লগইন করুন
সম্মানিত পাঠক, যীশুর বংশ বর্ণনায় দুটো ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান বহুবিধ বৈপরীত্যের মধ্যে সাতটা বৈপরীত্য দেখেছেন। এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়মের সাথে পুরাতন নিয়মের বৈপরীত্য আরো বেশি। নতুন নিয়ম ও পুরাতন নিয়ম যদি বিভিন্ন লেখকের লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ হত, অথবা দুটো ধর্মের দুটো পৃথক ধর্মগ্রন্থ হত তবে সমস্যা কম হত। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে পুরাতন ও নতুন নিয়ম একই লেখকের, অর্থাৎ ঈশ্বর বা পবিত্র আত্মার লেখা একই ধর্মগ্রন্থ। আর এরূপ একটা গ্রন্থের মধ্যে এত বৈপরীত্য সত্যই বিস্ময়কর! কয়েকটা বৈপরীত্য লক্ষ্য করুন:
(১) ভাতিজাকে চাচার ঔরসজাত পুত্র বানানো
যীশুর বংশ-তালিকায় লূক লেখেছেন (৩/২৭): ‘‘রীষা সরুববাবিলের ছেলে, সরুববাবিল শল্টীয়েলের ছেলে, শল্টীয়েল নেরির ছেলে।’’ (কি. মো.-০৬) মথিও লেখেছেন (মথি ১/১২, কি. মো.-০৬): ‘‘শল্টীয়েলের ছেলে সরুববাবিল (She-al'ti-el begat Zerub'babel: শল্টীয়েল জন্ম দেন সরুববাবিলকে)।’’ এভাবে দুজনই নিশ্চিত করছেন যে, সরুববাবিল শল্টীয়েলের ঔরসজাত পুত্র। কিন্তু ১ বংশাবলি ৩/১৭-১৮ নিশ্চিত করেছে যে, সরুববাবিল ছিলেন শল্টীয়েলের ভাই পদায়ের পুত্র।
(২) শল্টীয়েলের পিতা কে? নেরি অথবা যিকনিয়?
আমরা দেখেছি যীশুর পিতা যোষেফের দু’জন পিতা ছিলেন বলে বাইবেল উল্লেখ করেছে। বিষয়টা বিব্রতকর! একইভাবে যীশুর পুর্বপুরুষ শল্টীয়েলেরও দুজন পিতার কথা বাইবেল বলেছে। উপরের অনুচ্ছেদে আমরা দেখলাম, লূক বললেন, ‘‘শল্টীয়েল নেরির ছেলে।’’ কিন্তু ১ বংশাবলি ৩/১৭ ও মথি ১/১২ বলছে, শল্টীয়েলের পিতার নাম ছিল যিকনিয় (যিহোয়াখীন): ‘‘যিকনিয়ের ছেলে শল্টীয়েল’’।
(৩) সরুববাবিলের পুত্র কে?
লূক লেখেছেন (৩/২৭), সরুববাবিলের পুত্রের নাম রীযা: ‘‘ইনি রীযার পুত্র, ইনি সরুববাবিলের পুত্র’’। পক্ষান্তরে মথি (১/১২-১৩) লেখেছেন: (Zerub'babel begat Abi'ud: সরুববাবিল জন্ম দেন অবীহূদকে): ‘‘সরুববাবিলের পুত্র অবীহূদ।’’ পুরাতন নিয়মের বর্ণনায় মথি ও লূক দুজনেই ভুল করেছেন। সরুববাবিলের ৫টা পুত্র ছিল, তাদের মধ্যে অবীহূদ বা রীযা নামে কোনো পুত্র ছিল না। (১ বংশাবলির ৩/১৯)
(৪) দাউদ থেকে ব্যাবিলন ১৪ পুরুষ না ১৮ পুরুষ
