লগইন করুন
আমরা দেখলাম যে, প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো কোনো অবস্থাতেই যীশুর ইঞ্জিল নয়। সর্বোচ্চ বিবেচনায় তা যীশুর ইঞ্জিলের অজ্ঞাতসূত্র অনুবাদ হতে পারে। তবে এর চেয়েও জোরালো সম্ভাবনা যে এগুলো মূলতই গ্রিকভাষী কিছু মানুষের রচিত নামহীন বা পরনামী পুস্তক, যা তারা লেখে যীশু বা তাঁর শিষ্যদের নামে চালিয়েছেন। তিনটা কারণে এ সম্ভাবনাটাই জোরালো:
প্রথমত: প্রথম যুগগুলোর খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করতেন যে, পবিত্র আত্মা তাদের সকলের কাছেই আগমন করেন। কাজেই প্রকৃতপক্ষে তারা সকলেই নবী পর্যায়ের। যোহনের ১৪ অধ্যায়ের ১৫-৩০ শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে যীশু শিষ্যদেরকে বলেন যে, যীশুর চলে যাওয়াই ভাল, কারণ তিনি না গেলে তাঁর পরের ‘সহায়’ আসতে পারবেন না। তিনি যেয়ে অন্য সহায়কে (another Paraclete) পাঠিয়ে দেবেন। পরবর্তী সহায় সত্যের আত্মা (the Spirit of truth)। তিনি তাদের সাথে থাকবেন এবং তাদের মধ্যেই থাকবেন (he dwelleth with you, and shall be in you)।
খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন যে, ‘সত্যের আত্মা’ বলতে এখানে ‘পবিত্র আত্মা’ (Holy Spirit) বুঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে মুসলিম গবেষকরা দাবি করেন যে, এটা মূলত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমন বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী। বিশেষত এখানে যীশু বলেছেন যে, তিনি না গেলে পরবর্তী সহায় সত্যের আত্মা আগমন করতে পারবেন না। এ কথাটা ‘পবিত্র আত্মার’ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে ‘পবিত্র আত্মা’ যীশুর পৃথিবীতে থাকা অবস্থাতেও বারবার পৃথিবীতে এসেছেন। (যেমন: মথি ১/১৮-১৯, ৩/১৬-১৭; মার্ক ১/১০; মূলক ৩/২১-২২ ইত্যাদি)
সর্বাবস্থায় এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন যে, পবিত্র আত্মা সকল খ্রিষ্টান এবং বিশেষত ধার্মিক খ্রিষ্টানদের সাথে এবং মধ্যেই বিরাজমান। তাদের মনের মধ্যে কিছু উদয় হলেই তাকে পবিত্র আত্মা বা ঈশ্বরের কথা মনে করতেন তাঁরা। মুসলিম সমাজে বিভিন্ন বিভ্রান্ত সম্প্রদায় কাশফ, ইলকা, ইলহাম ইত্যাদি বিষয়কে যেরূপ ঢালাও ব্যবহার করে এবং ধর্মের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তৎকালীন খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও ধার্মিক মানুষদের অবস্থা ছিল তদ্রূপ। পরবর্তী যুগগুলোতেও এ বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল।
এসনাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এ প্রসঙ্গে বলেছে: “Thus, the Spirit, which in the Old Testament had been viewed as resting only on special charismatic figures, in the New Testament became “democratized”—i.e., was given to the whole people of the New Covenant.” ‘‘পুরাতন নিয়মের দৃষ্টিতে ‘আত্মা’ শুধু বিশেষ ঐশ্বরিক শক্তিময় ব্যক্তিদের নিকটেই আসতেন। পক্ষান্তরে নতুন নিয়মে এসে ‘আত্মা’র গণতন্ত্রায়ণ ঘটে। নতুন নিয়মের সকল মানুষকেই তা প্রদান করা হল।’’[1]
এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে অগণিত ধার্মিক খ্রিষ্টান পবিত্র আত্মার প্রেরণা মনে করে যা ইচ্ছা তাই লেখে বেনামে বা যীশুর নামে বা প্রসিদ্ধ শিষ্যদের নামে প্রচার করেছেন।
দ্বিতীয়ত: খ্রিষ্টধর্মের প্রথম কয়েক শত বছর ধার্মিক খ্রিষ্টানরা কোনো সাধু বা নবীর নামে কোনো কথা লেখে প্রচার করাকে জালিয়াতি বলেই মনে করতেন না। সমাজের ধার্মিকরা কেউই একে কোনো অন্যায় বা অনুচিত কর্ম মনে করতেন না!
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature-এর বক্তব্য নিম্নরূপ:
As far as the New Testament is concerned, there could be no Bible without a church that created it; yet conversely, having been nurtured by the content of the writings themselves, the church selected the canon. ... Indeed, until c. AD 150, Christians could produce writings either anonymously or pseudonymously—i.e., using the name of some acknowledged important biblical or apostolic figure. The practice was not believed to be either a trick or fraud. ...
