লগইন করুন
প্রথম সাক্ষাতের ন্যায় পরবর্তী সাক্ষাৎগুলোর বর্ণনায়ও অদ্ভুত বৈপরীত্য বিদ্যমান:
(ক) মথির বর্ণনা অনুসারে যীশু দুবার শিষ্যদেরকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন। বাহ্যত সাক্ষাৎ দুটো দু’ দিনে ছিল। প্রথমে কবর থেকে জেরুজালেমে দৌড়ানোর সময় দু’জন মরিয়মকে দেখা দেন। এরপর গালীলের পাহাড়ে এগারজনের সাথে দেখা করে শেষ নির্দেশ প্রদান করে তিনি স্বর্গে গমন করেন। উপরে উদ্ধৃত মথির বক্তব্যে আমরা দেখলাম যীশু দৌড়ানো মহিলাদ্বয়কে বলেন: ‘ভয় কোরো না; তোমরা গিয়ে ভাইদের গালীলে যেতে বল। তারা সেখানেই আমাকে দেখতে পাবে।’’
মথির বর্ণনায় যীশু জেরুজালেমে আর কোনো শিষ্যকে সাক্ষাৎ প্রদান করেননি। বরং তাঁর নির্দেশ মত শিষ্যরা গালীলে সমবেত হলে সেখানেই তাঁদেরকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন: ‘‘ঈসা গালীলের যে পাহাড়ে সাহাবীদের যেতে বলেছিলেন সেই এগারোজন সাহাবী তখন সেই পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ঈসাকে দেখে তাঁরা তাঁকে সেজদা করলেন, কিন্তু কয়েকজন সন্দেহ করলেন।’’ (মথি ২৮/১৬-১৭) গালীলের এ পাহাড়ে যীশু তাঁদেরকে শেষ নির্দেশ প্রদান করেন। (মথি ২৮/১৮-২০)
মথির বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট যে, গালীলের পাহাড়ের সাক্ষাতের আগে তিনি কোনো শিষ্যকে সাক্ষাৎ প্রদান করেননি। এ ছাড়া মথি বলছেন যে, গালীলে সাক্ষাতের সময় এগারজন শিষ্যের কয়েকজন সন্দেহ করেন। এতে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, গালীলের আগে আর কোথাও তাঁরা তাঁকে দেখেন নি।
(খ) লূকের বর্ণনা অনুসারে যীশু পুনরুত্থানের দিনে জেরুজালেমেই দু’বার বা তিনবার শিষ্যদের সাক্ষাৎ প্রদান করেন। প্রথমে পথচারী দু’জনকে, এরপর অন্যান্যদেরকে এবং শিমোনকে।
লূকের বর্ণনায় ইম্মায়ূ গ্রামে যাওয়ার পথে দুজন শিষ্যকে দেখা দেন। এটাই তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। ২৪ অধ্যায়ের পরবর্তী ১৭-৩২ শ্লোকে লূক পথ চলতে চলতে যীশুর সাথে এ দু’ শিষ্যের কথার বিবরণ দিয়েছেন। শিষ্যদ্বয় যীশুকে চিনতে পারেন নি। যীশু তাঁদেরকে উপদেশ দেন ও ‘বকেন’। তিনি বলেন, ... আপনাদের মন এত অসাড় যে, নবীরা যা বলেছেন তা আপনারা বিশ্বাস করেন না...। (লূক ২৪/২৫)।
এরপর লূক লেখেছেন যে, সন্ধ্যার দিকে যীশুকে নিয়ে খাদ্য গ্রহণের শেষ মুহূর্তে তাঁরা যীশুকে চিনতে পারেন। ‘‘তখনই সেই দু’জন উঠে যিরূশালেমে গেলেন এবং সেই এগারোজন শিষ্য ও তাঁদের সংগে অন্যদেরও এক জায়গায় দেখতে পেলেন। প্রভু যে সত্যিই জীবিত হয়ে উঠেছেন এবং শিমোনকে দেখা দিয়েছেন তা নিয়ে তখন তাঁরা আলোচনা করছিলেন। .... সেই শিষ্যেরা যখন এই কথা বলছিলেন তখন যীশু নিজে তাঁদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের সবাইকে বললেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক’..।’’ (লূক ২৪/৩৩-৩৬: বাইবেল-২০০০)।
এরপর যীশু শিষ্যদেরকে শেষ নির্দেশনা প্রদান করেন। লূক যীশুর শেষ নির্দেশনা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন (লূক ২৪/৩৮-৪৯)। এরপর তিনি বলেন: ‘‘পরে যীশু তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বৈথনিয়া পর্যন্ত গেলেন। সেখানে তিনি হাত তুলে তাঁদের আশীর্বাদ করলেন। আশীর্বাদ করতে করতেই তিনি তাঁদের ছেড়ে গেলেন এবং তাঁকে স্বর্গে তুলে নেওয়া হল।’’ (লূক ২৪/৫০-৫১: বাইবেল-২০০০)