মথি বলেছেন: ‘‘দাউদ থেকে ব্যাবিলনের নির্বাসন পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ’’ (মথি ১/১৭)। পুরাতন নিয়মের তথ্য অনুসারে এটা একটা মারাত্মক ভুল। ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায় থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এ পর্যায়ে ১৮ পুরুষ ছিল, ১৪ পুরুষ নয়। আরো লক্ষণীয় যে, বংশাবলি ও মথি- বাইবেলের দু স্থানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তির জনক। মথি তালিকার বিভিন্ন স্থান থেকে চার পুরুষ ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও লেখেছেন যে, পূর্ববতী ব্যক্তি পরের ব্যক্তির সরাসরি জনক। তিনি এতেও ক্ষান্ত হননি। উপরন্তু এদের মাঝে যে আর কেউ ছিল না নিশ্চিত করতে এ পর্যায়ে সর্বমোট ১৪ পুরুষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ কার্ডিনাল জন হেনরী নিউম্যান (১৮০১-১৮৯০) আফসোস করে বলেন, ‘‘খ্রিষ্টধর্মে এ কথা বিশ্বাস করা জরুরি যে, তিনে এক হয় বা তিন ও এক একই সংখ্যা। কিন্তু এখন এ কথাও বিশ্বাস করা জরুরি হয়ে গেল যে, ১৪ এবং ১৮ একই সংখ্যা; কারণ পবিত্র গ্রন্থে কোনো ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই!’’[1]
(৫) পিতার নাম পাল্টে গেল: পুত্র পৌত্র হয়ে গেলেন
যীশুর বংশ-তালিকায় লূক লেখেছেন: “Sala, Which was the son of Cainan, which was the son of Arphaxad, which was the son of Sem, which was the son of Noe.” কেরি ও কি. মো.-১৩: ‘‘ইনি শেলহের পুত্র, ইনি কৈননের পুত্র, ইনি অর্ফকষদের পুত্র, ইনি সামের পুত্র, ইনি নূহের পুত্র’’। কি. মো.-০৬: ‘‘শালেখ কীনানের ছেলে, কীনান আরফাশখাদের ছেলে, আরফাশখাদ সামের ছেলে, সাম নূহের ছেলে।’’ (লূক ৩/৩৫-৩৬)
লূকের বক্তব্য তৌরাত এবং পুরাতন নিয়মের অন্যান্য পুস্তকের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। পুরাতন নিয়ম বারবার বলছে যে, শেলহ নিজেই অর্ফকষদের পুত্র ছিলেন। আদিপুস্তক/ পয়দায়েশ ১০/২৪: “Arphaxad begat Salah.” কেরি ও কি. মো.-১৩: ‘‘আর অর্ফক্ষদ/আরফাকশাদ শেলহের জন্ম দিলেন’’। কি. মো.-০৬: ‘‘আরফাখশাদের ছেলের নাম শালেখ।’’ জুবিলী বাইবেল: ‘‘আর্পাক্সাদ শেলাহর পিতা হলেন।’’
Anchorপয়দায়েশ/ আদিপুস্তক ১১/১২-১৩ : ‘‘অর্ফক্ষদ পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে শেলহের জন্ম দিলেন। শেলহের জন্ম দিলে পর অর্ফক্ষদ চারি শত তিন বৎসর জীবিত থাকিয়া আরও পুত্র কন্যার জন্ম দিলেন।’’ ১ বংশাবলি ১/১৮ শ্লোকেও এ কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও অর্ফকষদ ও শেলহের মধ্যে কৈননের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, লূকের সুসমাচারের উপর্যু&ক্ত কথাটা ভুল।
(৬) যোরাম জন্ম দেন উষিয়কে! একটা বাক্যে দুটো ভুল!
