লগইন করুন
নতুন নিয়মের তৃতীয় পুস্তক সাধু লূকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের পবিত্র ইঞ্জিল (The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Luke) এবং নতুন নিয়মের পঞ্চম পুস্তক ‘প্রেরিতগণের কার্যবিবরণী’ উভয় পুস্তক একই ব্যক্তির লেখা বলে মনে করা হয়। তবে উভয় পুস্তকই বেনামি। পুস্তকদ্বয়ের কোথাও লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রাচীনকাল থেকে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা এ পুস্তকটা সাধু পলের প্রসিদ্ধ সাথী ‘লূক’ নামক দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন অ-ইহুদি খ্রিষ্টান প্রচারকের লেখা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আধুনিক খ্রিষ্টান বাইবেল বিশেষজ্ঞ গবেষকরা লূকের বক্তব্য এবং সাধু পলের বক্তব্যের বৈপরীত্যের কারণে এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। লূক, প্রেরিত ও পলের পত্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান তথ্যের আলোকে তারা বিশ্বাস করেন যে, ‘লূক’ এবং ‘প্রেরিত’ উভয় পুস্তক পরবর্তী কোনো অজানা লেখকের লেখা।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature প্রবন্ধে The Gospel According to Luke অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
“The author has been identified with Luke, “the beloved physician,” Paul's companion on his journeys, presumably a Gentile ... Of more import is the fact that in the writings of Luke specifically Pauline ideas are significantly missing; while Paul speaks of the death of Christ, Luke speaks rather of the suffering, and there are other differing and discrepant ideas on Law and eschatology. In short, the author of this gospel remains unknown. Luke can be dated c. 80. There is no conjecture about its place of writing, except that it probably was outside of Palestine because the writer had no accurate idea of its geography.”
‘‘এ পুস্তকটার লেখক হিসেবে ‘প্রিয় চিকিৎসক’ ‘লূক’কে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি পলের ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন। তিনি একজন অ-ইহুদি বলেই প্রতীয়মান।... অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিশেষভাবে লূকের লেখনির মধ্যে পলের তত্ত্বগুলো অনুপস্থিত। পল বলেন খ্রিষ্টের মৃত্যুর কথা, কিন্তু লূক বেশি বলেন খ্রিষ্টের কষ্টের কথা। এছাড়া মূসার শরীয়ত বিষয়ক এবং পরলোক বিষয়ক তত্ত্বে পলের ও লূকের মধ্যে আরো কিছু বৈপরীত্য ও বৈষম্য বিদ্যমান। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ‘লূক লিখিত সুসমাচার’ নামের এ পুস্তকটার লেখক অজ্ঞাত পরিচয়ই রয়ে যাচ্ছেন। ... লূকের রচনাকাল ৮০ খ্রিষ্টাব্দ হতে পারে। রচনার স্থান অনুমান করার মত কোনো সূত্র নেই। তবে সম্ভবত এটা ফিলিস্তিনের বাইরে কোথাও রচিত। কারণ ফিলিস্তিনের ভৌগলিক তথ্যাদি সম্পর্কে লেখকের কোনো সঠিক ধারণা নেই।’’
মাইক্রোসফট এনকার্টা এ প্রসঙ্গে লেখেছে:
Most modern scholars accept Luke's authorship of both works. Some scholars, however, because of factual contradictions between Paul's letters and the accounts of Paul in Acts, doubt that Luke and Paul were closely associated during Paul's missionary work. ... It is now generally agreed that the Gospel of Luke dates from the decade 70 to 80. Earlier or later dates have also been proposed: if, as some have suggested ... if the absence before then of any reference to the Gospel in the writings of the earliest Fathers of the Church is taken as proof of a later date, it is possible that Luke's Gospel was composed at the end of the 1st century. It is unknown whether the Gospel was written in Rome, Asia Minor, or Greece.
