকে লুকিয়েছি। তিনি বললেন, তুমি যে উলঙ্গ, তা তোমাকে কে বলল, যে গাছের ফল ভোজন করতে তোমাকে নিষেধ করেছিলাম, তুমি কি তার ফল ভোজন করেছ? তাতে আদম বললেন, তুমি আমার সঙ্গিনী করে যে স্ত্রী দিয়েছ, সে আমাকে ঐ গাছের ফল দিয়েছিল, তাই খেয়েছি। তখন মাবুদ আল্লাহ নারীকে বললেন, তুমি এ কি করলে? নারী বললেন, সাপ আমাকে ভুলিয়েছিল, তাই খেয়েছি। পরে মাবুদ আল্লাহ সাপকে বললেন, তুমি এই কাজ করেছ, এই জন্য গৃহপালিত ও বন্য পশুদের মধ্যে তোমাকে সবচেয়ে বেশি বদদোয়া দেওয়া হল; তুমি বুকে হাঁটবে এবং সারা জীবন ধূলি ভোজন করিবে। আর আমি তোমাতে ও নারীতে এবং তোমার বংশে ও তার বংশে পরস্পর শত্রুতা জন্মাব; সে তোমার মাথা চূর্ণ করবে এবং তুমি তার পায়ের গোড়ালি চূর্ণ করবে। পরে তিনি নারীকে বললেন, আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করব, তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করবে। স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকবে এবং সে তোমার উপরে কর্ত্তৃত্ব করবে। আর তিনি আদমকে বললেন, যে গাছের ফলের বিষয়ে আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি তা ভোজন করো না, তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে সেই গাছের ফল ভোজন করেছ। তাই তোমার দরুন ভূমিকে বদদোয়া দেওয়া হল; তুমি সারা জীবন কষ্ট করে তা ভোগ করবে; আর তাতে তোমার জন্য কাঁটা ও শেয়ালকাঁটা জন্মাবে এবং তুমি ক্ষেতের ওষধি ভোজন করবে। তুমি যে মাটি থেকে গৃহীত হয়েছ, যে পর্যন্ত সেই মাটিতে ফিরে না যাবে, ততদিন তুমি ঘর্মাক্ত মুখে আহার করবে...।’’ (পয়দায়েশ/ আদিপুস্তক ৩/১-১৯, মো.-১৩)
বাইবেল বলছে: ‘‘সম্পূর্ণ বাধ্য থেকে মৌনভাবে (in silence with all subjection/ all submissiveness) স্ত্রীলোকেরা শিক্ষা গ্রহণ করুক। আমি উপদেশ দেবার কিম্বা পুরুষের উপরে কর্তৃত্ব করার অনুমতি স্ত্রীলোককে দেই না, কিন্তু মৌনভাবে থাকতে বলি। কারণ প্রথমে আদমকে, পরে হাওয়াকে নির্মাণ করা হয়েছিল। আর আদম যে ছলনায় ভুলেছিলেন তা নয় (আদম প্রবঞ্চিত হইলেন না), কিন্তু স্ত্রীলোক ছলনায় ভুলে (নারী প্রবঞ্চিতা হইয়া) আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছিলেন। তবুও যদি আত্মসংযমের সঙ্গে ঈমান, মহববত ও পবিত্রতায় স্থির থাকে, তবে স্ত্রীলোক সন্তান প্রসবের মধ্য দিয়ে উদ্ধার পাবে।’’ (১ তীমথিয় ২/১১-১৪, মো.-১৩)
এটাই সেই মহাপাপের কাহিনী সে মহাপাপের জন্য সকল মানুষ পাপী এবং কোটি কোটি প্রজন্মের সকল মানুষকেই ‘বিনা বিচারে’ চিরস্থায়ী নরকবাস করতে হবে; শুধু যীশুর আত্মত্যাগে বিশ্বাসের মাধ্যমেই এ পাপ ও সকল পাপের দায় থেকে মুক্ত হওয়া যাবে বলে দাবি করেছেন সাধু পল। এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(১) দ্বিতীয় উদ্ধৃতি (১ তীমথিয়) থেকে জানা যায় যে, আদম প্রতারিত হন নি, অপরাধীও হন নি, পক্ষান্তরে হাওয়া প্রতারিত এবং অপরাধী হন। এতে আদম ও হাওয়ার বংশধর সকল যুগের সকল পুরুষ নিরপরাধ ও সকল নারীই অপরাধী হয়ে গেল! এজন্য নিরপরাধ পুরুষের উপর অপরাধী নারীর কর্তৃত্ব করা নিষিদ্ধ করা হল। নিরপরাধ পুরুষের সামনে অপরাধী নারীর কথা বলাও নিষিদ্ধ করা হল। শুধু সম্পূর্ণ বশ্যতা ও নীরব আনুগত্য। উপরন্তু অপরাধের কারণে নারীর জন্য শিক্ষাদানও নিষিদ্ধ করা হল।
(২) এভাবে এ পাপের জন্য বাইবেল শুধু স্ত্রীলোককেই দায়ী করেছে। প্রথম উদ্ধৃতির আলোকে তা একেবারেই অযৌক্তিক। আমরা দেখছি যে, আদমকে ফলভক্ষণ নিষেধ করার পরে হাওয়ার সৃষ্টি। হাওয়া হয়ত তাঁর স্বামীর মুখে শুনেছেন মাত্র, ঈশ্বরের মুখ থেকে নিষেধাজ্ঞা পান নি। এছাড়া হাওয়া সাপের কথা বিশ্বাস করে ফলটা উপকারী ভেবে তা ভক্ষণ করেন। পক্ষান্তরে আদম কোনো প্ররোচনা ছাড়াই স্ত্রী দেওয়া মাত্র তা ভক্ষণ করলেন। অথচ পাপ ও পতনের জন্য শুধু হাওয়াই দায়ী হলেন কেন? মানবীয় বিবেক ও আইনে কে অধিক অপরাধী? যে ব্যক্তি কারো প্ররেচনায় বা ভুল ব্যাখ্যায় প্রতারিত হয়ে অপরাধ করে সে ব্যক্তি? না যে ব্যক্তি কারো প্ররোচনা ছাড়াই সঠিক বিষয় জানা সত্ত্বেও সচেতনভাবে নির্বিকারচিত্তে অপরাধ করে?
