লগইন করুন
ইঞ্জিলগুলো পাঠ করলে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, এগুলোর একটাও কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা নয়। ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে লেখক কোনো ঘটনা নিজে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেননি। বরং ইঞ্জিলগুলোর বক্তব্য নিশ্চিত করে যে, এগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কোনো লেখকের লেখা এবং বিভিন্ন মৌখিক বা লিখিত বর্ণনার উপর র্নিভর করে এগুলো লেখা হয়েছে। পাশ্চাত্য বাইবেল বিশেষজ্ঞরা সকলেই এটা নিশ্চিত করেছেন। বিষয়টা নিশ্চিত করে যে, যীশুর শিষ্যরা কেউ এগুলো লেখেননি।
সর্বোপরি, ইঞ্জিলগুলো সবই লেখকের নাম বিহীন পুস্তক। পুস্তকের কোথাও লেখকের পরিচয় সম্পর্কে কিছু নেই। পরবর্তী খ্রিষ্টানরা একান্তই আন্দাজের উপরে এগুলোকে বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা বলে মনে করেছেন।
নতুন নিয়মের মধ্যে ২৭টা পুস্তক বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর শুরুতে লেখক নিজের পরিচয় দিয়ে লেখনি শুরু করেছেন। যেমন ‘‘পৌল, যীশু খ্রিষ্টের দাস, আহূত প্রেরিত, ঈশ্বরের সুসমাচারের জন্য পৃথককৃত’’ (রোমীয় ১/১, ‘‘পৌল, ঈশ্বরের ইচ্ছামত যীশু খ্রিষ্টের আহূত প্রেরিত...’’ (১ করিন্থীয় ১/১), ‘‘ঈশ্বরের ও প্রভু যীশু খ্রিষ্টের দাস যাকোব...’’ (যাকোব ১/১), ‘‘পিতর, যীশু খ্রিষ্টের প্রেরিত’’ (১ পিতর ১/১) ইত্যাদি। এগুলোও তাঁদের নামে pseudonymous বা ‘পরনামী’ পুস্তক হতে পারে, অর্থাৎ অন্য কেউ লেখে তাঁদের নামে প্রচার করতে পারেন। আমরা দেখেছি যে, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীগুলোতে নিজে পুস্তক লেখে শিষ্যদের নামে প্রচার করা কোনো অন্যায় কর্ম বলে গণ্য ছিল না। তারপরও কোনো পুস্তকের শুরুতে কারো নাম থাকলে সেটাকে তার লেখা বলে ধরে নেওয়া হয় এবং তা প্রমাণ বা অপ্রমাণের জন্য গবেষণা করা হয়। তবে চার ইঞ্জিল, প্রেরিত, ইব্রীয় ইত্যাদি কয়েকটা পুস্তক ব্যতিক্রম। এগুলোর মধ্যে কোথাও লেখকের নাম বলা হয়নি। বিষয়টা নিশ্চিত করে যে, এ পুস্তকগুলো অজ্ঞাত পরিচয় লেখকদের লেখা।
এগুলোর মধ্যে ‘ইব্রীয়’ বা ‘ইবরানী’ পুস্তকটার বেনামিত্ব বর্তমানে স্বীকার করা হচ্ছে। বিগত প্রায় দু হাজার বছর পুস্তকটাকে পলের রচিত বলে দাবি করা হয়েছে। এখনো অধিকাংশ বাইবেলেই এটা পলের নামেই বিদ্যমান। কিং জেমস ভার্শন সহ অধিকাংশ ভার্শনে এ পুস্তকটার নাম: ‘‘ইব্রীয়দের/ হিব্রুদের প্রতি প্রেরিত পলের পত্র (The Epistle/ The Letter of Paul the Apostle to the Hebrews)। কিন্তু এর বিপরীতে রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন ও অন্যান্য কিছু ভার্শনে পলের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। এগুলোতে পুস্তকটার নাম: ‘‘ইব্রীয়দের প্রতি পত্র’’ (The Letter to the Hebrews)। বাংলা বাইবেলগুলোতে এরূপই দেখবেন। বাংলা ‘কিতাবুল মোকাদ্দসে’ এ পুস্তকটার ভূমিকায় স্বীকার করা হয়েছে যে, পুস্তকটার লেখক অজ্ঞাতপরিচয়।
উইকিপিডিয়ায় ‘বাইবেলের লেখকত্ব’ (Authorship of the Bible) প্রবন্ধের ‘নতুন নিয়ম’ (New Testament) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“The gospels (and Acts) are anonymous, in that none of them name an author. Whilst the Gospel of John might be considered somewhat of an exception, because the author refers to himself as "the disciple Jesus loved" and claims to be a member of Jesus' inner circle, most scholars today consider this passage to be an interpolation.”