এভাবে আমরা দেখছি যে, যীশু প্রথমে জেরুজালেম ও ইম্মায়ূ (Emmaus) গ্রামের মধ্যবর্তী পথে এ দুজন শিষ্যকে দেখা দেন। তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সাথে পথ চলেন। লূকের কথা থেকে জানা যায় যে, এ সময়ের মধ্যে তিনি পিতরকেও সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন। তবে কখন ও কিভাবে তা তিনি লেখেননি। হতে পারে যে, এ দুজন শিষ্যের দ্বিতীয় জনই পিতর ছিলেন। সর্বাবস্থায় এ দু’জন শিষ্য জেরুজালেমে ফেরার পর সে রাতেই এ দু’জনসহ অন্যান্য শিষ্যকে সাক্ষাৎ দেন। সকল কিছুই জেরুজালেমে সম্পন্ন হয়। তাঁরা জেরুজালেম থেকে দেড় মাইল বা প্রায় আড়াই কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত বৈথনিয়া গ্রামে[1] গমন করেন। সেখান থেকেই তিনি স্বর্গে গমন করেন। যীশু বা তাঁর শিষ্যরা জেরুজালেম থেকে ৬৮ মাইল বা প্রায় শত কিলোমিটার দূরে নাসরত বা গালীলে[2] যাননি।
(গ) যোহন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ও সাংঘর্ষিক তথ্য প্রদান করেছেন। উপরে আমরা যোহনের বক্তব্য থেকে দেখেছি যে, যীশু পুনরুত্থান দিবসে প্রথমে মগ্দলীনী মরিয়মকে এবং এরপর সে দিন সন্ধ্যায় জেরুজালেমেই অন্যান্য শিষ্যকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন। যোহন আরো দু’বার সাক্ষাতের কথা লেখেছেন। ‘‘যীশু যখন এসেছিলেন তখন থোমা নামে সেই বারেজন শিষ্যদের মধ্যে একজন তাঁদের সংগে ছিলেন না। ... এর এক সপ্তা পরে শিষ্যেরা আবার ঘরের মধ্যে মিলিত হলেন, আর থোমাও তাঁদের সংগে ছিলেন। যদিও সমস্ত দরজা বন্ধ ছিল তবুও যীশু এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক’। .... এর পরে তিবিরিয়া সাগরের পারে শিষ্যদের কাছে আবার যীশু দেখা দিলেন। (তিনি ৭ জন শিষ্যকে সাক্ষাৎ দেন, যারা রাত্রিতে নৌকায় মাছ ধরছিলেন)। মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবার পর যীশু এই তৃতীয় বার শিষ্যদের দেখা দিলেন।’’ (যোহন ২০/২৪-৩০ ও ২১/১-১৪: বাইবেল-২০০০)।
প্রথম তিন সাক্ষাৎ নিশ্চিতভাবেই জেরুজালেমে হয়েছিল। তিবরিয়া সাগর গালীলে অবস্থিত। তাহলে ৭ শিষ্যের সাথে শেষ সাক্ষাৎ গালীলে হয়েছিল।
(ঘ) পাঠক জেনেছেন যে, মার্কের ইঞ্জিলের ১৬ অধ্যায়ের ৯ থেকে ২০ শ্লোক প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোতে নেই। অধ্যায়টা পড়লে পাঠক অনুধাবন করবেন যে, কথাগুলো সংযোজিত। এ সংযোজিত বর্ণনা অনুসারে যীশু পুনরুত্থানের দিনে এবং জেরুজালেমেই তিনবার শিষ্যদেরকে দেখা দেন। প্রথমে মরিয়ম মগ্দলীনীকে, এরপর দুজন পথচারী শিষ্যকে এবং সর্বশেষ তাঁর এগারোজন শিষ্যকে দেখা দেন। তাঁদেরকে ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন। ‘‘শিষ্যদের কাছে এই সব কথা বলবার পরে প্রভু যীশুকে স্বর্গে তুলে নেওয়া হল।’’ (মার্ক ১৬/১৯: বাইবেল-২০০০)
মার্কের বর্ণনা লূক ও যোহনের সাথে সাংঘর্ষিক। মার্ক লেখেছেন, মগ্দলীনী মরিয়ম, যাকোবের মা মরিয়ম ও শালোমী যীশুর কবরের মধ্যে ঢুকে স্বর্গদূতের কথা শুনে ‘‘কিছু বুঝতে না পেরে কাঁপতে কাঁপতে কবরের গুহা থেকে বের হয়ে আসলেন এবং সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। তারা এত ভয় পেয়েছিলেন যে, কাউকে কিছু বললেন না। সপ্তার প্রথম দিনের ভোর বেলায় যীশু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠলেন। তিনি পরে মগ্দলীনী মরিয়মকে প্রথম দেখা দিলেন। .... যীশুকে দেখবার পর মরিয়ম গিয়ে যাঁরা যীশুর সংগে থাকতেন তাঁদের কাছে খবর দিলেন। ... যীশু জীবিত হয়েছেন ও মরিয়ম তাঁকে দেখেছেন, এই কথা শুনে তাঁরা বিশ্বাস করলেন না। এর পরে তাঁর দু’জন শিষ্য যখন হেঁটে গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন তখন যীশু অন্য রকম চেহারায় তাঁদেরকে দেখা দিলেন। তাঁরা ফিরে গিয়ে বাকী সবাইকে সেই খবর দিলেন, কিন্তু তাঁদের কথাও অন্য শিষ্যেরা বিশ্বাস করলেন না। এর পরে যীশু তাঁর এগারোজন শিষ্যকে দেখা দিলেন। তাঁরা খাচ্ছিলেন। বিশ্বাসের অভাব ও অন্তরের কঠিনতার জন্য তিনি তাঁদের বকলেন.... যীশু সেই শিষ্যদের বললেন... । শিষ্যদের কাছে এই সব কথা বলবার পরে প্রভু যীশুকে স্বর্গে তুলে নেওয়া হল।’’ (মার্ক ১৬/৯-১৯: বাইবেল-২০০০)