(৩) হাওয়ার অপরাধের দোহাই দিয়ে নারীদেরকে পুরুষদের দাসী বানানো, পুরুষের সামনে কথা, শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আরো অযৌক্তিক।
(৪) বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে আদম ও হাওয়া কাউকেই পাপী গণ্য করা যায় না। কারণ ফল খাওয়ার পরেই আদম ও হাওয়া ‘নেকী-বদী’ জ্ঞান অর্জন করলেন। তাহলে এর আগে তো তারা পাপ, পুণ্য কিছুই বুঝতেন না। কাজেই জ্ঞান অর্জনের আগে পাপ হবে কেন? আর জ্ঞানহীনের পাপের জন্য তার বংশধরদের পাপী হতে হবে কেন? সর্বোপরি, বাইবেলের বর্ণনায় ঈশ্বর জীবন-বৃক্ষর পাশে পাহারা বসান, কিন্তু নেকী-বদী-জ্ঞানের বৃক্ষর পাশে পাহারা বসান নি। ঈশ্বর যদি জীবন বৃক্ষর ন্যায় নেকী-বদী-জ্ঞানদায়ক বৃক্ষর পাশেও পাহারা বসাতেন তবে আদম ও কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদম-সন্তানের পাপ ও মৃত্যু হত না! আর এ অলৌকিক পাপ থেকে মুক্তির জন্য যীশুর মহাবেদনা লাভ ও জীবন উৎসর্গের প্রয়োজন হত না।[1]
(৫) এখানে ঈশ্বর আদম, হাওয়া ও সাপের অপরাধের জন্য যে শাস্তি বরাদ্দ করেছেন তা তাদের পরবর্তী সকল প্রজন্মের জন্যই। বিষয়টা অযৌক্তিক, অমানবিক ও অনৈশ্বরিক। একজনের অপরাধের শাস্তি অন্যরা ভোগ করবে কেন? বিষয়টা অবান্তরও বটে। এটা কোনো শাস্তিই নয়। পৃথিবীতে ঘর্মাক্ত হওয়া বা কষ্ট করা বা সন্তান প্রসবের কষ্ট পাওয়া মানুষ ছাড়া অন্যান্য অনেক প্রাণির ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। এখানে আদম-হাওয়ার বৈশিষ্ট্য কী?
(৬) ‘আদমের পাপে সকলেই পাপী হয়ে পরকালের শাস্তির উপযুক্ত হলেন এবং যীশুর পুণ্যে সকলেই পারলৌকিক মুক্তির উপযোগী হলেন’ বলে সাধু পল যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা বাইবেলের উপরের বক্তব্য দ্বারা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। কারণ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আদম, হাওয়া ও সাপ তাদের কর্মের নির্দিষ্ট প্রতিফল ও শাস্তি ভোগ করেছেন। এরপরও কিভাবে মনে করা যায় যে, তাঁদেরকে অথবা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের কাউকে ইহকালে বা পরকালে এ পাপের জন্য নির্ধারিত শাস্তিগুলো ছাড়া অন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে?
(৭) প্রথম উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট যে, নারীর অপরাধের শাস্তি সন্তান প্রসবের কষ্ট লাভ। এটার মাধ্যমেই সে পাপমুক্ত হবে। কিন্তু দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে যে, সন্তান প্রসবের কষ্ট বহন ছাড়াও নারীকে আত্মসংযম, বিশ্বাস, প্রেম ও পবিত্রতায় স্থির থাকতে হবে। তবেই শুধু সে মুক্তি পাবে। কিন্তু অন্যত্র সাধু পল নারীদেরকে কুমারী থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। কুমারী নারী যেহেতু সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা সহ্য করেন না সেহেতু কুমারী নারীর মুক্তি বাইবেলের এ দুটো বক্তব্য অনুসারে অসম্ভব।