‘‘ইঞ্জিলগুলো এবং কার্যবিবরণী বেনামি বা লেখকের নামবিহীন। পুস্তকগুলোর কোনোটাতেই লেখকের নাম নেই। যোহনের ইঞ্জিল কিছুটা ব্যতিক্রম বলে গণ্য হতে পারে। কারণ লেখক নিজের বিষয়ে বলেছেন যে, তিনি যীশুর ‘প্রিয়ভাজন শিষ্য’ এবং দাবি করেছেন যে, তিনি যীশুর অভ্যন্তরীণ বৃত্তের একজন সদস্য। বর্তমানে অধিকাংশ গবেষক এ বক্তব্যগুলোকে পরবর্তী সংযোজন বলে গণ্য করেন।’’[1]
প্রসিদ্ধ বাইবেল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এড প্যারিশ স্যান্ডার্স (Ed Parish Sanders) ও অন্যান্য গবেষক উল্লেখ করেছেন যে, দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে বিভিন্ন খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও চার্চপিতা প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। কিন্তু কেউই এগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট লেখকের নামে উল্লেখ করেননি। সবাই এগুলোকে নামবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। ১৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হঠাৎ করেই এগুলো বিভিন্ন লেখকের নামে প্রচারিত হতে শুরু করে। এ সময়ে অনেক ইঞ্জিল প্রচলিত হয়ে যায়। এজন্য কিছু ইঞ্জিলকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করতে এগুলোকে বিভিন্ন লেখকের নামে প্রচার করা শুরু হয়।
খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা দাবি করেন যে, প্রচলিত চার ইঞ্জিল ৬০ থেকে ৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের ধর্মগুরু ও চার্চপিতাদের অগণিত রচনা এখনো সংরক্ষিত। সেগুলোর আলোকে দেখা যাচ্ছে যে, পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে কোনো একজন খ্রিষ্টান ধর্মগুরু বা চার্চপিতা উল্লেখ করেননি যে, মথি, মার্ক, লূক বা যোহন কোনো ইঞ্জিল রচনা করেছেন। এমনকি দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে যারা এ সকল ইঞ্জিলের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন তারাও উল্লেখ করেননি যে, এগুলো মার্ক, মথি বা অন্য কারো রচিত। এটা প্রমাণ করে যে, দ্বিতীয় খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এ সকল ইঞ্জিল বেনামি ছিল। এরপর এগুলোকে বিভিন্ন লেখকের নামে প্রচার করা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে স্যান্ডার্স বলেন:
“It is unlikely that Christians knew the names of the authors of the gospels for a period of a hundred years or so, but did not mention them in any fo the surviving literature (which is quite substantial)”
‘‘প্রাচীন খ্রিষ্টান লেখকদের অনেক রচনাই এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান। কিন্তু তাদের কোনো লেখাতেই ইঞ্জিল লেখকদের নাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা অবিশ্বাস্য যে, খ্রিষ্টানরা এ সকল ইঞ্জিলের লেখকদের নাম জানতেন অথচ একশত বছর বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত কেউ তাদের নামগুলো উল্লেখ করবেন না।’’[2]
[2] E. P. Sanders, The Historical Figure of Jesus (1995) Penguin Books, England. Cited by Louy Fatoohi, The Mystery of the Historical Jesus, (2009), Islamic Book Trust, Malayasia.