‘‘অধিকাংশ আধুনিক গবেষক মেনে নেন যে, এ পুস্তক এবং প্রেরিত পুস্তকটা লূকের লেখা। তবে কিছু গবেষক এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। কারণ পলের পত্রাবলি এবং প্রেরিত পুস্তকের মধ্যে পল বিষয়ক তথ্যের অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য বিদ্যমান। এজন্য তারা সন্দিহান যে, পলের মিশনারি কর্মকাণ্ডর সময় পল এবং লূক ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। .... বর্তমানে সাধারণভাবে মেনে নেওয়া হয় যে, ৭০ থেকে ৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে লূক রচিত। তবে আরো আগে বা পরে পুস্তকটা লেখা হয়েছে বলেও অনেকে বলেন। এ পুস্তকটার বিষয়ে কোনো উল্লেখ প্রাচীনতম ধর্মগুরুদের লেখনিতে পাওয়া যায় না। এ বিষয়টাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করলে এ কথা বলা সম্ভব যে, এ পুস্তকটা প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকের শেষে লেখা হয়েছে। এটা রোমে, এশিয়া মাইনরে না গ্রিসে লেখা হয়েছিল তা জানা যায় না।’’[1]
উইকিপিডিয়া এ প্রসঙ্গে লেখেছে:
There is general acceptance that the Gospel of Luke and the Acts of the Apostles originated as a two-volume work by a single author addressed to an otherwise unknown individual named Theophilus. This author was an "amateur Hellenistic historian" versed in Greek rhetoric, that being the standard training for historians in the ancient world. According to tradition the author was Luke the Evangelist, the companion of the Apostle Paul, but many modern scholars have expressed doubt and opinion on the subject is evenly divided. Instead, they believe Luke-Acts was written by an anonymous Christian author who may not have been an eyewitness to any of the events recorded within the text. Some of the evidence cited comes from the text of Luke-Acts itself. In the preface to Luke, the author refers to having eyewitness testimony "handed down to us" and to having undertaken a "careful investigation", but the author does not mention his own name or explicitly claim to be an eyewitness to any of the events, except for the we passages. And in the we passages, the narrative is written in the first person plural— the author never refers to himself as "I" or "me". To those who are skeptical of an eyewitness author, the we passages are usually regarded as fragments of a second document, part of some earlier account, which was later incorporated into Acts by the later author of Luke-Acts, or simply a Greek rhetorical device used for sea voyages.
‘‘সাধারণভাবে এ কথা স্বীকৃত যে, লূকের ইঞ্জিল এবং প্রেরিতদের কার্যবিবরণী পুস্তকদ্বয় একই লেখকের লেখা। এ পুস্তকদুটো ‘থিওফিলাস’ নামক এক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে লেখা, যার বিষয়ে ভিন্ন কোনো সূত্র থেকে কিছুই জানা যায় না। এ পুস্তকদ্বয়ের লেখক একজন ‘আনাড়ি গ্রিক ঐতিহাসিক’। তিনি গ্রিকভাষার অলঙ্কারশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন, কারণ এটাই ছিল প্রাচীন যুগে ইতিহাস লেখকদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ। প্রচলিত মত অনুসারে এ লেখক হলেন পলের সাথী ইঞ্জিলবিদ লূক। তবে অনেক আধুনিক গবেষক এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন মত বিদ্যমান। এর বিপরীতে তারা বিশ্বাস করেন যে, লূক ও প্রেরিত পুস্তকদ্বয় একজন অজ্ঞাত পরিচয় খ্রিষ্টান লেখকের লেখা। এ দুটো পুস্তকে লেখা কোনো কিছুই তিনি স্বচক্ষে দেখেননি। তাদের এ মতের পক্ষে উত্থাপিত প্রমাণগুলোর কিছু এ পুস্তকদ্বয়ের মধ্যেই বিদ্যমান। লূকের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, স্বচক্ষে দেখা সাক্ষ্য ‘আমাদের নিকট হস্তান্তরিত হয়েছে’ এবং তিনি ‘সতর্ক অনুসন্ধান’ করার দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু লেখক তার নিজের নাম উল্লেখ করেননি। ‘আমরা’ বলে উল্লেখ করা বক্তব্যগুলো ছাড়া অন্য কোনো ঘটনা নিজে দেখেছেন বলে সুস্পষ্টভাবে দাবি করেননি। আর ‘আমরা’ বক্তব্যগুলোতেও বিবরণগুলো উত্তম পুরুষের বহুবচনে লেখা। লেখক কখনোই নিজের বিষয়ে ‘আমি’, ‘আমাকে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেননি। যারা মনে করেন যে, এ পুস্তকটার লেখক পুস্তকে বর্ণিত কোনো ঘটনাই স্বচক্ষে দেখেননি, তাদের মতে ‘আমরা’ বক্তব্যগুলো সাধারণত অন্য কোনো পুস্তকের খণ্ডতে অংশ হিসেবে বিবেচিত। এগুলো পূর্ববর্তী কোনো পুস্তকের অংশবিশেষ, পরবর্তীকালে লূক ও প্রেরিত পুস্তকদ্বয়ের লেখক যাকে ‘প্রেরিত’ পুস্তকের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। অথবা ‘আমরা’ বক্তব্যগুলো একান্তই গ্রিক ভাষার অলঙ্কার কৌশল যা সমুদ্রযাত্রায় ব্যবহার করা হত।’’[2]
এভাবে আমরা দেখছি যে, এ পুস্তকটাকে সাধু লূকের লেখা বলে দাবি করার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নেই। এ পুস্তকের তথ্যের সাথে নতুন নিয়মের অন্যান্য পুস্তকের তথ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন বরং প্রমাণ করে যে, এ পুস্তকটার লেখক পরবর্তী যুগের কোনো অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। এ পুস্তকের বিষয়ে প্রাচীন খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের কোনো বক্তব্য না থাকা প্রমাণ করে যে, পুস্তকটা খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শেষে বা পরে লেখা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, পুস্তকটা লূকের লেখা হোক আর পরবর্তী কারো লেখা হোক উভয় ক্ষেত্রেই তা সাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে লেখা। একে ওহী নির্ভর বা পবিত্র আত্মার প্রেরণালব্ধ গ্রন্থ বলে দাবি করা যায় না। কারণ লেখক পুস্তকের শুরুতে লেখেছেন:
‘‘হে মাননীয় থিয়ফিল, আমাদের মধ্যে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা যাঁরা প্রথম থেকে নিজের চোখে দেখেছেন এবং ঈশ্বরের সুখবর প্রচার করেছেন, তাঁরা আমাদের কাছে সবকিছু জানিয়েছেন, আর তাঁদের কথা মতই অনেকে সেই সব বিষয়গুলো পরপর লেখেছেন। সেই সব বিষয় সম্বন্ধে প্রথম থেকে ভালভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে আপনার জন্য তা একটা একটা করে লেখা আমিও ভাল মনে করলাম। এর ফলে আপনি যা জেনেছেন তা সত্যি কিনা তা জানতে পারবেন।’’ (লূক ১/১-৪: বাইবেল ২০০০ এর অনুবাদ)
ইঞ্জিল লেখকের এ বক্তব্য থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
(ক) যীশু ও প্রেরিতগণের ঘটনাবলি বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা কিছুই লেখেননি। তাঁরা মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে পরবর্তীদেরকে জানিয়েছেন।
(খ) তৎকালীন যুগে প্রচলিত সকল ‘ইঞ্জিল’ ও ‘ঘটনা বিবরণী’ পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের লেখা।
(গ) তাদের বিশ্বাস অনুসারে এ সকল লেখা কোনোটাই ঐশীপ্রেরণা নির্ভর বা ওহী নির্ভর ছিল না। এগুলো একান্তই মৌখিক বর্ণনার সংকলন ছিল। এগুলোতে ভুলভ্রান্তির সুযোগ ছিল এবং এজন্যই এগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল।
(ঘ) ‘লূক’ নামক গ্রন্থের লেখক- লূক অথবা পরবর্তী কেউ- এ পুস্তকটাকে ‘ঐশ্বরিক প্রেরণা’-র মাধ্যমে পাওয়া বলে দাবি করেননি। একান্তই ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো যাচাইবাছাই করে এ গ্রন্থটা লেখেছেন বলে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।
[2] উইকিপিডিয়: Authorship of the Bible/ Luke and Acts