‘‘নতুন নিয়মের বিষয়টা হল, যদি চার্চ (ধর্মগুরুদের মণ্ডলী) বাইবেল তৈরি না করতেন তাহলে কোনো বাইবেলই থাকত না। অপরদিকে লেখনিগুলোর বিষয়বস্ত্তর ভিত্তিতে চার্চই বাইবেলের বইগুলো বাছাই করেছে। ... প্রকৃত বিষয় হল, ১৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যে কোনো খ্রিষ্টান নাম প্রকাশ না করে, অথবা কোনো প্রসিদ্ধ বাইবেলীয় ব্যক্তিত্ব বা যীশুর শিষ্যদের নামে বই লেখতে পারতেন। এরূপ কর্মকে ছলচাতুরি বা প্রতারণা বলে গণ্য করা হত না! ...’’
এ থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, মথি, মার্ক, লূক, যোহন ইত্যাদি নামে প্রচারিত ‘ইঞ্জিলগুলো’ মূলত দ্বিতীয় শতকে অজ্ঞাত পরিচয় লেখক কর্তৃক রচিত এ জাতীয় ‘anonymous’ নামবিহীন বা ‘pseudonymously’ বা ‘পরনামে লেখা’ পুস্তক।
তৃতীয়ত: প্রথম শতকেই খ্রিষ্টানরা দু’ ধারায় বিভক্ত হয়ে যান। প্রথম ধারায় ছিলেন সে সকল বনি-ইসরাইল যারা ইহুদি ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং যীশু খ্রিষ্টকে ইহুদি ধর্মের প্রতিশ্রুত মাসীহ হিসেবে বিশ্বাস করে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এদেরকে ইহুদীয়-খ্রিষ্টান বা হিব্রু-খ্রিষ্টান (Judeo Christaians/ Jewish Christians/ Hebrew Christians) বলা হয়। দ্বিতীয় ধারার পুরোধা ছিলেন সাধু পল। তাঁর অনুসারীদেরকে পলীয় খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী খ্রিষ্টান (Pauline Christaians) বা গ্রিক-হেলেনীয় খ্রিষ্টান (Greek-Helenistic Christians) বলা হয়। উভয় ধারার মধ্যে বিদ্যমান কঠিন মতভেদ এবং এক ধারার উপর অন্য ধারার বিজয় লাভের প্রচেষ্টার বিষয়টা মূল্যায়ন করলে এরূপ জালিয়াতির সম্ভাবনা আরো শক্তিশালী বরং নিশ্চিত হয়ে যায়।
যীশুর ঊর্ধ্বগমনের কয়েক বছর পর সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাকে অ-ইহুদি বা পরজাতিদের জন্য প্রেরিত বানিয়েছেন। (প্রেরিত ২৬/১৭; গালাতীয় ১/১৬, ২/৭-১০)। তিনি অ-ইহুদি বা গ্রিকভাষী পরজাতিদের মধ্যে ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যীশু খ্রিষ্টের নামে প্রচারিত তার নতুন ধর্মটা দ্রম্নত অ-ইহুদি গ্রিকভাষীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
যীশুর মূল অনুসারী ফিলিস্তিনের ইহুদিরা, যারা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন মূসার শরীয়ত পালনের পক্ষে। পক্ষান্তরে পল শরীয়ত মুক্ত ধর্মের প্রচারক ছিলেন। উভয় ধারার মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ বাড়তে থাকে। বাহ্যত এজন্য পল হিব্রু খ্রিষ্টানদের প্রচারিত ইঞ্জিলের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এজন্য তিনি বারবার বলেন, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ হিব্রু ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)।
অতি দ্রম্নতই অ-ইহুদি গ্রিকভাষীদের মধ্যে পলীয় খ্রিষ্টধর্ম বিস্তার লাভ করে এবং পলীয় বা গ্রিকরা (Pauline Christaians) হিব্রুদের (Judeo Christaians) উপর প্রাধান্য লাভ করেন। হিব্রুরা কোণঠাসা হয়ে যান। এ পর্যায়ে সাধু পলের অনুসারী গ্রিক-ভাষী খ্রিষ্টানরা যীশু খ্রিষ্টের ১০০/১৫০ বছর পরে পর্যন্ত ‘পবিত্র সাধুদের নামে’ নিজেদের মনগড়া ইঞ্জিল লেখতে থাকেন। তাঁরা সমাজে ঈসা মাসীহের নামে বহুল প্রচলিত সত্যগুলোর সাথে নিজেদের মনগড়া, মিথ্যা ও কাল্পনিক গল্প লেখে ‘অমুকের লেখা ইঞ্জিল’ নামে প্রচার করেন।
স্বভাবতই এ সকল পলীয় খ্রিষ্টান গ্রিকভাষী ছিলেন এবং হিব্রু ও আরামীয় ভাষার চেয়ে গ্রিক ভাষায় অধিক পারদর্শী ছিলেন এবং তাঁরা মূলত গ্রিকভাষীদের জন্যই লেখেছেন। এজন্য এ সকল ইঞ্জিল গ্রিক ভাষায় রচিত হয়েছে।