যোহনের বর্ণনায় মগ্দলীনী মরিয়ম ভয়ে পালিয়ে যাননি, বরং কবরের পাশে দাঁড়িয়েই যীশুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। পক্ষান্তরে মার্কের এ বর্ণনায় মরিয়য়ম ও তাঁর সাথীরা ভয়ে পালিয়ে যান। লূকের বর্ণনায় যীশু পথ চলতে চলতে এবং খাওয়ার সময় তাঁর শিষ্যদ্বয়কে নসীহত করেন এবং ‘বকেন’। যোহনের বর্ণনায় যখন যীশু সন্ধ্যায় সমবেত শিষ্যদেরকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন তখন তাঁরা খাচ্ছিলেন না এবং যীশু তাঁদেরকে বকেনও নি। মার্কের এ শ্লোকগুলোর লেখক উভয় ইঞ্জিলের বর্ণনা গুলিয়ে ফেলেছেন। সর্বাবস্থায় আমরা দেখছি যে, মার্কের বর্ণনা অনুসারে পুনরুত্থানের পর যীশুর সাথে পুনরুত্থানের দিনে জেরুজালেমেই শিষ্যদের তিনবার সাক্ষাৎ হয় এবং এ দিনই তিনি স্বর্গে চলে যান। তিনি গালীলেও যাননি, তিবরিয়া সাগরেও যাননি।
(ঙ) আমরা দেখলাম যে, সাধু পল এ সকল তথ্যের বিপরীত তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবী করেছেন যে, যীশু প্রথম পিতরকে সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছেন যে, যীশু তিন পর্যায়ে সাক্ষাৎ প্রদান করেন: প্রথমে পিতরকে, পরে প্রেরিতদেরকে এবং তাঁর পাঁচশোর বেশি ভাইকে। (১ করিন্থীয় ১৫/৪-৬)
(চ) প্রেরিতদের কার্যবিবরণী পুস্তকটাও লূকের লেখা বলে মনে করা হয়। আমরা দেখেছি যে, লূক সাধু পলের অন্যতম শিষ্য ছিলেন। কিন্তু প্রেরিত পুস্তকে তিনি তাঁর ইঞ্জিলের এবং সাধু পলের সকল তথ্যের বিপরীত তথ্য প্রদান করেছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, যীশু জীবিত হওয়ার পরে শুধু প্রেরিতদেরকে (the apostles)-ই সাক্ষাৎ দিয়েছেন। তিনি লেখেছেন: ‘‘যে শিষ্যদের (সাহাবীদের) তিনি বেছে নিয়েছিলেন (the apostles whom he had chosen কেরি: মনোনীত প্রেরিতদের), তাঁকে তুলে নেবার আগে সেই শিষ্যদের তিনি পবিত্র আত্মার মধ্য দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর দুঃখভোগের পরে এই লোকদের কাছে তিনি দেখা দিয়েছিলেন এবং তিনি যে জীবিত আছেন তার অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিয়েছিলেন। চল্লিশ দিন তিনি শিষ্যদের দেখা দিয়ে ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয় বলেছিলেন।’’ (প্রেরিত ১/১-৩: বাইবেল-২০০০)
এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, যীশু পুনরুত্থানের পর ১১ জন প্রেরিত/ সাহাবী (apostles) ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ বা মহিলাকে সাক্ষাৎ দেননি। লূকের ইঞ্জিলের সাথে লূকের প্রেরিতের মিল হল উভয় পুস্তকেই নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তিনি কোনো মহিলাকে দেখা দেননি। আর অমিল হল, লূকের ইঞ্জিলে প্রেরিতগণ ছাড়াও ক্লিয়পা ও নাম না জানা আরো কয়েকজনের সাথে সাক্ষাতের কথা আছে। আর প্রেরিত পুস্তকে শুধু প্রেরিতদের বা সাহাবীদের সাথে সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
[2] https://answers.yahoo.com/question/index?qid=20080103223900AA8Cg5C