মথি (১/৮) লেখেছেন: ‘‘যোরাম জন্ম দেন উষিয়কে: Joram begat Ozias)’’ বাংলা বাইবেলে: ‘‘যোরামের পুত্র/ ছেলে উষিয়।’’
পুরাতন নিয়মের বর্ণনা অনুসারে এখানে দুটো ভুল বা বৈপরীত্য রয়েছে:
প্রথমত: ১ বংশাবলি/ খান্দাননামা ৩/১০-১২ এবং মথি ১/৭-৯ উভয় স্থানেই বলা হচ্ছে যে, ‘‘সোলায়মানের পুত্র রহবিয়াম, তার পুত্র অবিয়, তার পুত্র আসা, তার পুত্র যেহশাফট, তার পুত্র যোরাম।’’ বংশাবলি বলছে যে, যোরামের তিন পুরুষ পরের মানুষ উষিয় বা অসরিয়। কিন্তু লূক বলছেন যোরামের ঔরসজাত পুত্র উষিয় বা অসরিয়।
১ বংশাবলি/ খান্দানামা ৩/১০-১২: “Jehoshaphat his son, Joram his son, Ahaziah his son, Joash his son, Amaziah his son, Azariah his son, Jotham his son...”: ‘‘তার পুত্র যিহশাফট, তার পুত্র যোরাম, তার পুত্র অহসিয়, তার পুত্র যোয়াশ, তার পুত্র অমৎসিয়, তার পুত্র অসরিয় (ঊষিয়), তার পুত্র যোথম...’’। কিন্তু মথি লেখছেন: “Josaphat begat Joram; and Joram begat Ozias; And Ozias begat Joatham..” ‘‘যিহোশাফটের পুত্র যোরাম, যোরামের পুত্র উষিয়, উষিয়ের পুত্র যোথম।’’
একই ঈশ্বরের রচিত একই ধর্মগ্রন্থে সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো তথ্য! পুরাতন নিয়ম বলছে, যোথমের পিতা অসরিয় যোরামের তিন পুরুষ পরের মানুষ। নতুন নিয়ম বলছে, যোথমের পিতা উষিয় যোরামের ঔরসজাত পুত্র। উভয়ের মাঝে যে আর কেউ নেই তা নিশ্চিত করতে মথি বলছেন: ‘‘যোরাম জন্ম দিলেন ঊষিয়কে’’ (Joram begat Ozias)। উপরন্তু তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, দাউদ থেকে ব্যাবিলন পর্যন্ত ১৪ পুরুষ; কাজেই যোরাম ও ঊষিয়ের মধ্যে কারো থাকার সম্ভাবনাই নেই।
মথি যোরাম ও উষিয়ের মাঝে যে ৩ পুরুষ ফেলে দিয়েছেন: অহসিয়, যোয়াশ ও অমৎসিয় তারা সকলেই ইহুদিদের প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। এরা যিহূদা রাজ্যের ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম রাজা ছিলেন। বাইবেলে বারবার এদের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে (২ রাজাবলির ৮, ১২ ও ১৪ অধ্যায়, ১ বংশাবলি ৩ অধ্যায়, ২ বংশাবলি ২২, ২৪ ও ২৫ অধ্যায়)। যে কোনো সাধারণ শিক্ষিত ইহুদিরও বিষয়গুলো জানার কথা। বাহ্যত প্রগাঢ় অজ্ঞতা ছাড়া এ নামগুলো বাদ দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
দ্বিতীয়ত: ১ বংশাবলি অনুসারে এ ব্যক্তির নাম ‘উষিয়’ (Ozias) নয়, বরং এর নাম অসরিয় (Azariah)। ১ বংশাবলি ৩য় অধ্যায়ে এবং ২ রাজাবলি ১৪ ও ১৫ অধ্যায় থেকেও বিষয়টা নিশ্চিত হয়।
(৭) যোশিয়ের সন্তান যিকনিয় ...: একটা বাক্যে চারটা ভুল!
মথি লেখেছেন: ‘‘ইউসিয়ার/ যোশিয়ের সন্তান যিকনিয় ও তাঁর ভাইয়েরা (যোশিয়/ ইউসিয়া জন্ম দিলেন যিকনিয় ও তাঁর ভাইদের: Josias begat Jechonias and his brethren) বাবিলে নির্বাসন কালে জাত।’’ (মথি ১/১১, কেরি ও মো.-১৩)।
এ থেকে জানা গেল যে, ব্যাবিলনের নির্বাসনে যেয়েও ইউসিয়া বা যোশিয় জীবিত ছিলেন এবং ব্যাবিলনেই তার পুত্র যিকনিয় ও তার ভ্রাতৃগণ জন্মগ্রহণ করেন। পুরাতন নিয়মের তথ্য অনুসারে এখানে চারটা বৈপরীত্য, বরং ভুল বিদ্যমান:
প্রথমত: ব্যাবিলনের নির্বাসনের ১২ বছর পূর্বেই যোশিয় মৃত্যুবরণ করেন। খ্রি. পূ. ৬০৯/৬০৮ সালে মিসরের ফেরাউন নখো (নেকু) তাকে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পরে তার পুত্র যিহোয়হস তিন মাস সিংহাসনে বসেন। এরপর যোশিয়ের অন্য পুত্র যিহোয়াকীম সিংহাসনে বসেন। তিনি ১১ বছর রাজত্ব করেন। যিহোয়াকীমের পরে তার পুত্র যিকনিয় (যিহোয়াখীন) তিন মাস রাজত্ব করেন। এরপর খ্রি. পূ. ৫৯৭ সালের দিকে নেবুকাদনেজার তাকে বন্দি করেন এবং অন্যান্যদের সাথে তাকেও ব্যাবিলনে নিয়ে যান। (২ রাজাবলি ২৩/২৯-৩৪, ২৪/১-১৮; ২ বংশাবলি ৩৫/২০-২৭, ৩৬/১-১০।)
দ্বিতীয়ত, উপরের আলোচনা থেকে পাঠক জানতে পেরেছেন যে, যিকনিয় যোশিয়ের পুত্র নয় বরং পৌত্র। হিব্রু ও আরামাইক উচ্চারণের ব্যতিক্রমের জন্য যিকনিয় যিহোয়াখীন নামেও পরিচিত (২ রাজাবলি ২৩/২৯-৩৪, ২৪/১-১৮; ১ বংশাবলি ২/১৪-১৭; ২ বংশাবলি ৩৫/২০-২৭, ৩৬/১-১০।
তৃতীয়ত, আমরা দেখেছি যে, ব্যাবিলনে নির্বাসনে যাওয়ার সময়ে যিকনিয়ের বয়স ছিল ১৮ বা ৮ বছর। ২ রাজাবলি ২৪/৮: ‘‘যিহোয়াখীন আঠার বছর বয়সে রাজত্ব করতে আরম্ভ করেন এবং জেরুশালেমে তিন মাস রাজত্ব করেন।’’ ২ বংশাবলি ৩৬/৯: ‘‘যিহোয়াখীন আট বছর বয়সে রাজত্ব করতে আরম্ভ করেন এবং জেরুশালেমে তিন মাস দশ দিন রাজত্ব করেন’’। (কেরি ও কি. মো.-১৩)
বয়সের বিষয়ে বৈপরীত্য থাকলেও উভয় স্থানেই বলা হয়েছে যে, তিন মাস বা তিন মাস দশ দিন রাজতব করার পরে নেবুকাদনেজার তাকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যান। কাজেই তিনি কিভাবে ‘বাবিলে নির্বাসন কালে জাত’ হলেন?
চতুর্থত: যিকনিয়ের ‘ভ্রাতৃগণ’ ছিল না। হাঁ, তাঁর পিতার তিনটা ভাই ছিল। ১ বংশাবলি ২/১৫-১৬ অনুসারে যোশিয়ের ছিল চারটা পুত্র। অর্থাৎ যিকনিয়ের পিতা যিহোয়াকীমের তিনটা ভাই ছিল। আর যিকনিয়ের একটামাত্র ভাই ছিল।
লক্ষণীয় যে, যোশিয়, যিহোয়াকীম ও যিকনিয় (যিহোয়াখীন) তিনজনই অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ইহুদি রাজা। বিশেষত এদের সময়েই জেরুজালেম ধ্বংস হয়, এজন্য ইহুদি জাতির স্মৃতিতে এদের নাম চিরস্থায়ী। এদের নাম, পরিচয় ও কর্মকান্ডের বিবরণ বাইবেলের পুরাতন নিয়মের একাধিক পুস্তকে বিস্তারিত আলোচিত। এ সকল সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বের বিষয়েও যদি এত ভুল হয়, যে রাজা কিছুকাল রাজত্ব করার পরে বন্দি হয়ে ‘ব্যাবিলনে-নীত’ হলেন, তাকে যদি ‘ব্যাবিলনে-জাত’ বলা হয়, তবে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা বা পবিত্র আত্মার উপস্থিতির আর কী মূল্য থাকল?
সুপ্রিয় পাঠক, বাইবেলের শেষ পুস্তকের শেষ নির্দেশনা: পবিত্র পুস্তকের মধ্যে একটা শব্দও সংযোজন বা বিয়োজন করলে সে মহা-অভিশপ্ত ও অনন্ত জীবন থেকে বঞ্চিত (প্রকাশিত বাক্য ২২/১৮-১৯)। উপরের কয়েকটা অনুচ্ছেদে আমরা দেখলাম যে, নতুন নিয়মের লেখক পুরাতন নিয়মের বক্তব্যের মধ্যে কিছু শব্দ বা নাম বিয়োজন বা সংযোজনের মাধ্যমে বৈপরীত্য তৈরি করেছেন। এখন প্রশ্ন হল, এ সংযোজন ও বিয়োজনের অভিশাপ ও শাস্তি কে পাবেন? লূক? মথি? পবিত্র আত্মা? ঈশ্বর?!