লগইন করুন
যীশুর শিক্ষা প্রচার করতে হবে কাদের কাছে? শুধু ইহুদিদের কাছে? না সকল জাতির কাছে? এ বিষয়ে বাইবেলের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান।
যীশু তাঁর ১২ শিষ্যকে প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে বলেন: ‘‘তোমরা অ-ইহুদীদের (Gentiles) পথে যেও না এবং সামেরিয়দের কোন নগরে প্রবেশ করো না, বরং ইসরাইল-কুলের হারানো মেষদের কাছে যাও।’’ (মথি ১০/৫-৬, মো.-১৩)
তিনি বলেন: ‘‘পবিত্র বস্ত্ত কুকুরদেরকে দিও না এবং তোমাদের মুক্তা শূকরের সম্মুখে ফেলো না; পাছে তারা পা দিয়া তা দলায় এবং ফিরে তোমাদেরকে আক্রমণ করে।’’ (মথি ৭/৬, মো.-১৩)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ কারণেই যীশু অ-ইহুদি বা পরজাতিদের কাছে ধর্মপ্রচার নিষেধ করেছেন। ইস্রায়েলের ১২ গোত্রের মানুষ ছাড়া সকলেই কুকুর ও শূকর তুল্য। কাজেই কোনো পবিত্র বস্ত্ত তাদেরকে দেওয়া যাবে না।
অন্যত্র তিনি আরো সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, তাঁর ধর্ম শুধুই ইসরাইল বংশের মানুষদের জন্য; তারা তাঁর সন্তান ও অন্যান্য জাতির সকলেই কুকুর: ‘‘ইসরাইল-কুলের হারানো ভেড়া ছাড়া আর কারো কাছে আমি প্রেরিত হইনি (I am not sent but unto the lost sheep of the house of Israel)। ... সন্তানদের খাদ্য নিয়ে কুকুরদের কাছে ফেলে দেওয়া ভাল নয় (It is not meet to take the children's bread, and to cast it to dogs)।’’ (মথি ১৫/২২-২৮, মো.-১৩। পুনশ্চ: মার্ক ৭/২৫-২৯)
এর বিপরীতে বাইবেলে অন্যান্য স্থানে যীশু সকল জাতির নিকট ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। মথির বর্ণনা অনুসারে কবর থেকে পুনরুত্থিত হওয়ার পরে যীশু সর্বশেষ সাক্ষাতে শিষ্যদেরকে বলেন: ‘‘অতএব তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতিকে সাহাবী কর (ইংরেজি: teach শিক্ষা দাও); পিতার ও পুত্রের ও পাক-রূহের নামে তাদেরকে বাপ্তিস্ম দাও...।’’ (মথি ২৮/১৯, মো.-১৩)
মার্কের বর্ণনায় এ সময় যীশু বলেন: তোমরা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার (gospel ইঞ্জিল) প্রচার কর।’’ (মার্ক ১৬/১৫)
লূকের বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘‘তখন তিনি তাদের বুদ্ধির দ্বার খুলে দিলেন, যেন তাঁরা পাক-কিতার (কেরি: শাস্ত্র) বুঝতে পারেন। আর তিনি তাঁদেরক বললেন, এরকম লেখা আছে যে, মসীহ দুঃখভোগ করবেন এবং তৃতীয় দিনে মৃতগণের মধ্য থেকে উঠবেন; আর তাঁর নামে গুনাহ মাফের মন পরিবর্তনের কথা সর্বজাতির কাছে প্রচারিত তবলিগ হবে...।’’ (লূক ২৪/৪৫-৪৭, মো.-১৩)
এছাড়া মার্কের বর্ণনা অনুসারে যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে বলেন: ‘‘আর অগ্রে সর্বজাতির কাছে সুসমাচার (gospel ইঞ্জিল) প্রচার হওয়া আবশ্যক।’’ (মার্ক ১৩/১০)।
উপরের নির্দেশগুলো পরস্পর বিরোধী। এ বৈপরীত্য দূর করার জন্য তিনটা সম্ভাবনা বিদ্যমান। প্রথম সম্ভাবনা সকল জাতি বলতে যীশু বনি-ইসরাইলের সকল গোষ্ঠীর সকল মানুষ বুঝিয়েছেন। বিশেষত সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ও হারিয়ে যাওয়া ইসরাইল জাতির মানুষদের, যাদেরকে যীশু ‘ইসরাইল-কুলের হারানো মেষপাল’ বলে আখ্যায়িত করেছন। এ অর্থ গ্রহণ করলে দুটো নির্দেশের মধ্যে বৈপরীত্য থাকে না।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা রহিতকরণ বা পরিবর্তন। অর্থাৎ ঈশ্বর প্রথমে একটা নির্দেশ প্রদান করেন। পরে তিনি তাঁর মন পরিবর্তন করে পূর্বের নির্দেশটা বাতিল করে নিষিদ্ধ কর্মটাকে বৈধ করে নির্দেশ প্রদান করেন। খ্রিষ্টান প্রচারকরা এ মতটাই গ্রহণ করেন। তারা বলেন, যীশু প্রথমে অ-ইহুদিদের কাছে ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করেন। পরে মন পরিবর্তন করে প্রথম বিধান রহিত ও বাতিল করেন এবং অ-ইহুদিদের কাছে ধর্ম প্রচার জরুরি বা ফরজ করে দেন।
তবে এ ব্যাখ্যাটা বাইবেল ও খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাসে ঈশ্বরের কোনো বিধান বা নির্দেশ পরিবর্তন বা রহিত হয় না। ঈশ্বরের সকল বিধান চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। বাইবেল বার বার বলেছে যে, ঈশ্বর মন পরিবর্তন করেন না, কাজেই তাঁর বিধানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন বা রহিতকরণ সম্ভব নয়।
তৃতীয় সম্ভাবনা সংযোজন। যীশু মূলত অ-ইহুদিদের কাছে ধর্ম প্রচার নিষেধ করেছিলেন। তিনি মন পরিবর্তন করেননি, পূর্বের নির্দেশ বাতিল, রহিত বা পরির্তন করে অন্য নির্দেশ দেননি। সকল জাতির কাছে প্রচারের নির্দেশটা পরবর্তীকালে সংযোজিত বক্তব্য মাত্র। প্রেরিতদের কার্যবিবরণ ও সাধু পলের পত্রগুলো পড়লে তৃতীয় সম্ভাবনাই জোরালো বলে প্রতীয়মান হয়। ইতোপূর্বে দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা বিষয়টা উল্লেখ করেছি। এখানে সংক্ষেপে পাঠক নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) ‘প্রেরিত’ পুস্তকের ১০ অধ্যায় থেকে আমরা জেনেছি যে, যীশুর তিরোধানের পরেও দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ যীশুর শিষ্য বা সাহাবীরা অ-ইহুদিদের মধ্যে যীশুর ধর্ম প্রচারের কোনোরূপ চিন্তাই করেননি। তাঁরা নিজেদেরকে ইহুদি বলে এবং অ-ইহুদিদেরকে অপবিত্র বলেই বিশ্বাস করতেন। এজন্য পিতর বলেন: ‘‘আপনারা তো জানেন, ইহুদী নয় এমন কোন লোকের সঙ্গে যোগ দেওয়া কিংবা তার কাছে আসা ইহুদী লোকের পক্ষে আইনসম্মত নয়; কিন্তু আমাকে আল্লাহ্ দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কোন মানুষকে নাপাক কিংবা অপবিত্র বলা উচিত নয়।’’ (প্রেরিত ১০/২৮, মো.-১৩)।
(খ) ‘প্রেরিত’ পুস্তকের ১১ ও ১৫ অধ্যায়ে আমরা দেখছি যে, অ-ইহুদি কিছু মানুষকে যীশুর ধর্মে দীক্ষা দেওয়া নিয়ে বিতর্কের কারণেই ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জেরুজালেমে যীশুর শিষ্যরা ও খ্রিষ্টধর্মীয় প্রাচীনবর্গের ‘মহাসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অ-ইহুদিদের দীক্ষা দেওয়ার বৈধতা প্রমাণের জন্য স্বপ্ন দিয়ে এবং পুরাতন নিয়ম দিয়ে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু যীশুর কোনো একজন সাহাবী বা শিষ্য কোনোভাবে বলছেন না যে, যীশু সকল জাতির কাছে বা বনি-ইসরাইল ছাড়া অন্য কোনো জাতির মানুষের কাছে ধর্ম প্রচারের কোনোরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
লক্ষণীয় যে, মথি ও মার্ক যীশুর সাহাবীদের অন্যতম। তাঁদের নামে প্রচারিত ইঞ্জিলেই এ নির্দেশ লেখা। অথচ জেরুজালেমের সম্মেলনে তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই বলছেন না। এ বিষয়টা নিশ্চিত করে যে, ইঞ্জিলগুলো তাঁদের লেখা নয়। অন্তত এ নির্দেশগুলো পরে সংযোজিত।
(গ) সাধু পল যদিও যীশুর শেষ সাক্ষাতের সময় ছিলেন না; তবে যদি যীশু সকল জাতির কাছে ধর্ম প্রচারের কোনো নির্দেশ দিতেন তবে নিশ্চয়ই সাহাবীদের মাধ্যমে সে কথা তাঁর কাছে পৌঁছে যেতই। আর সেক্ষেত্রে তিনি যীশুর নির্দেশকেই প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন। কিন্তু আমরা দেখি যে, তিনি পুরাতন নিয়ম থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে অ-ইহুদিদের দীক্ষা দানের বৈধতা প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি এ বিষয়ে যীশুর কোনো বক্তব্য পেশ করছেন না।
এভাবে যীশুর তিরোধানের পরে অ-ইহুদি বা বনি-ইসরাইল ছাড়া অন্য কোনো মানুষের কাছে ধর্ম প্রচার নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হওয়া এবং স্বপ্ন অথবা পুরাতন নিয়মের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কর্ম বৈধ প্রমাণের চেষ্টা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সকল জাতির কাছে সুসমাচার প্রচার বা বাপ্তিস্ম প্রদানের কোনো নির্দেশনাই প্রেরিতগণ এবং প্রথম প্রজন্মের শিষ্যরা জানতেন না।