লগইন করুন
আমরা জানি, খ্রিষ্টধর্মের মূল বিশ্বাস, যীশুর ঈশ্বরত্ব ও ঈশ্বরের ত্রিত্ব। যীশুর ঈশ্বরত্ব ও অনাদিত্ব বুঝাতে খ্রিষ্টধর্মের মূল পরিভাষা: যীশু ঈশ্বরের ‘একজাত পুত্র’ বা ‘একমাত্র জন্ম দেওয়া পুত্র’ (only begotten Son)। ইংরেজিতে ‘beget’ শব্দটার অর্থ ‘জন্ম দেওয়া’। বাইবেলে শব্দটা পিতার ঔরসে সন্তান জন্ম দেওয়া অর্থে কয়েকশতবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ‘ইবরাহীম ইসহাককে জন্ম দিলেন’ (Abraham begat Isaac)। (আদিপুস্তক ২৫/১৯; ১ বংশাবলি ১/৩৪; মথি ১/২; প্রেরিত ৭/৮)। এ অর্থে (only begotten Son) বাক্যাংশের অর্থ হয়: একমাত্র ঔরসজাত পুত্র।
বাইবেলে সৃষ্টি করা অর্থেও এ শব্দটা ব্যবহৃত। ইয়োব ৩৮/২৮: ‘‘বৃষ্টির পিতা কেহ কি আছে? শিশির-বিন্দুসমূহের জনকই বা কে? (Hath the rain a father? or who hath begotten the drops of dew?)। যাকোব ১/১৮: তিনি নিজ বাসনায় সত্যের বাক্য দ্বারা আমাদিগকে জন্ম দিয়াছেন (Of his own will begat he us with the word of truth)। তবে খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাসে যীশুকে সৃষ্ট মনে করা সর্বোচ্চ কুফরী। খ্রিষ্টধর্মের মূল আকীদা বা কালিমা নাইসীন ক্রীড (Nicene creed)-এ বলা হয়েছে: “the only begotten of the Father, that is, of the substance of the Father; God of God, light of light, true God of true God; begotten, not made..”: ‘‘পিতার একমাত্র জন্ম দেওয়া (ঔরসজাত) পুত্র ... জন্ম দেওয়া, সৃষ্ট নয়...।’’[1]
সর্বাবস্থায়, নতুন নিয়মের মধ্যে শুধু যোহনীয় লেখনীগুলোতে যীশুকে ঈশ্বরের ‘একজাত’ বা ‘একমাত্র জন্মদেওয়া’ পুত্র (only begotten Son) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (যোহন ১/১৪; ১/১৮; ৩/১৬; ৩/১৮; ১ যোহন ৪/৯)। খ্রিষ্টধর্মের মূল বিশ্বাসটা এ শ্লোকগুলো দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি যে, প্রায় দু’ হাজার বছর পরে রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন ও পরবর্তী আধুনিক ভার্শনগুলোতে ‘জন্ম দেওয়া’ (begotten) শব্দটাকে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যে সকল স্থানে ‘only begotten’ ‘একমাত্র জন্ম দেওয়া’ বাক্যাংশ ছিল সকল স্থান থেকে ‘begotten’ ‘জন্ম দেওয়া’ শব্দটা বাদ দিয়ে শুধু ‘only’ বা ‘একমাত্র’ লেখা হয়েছে: ‘the only Son from the Father/ only Son/ only Son of God’ বা ‘ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র’ বলা হয়েছে। উপরে উদ্ধৃত যোহনের ইঞ্জিলের চারটা শ্লোক এবং যোহনের প্রথম পত্রে শ্লোকটা KSV ও RSV- এর মধ্যে তুলনা করে পড়লেই তা জানতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে, যদিও বাংলা বাইবেলগুলো রিভাইজড ভার্শনের অনুবাদ করেছে, তবে এ বাক্যাংশটার ক্ষেত্রে কেরি এবং কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ ‘একজাত পুত্র’ (only begotten Son) লেখেছে। পক্ষান্তরে পবিত্র বাইবেল-২০০০, কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬ এব জুবিলী বাইবেল ‘একমাত্র পুত্র’ (only Son) লেখেছে।
এভাবে আমরা দেখছি যে, যোহনীয় রচনাবলির লেখক যীশুকে ‘ঈশ্বরের একজাত পুত্র’ বলেননি; ‘একমাত্র পুত্র’ বলেছেন। ‘জাত’ শব্দটা পরে সংযোজিত।
৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নীকিয় সম্মেলনে যীশুকে ঈশ্বরের ‘একজাত’ বা ‘একমাত্র জন্ম দেওয়া পুত্র’ ঘোষণা দেওয়া হয়। কেউ তাকে ‘সৃষ্ট’ বললে তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বাহ্যত এ বিশ্বাস প্রমাণের জন্যই ‘জন্ম দেওয়া’ বা ‘জাত’ শব্দটা সংযোজন করা হয়। প্রায় দু’ হাজার বছর পর শব্দটা বাতিল করা হলেও বিশ্বাসটা বাতিল করা হয়নি।
এভাবে আমরা দেখছি যে, যোহনীয় পুস্তকগুলোর লেখক যীশুকে ঈশ্বরের ‘একজাত পুত্র’ লেখেননি; বরং ‘একমাত্র পুত্র’ লেখেছিলেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, যোহনীয় লেখনিগুলোর লেখক যীশুর শিষ্য ছিলেন না, ইহুদিও ছিলেন না, বরং বাইবেল ও ইহুদি পরিভাষা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ রোমান ছিলেন। কারণ বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের আলোকে যীশুকে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র বলা ভিত্তিহীন ও অর্থহীন। কারণ আদম ঈশবরের পুত্র: আদম ইবনুল্লাহ (Adam, which was the son of God) (লূক ৩/৩৮), তবে তিনি প্রথম পুত্র নন। লূকের হিসেবে আদমের ২৩ পুরুষ অধস্তন বংশধর ইয়াকূব বা যাকোব, যাকোবের পৌত্র (ইউসুফের পুত্র) ইফ্রমিয়/ আফরাহীম এবং যাকোবের ১২ পুরুষ অধস্তন বংশধর দাউদ: এরা তিনজন ঈশ্বরের প্রথমজাত (firstborn) বা প্রথম পুত্র (যাত্রাপুস্তক ৪/২২, যিরমিয় ৩১/৯, গীতসংহিতা ৮৯/২৭)। এছাড়া ঈশ্বরের ৩য় প্রথম পুত্র ‘দাউদ’ ‘ঈশ্বরের জন্ম দেওয়া’ (begotten) পুত্র (গীতসংহিতা ২/৭)। দাউদ প্রায় ৫০ বছর বয়সে ‘ঈশ্বরের জন্ম দেওয়া’ পুত্র হিসেবে জন্মলাভ করেন। যীশুর জন্মের হাজার বছর আগে ঈশ্বর তাঁকে জন্ম দেন। এছাড়া বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মে ঈশ্বরের আরো লক্ষ কোটি পুত্র ও কন্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।