লগইন করুন
আরেকটা বিষয় নিশ্চিত করে যে, প্রথম শতাব্দীতে ইঞ্জিল তো দূরের কথা ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশু বিষয়ক তথ্যগুলোও প্রচলিত ছিল না। তা হল, খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল এবং খ্রিষ্টধর্মের অন্য প্রাণপুরুষ সাধু প্রথম ক্লিমেন্ট ইঞ্জিলে বর্ণিত যীশু বিষয়ক তথ্য, যীশুর শিক্ষা ও বক্তব্যগুলো কিছুই জানতেন না। যাকোব, পিতর ও অন্যদের পত্র থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর শিক্ষা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না।
পল (Paul)-এর জন্ম ৩ খ্রি. ও মৃত্যু আনু. ৬২ বা ৬৭ খ্রি.। আমরা দেখেছি, নতুন নিয়মের ২৭ পুস্তকের মধ্যে ১৪টাই তাঁর রচিত। তাঁর পত্রাবলি প্রমাণ করে যে, তিনি প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো তো দূরের কথা, এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান তথ্যাদি বা ইঞ্জিলীয় যীশু সম্পর্কেও কিছুই জানতেন না। পল তাঁর পত্রগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে তৎকালীন খ্রিষ্টান প্রচারকদের বিরুদ্ধে বিতর্ক করেছেন এবং নিজের মত প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করেছেন বা পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্ত কখনোই ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান যীশুর জীবন, কর্ম বা বক্তব্য থেকে প্রমাণ পেশ করেননি।
সাধু পল যে সকল মত প্রচার করেছেন সেগুলোর অন্যতম (১) অ-ইহুদিদের যীশুর ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার বৈধতা, (২) শনিবার, পানাহার ইত্যাদি বিষয়ে তৌরাত ও শরীয়ত পালনের অপ্রয়োজনীয়তা, (৩) বিবাহ বর্জন ও চিরকৌমার্যে উৎসাহ প্রদান।
এ তিনটা বিষয়েই ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে যীশুর সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। আমরা দেখব, ইঞ্জিলগুলো বলছে, যীশু পুনরুত্থানের পরে সকল শিষ্যকে সকল জাতির কাছে ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দেন। ইঞ্জিলগুলো বলছে, যীশু শনিবার বিষয়ে তৌরাতের বিধান অমান্য করতেন এবং খাদ্য বিষয়ে বলতেন: ‘‘মুখ দিয়ে যা ভিতরে যায় তা মানুষকে নাপাক করে না, বরং মুখ থেকে যা বের হয় তাই মানুষকে নাপাক করে।’’ (মথি ১৫/১১-২০) সাধু পল খ্রিষ্টধর্মের নামে তাঁর মত প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি পেশ করেছেন, কিন্তু কখনোই খ্রিষ্টের শিক্ষা থেকে প্রমাণ পেশ করেননি। অথচ খ্রিষ্টের শিক্ষা থেকে একটা বাক্য পেশ করলেই সকল বিতর্কের সমাধান হয়ে যেত। এতে আমরা নিশ্চিত হই যে, এ সকল বিষয়ে যীশুর কোনো শিক্ষা-ই তিনি জানতেন না।
যীশু নিজে চিরকুমার ছিলেন। তিনি ঈশ্বরের জন্য স্ত্রী-পরিজন পরিত্যাগ করতে, ঘৃণা করতে ও ঈশ্বরের জন্য ‘খোজা’ বা অবিবাহিত থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। পল বিবাহ বর্জন ও চিরকুমার থাকার পক্ষে অনেক কিছু লেখেছেন। তিনি বারবারই বলেছেন, তিনি চিরকুমার এবং কেউ যদি তার মত থাকতে পারে তবে সেটাই সর্বোত্তম। কিন্তু তিনি এক বারের জন্যও যীশুর এ সকল শিক্ষার উদ্ধৃতি দেননি। তিনি কখনোই বলেননি, প্রভু যীশুর মত চিরকুমার থাক, অথবা আমি যেভাবে প্রভু যীশুর অনুসরণ করছি সেভাবে তোমরাও কর। অথচ তাঁর সকল লেখা যীশুকে কেন্দ্র করেই। এ বিষয়টা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, যীশু নামে একজন ক্রুশে জীবন দিয়েছেন এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থিত হয়ে স্বর্গে গিয়েছেন - এ বিষয় ছাড়া যীশু সম্পর্কে পল কিছুই জানতেন না। ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে যে সকল তথ্য রয়েছে সেগুলোর কিছুই সাধু পল জানতেন না।
খৃস্টধর্মের অন্য প্রাণপুরুষ সাধু প্রথম ক্লিমেন্ট (Clement I)। এনকার্টা প্রদত্ত সাধু প্রথম ক্লিমেন্টের জীবনী ও পোপদের তালিকা অনুসারে ক্লিমেন্ট ৯২-১০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোমের পোপ ছিলেন এবং ১০১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পত্রাবলির গুরুত্ব সম্পর্কে সকল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় একমত। তবে তার পত্রাবলিকে নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। নতুন নিয়মের অনেক পাণ্ডুলিপি ও সংস্করণে তার পত্রগুলো সংযোজিত। সাধু ক্লিমেন্টের লেখনি প্রমাণ করে যে, প্রথম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত প্রচলিত চার ইঞ্জিল তো দূরের কথা এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান যীশুর জীবনী ও শিক্ষা খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল না। যীশুর বক্তব্য এবং সাধু পলের পত্রকে ক্লিমেন্ট ধর্মগ্রন্থ বা ঐশী গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করতেন না। উইকিপিডিয়া ‘স্বীকৃত-আইনসম্মত নতুন নিয়মের বিবর্তন’ (Development of the New Testament canon) প্রসঙ্গে লেখেছে:
“By the end of the 1st century, some letters of Paul were known to Clement of Rome ..., together with some form of the "words of Jesus"; but while Clement valued these highly, he did not regard them as "Scripture" ("graphe"), a term he reserved for the Septuagint. ..” ‘‘প্রথম শতকের শেষ প্রান্তে রোমের ক্লিমেন্ট ... পলের কিছু পত্রের সাথে পরিচিত ছিলেন। পাশাপাশি ‘যীশুর বাক্যাবলি’ জাতীয় কিছুর সাথেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ক্লিমেন্ট এগুলোকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেছেন। তবে তিনি এগুলোকে ‘পাক কিতাব’, শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেননি। ‘ঐশী গ্রন্থ’ বা ‘ধর্মগ্রন্থ’ পরিভাষাটা শুধু সেপ্টুআজিন্ট বা গ্রিক পুরাতন নিয়মের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।’’
The Christianity General forum-এর রবার্ট বয়ড (Robert Boyd) লেখেছেন:
“Paul's letters, written around 55-65 CE, fail to mention any Gospel miracle, act or major event concerning Christ's life, apart from the Eucharist and some vague references to the crucifixion and resurrection. He also fails to accurately quote any of Christ's teachings, as depicted in the Gospels. Clement, writing some 30 years later, does little better than Paul. While quoting extensively from the Old Testament, and offering numerous examples to illustrate his points from the lives of OT prophets and saints, Clement, like Paul, ignores the amazing life of Jesus Christ. Yet some 60 years later, Justin Martyr quotes extensive passages from the Gospels, including many of Christ's miracles, birth details etc (but fails to attribute such passages to any of the named Gospels). It was not until 180 CE that Iraeneus finally put names to all four Gospels, a full 150 years after Christ's death. This pattern is not what would be expected if in fact the gospel accounts had been written by the named authors, early after Christ's death and based on actual events. I suggest that the progressive and increasingly elaborate revelation of Christ, as witnessed through the letters of the church fathers, is more consistent with an evolving myth than with a story based on an actual, living Christ. The silence by Paul and Clement on the life of Christ is difficult to explain, apart from the possibility that they were ignorant of any such life. ...... From Clement, we glean nothing about the historical Christ or any of the events associated with him. We learn only that Christ shed his blood as a sacrifice. There are a few hints at Christ's teachings, but nothing accurately quoted from any named Gospels. Numerous examples are cited from the OT and from the lives of the apostles in order to illustrate principles of faith, love, persecution etc, but not one example from Christ's life whatsoever, apart from aspects concerning his death and resurrection. The only rational explanation is that Clement, like Paul, was ignorant of the life of any historical Christ.”
‘‘পলের পত্রগুলো ৫৫ থেকে ৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত। এ সকল পত্র ইঞ্জিলের মধ্যে উল্লেখকৃত যীশুর কোনো অলৌকিক কর্ম, কার্যাবলি বা যীশুর জীবনের বড় কোনো ঘটনা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু নৈশভোজ, ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুত্থান সম্পর্কে সাধারণ কিছু কথা এগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে যীশুর শিক্ষা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার কোনো কিছু সঠিকভাবে উদ্ধৃত করতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ক্লিমেন্ট তার পত্রগুলো আরো ত্রিশ বছর পরে লেখেছেন। তিনি পলের চেয়ে মোটেও ভাল করতে পারেননি। ক্লিমেন্ট পুরাতন নিয়ম থেকে ব্যাপক উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। তিনি তার বক্তব্যগুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করার জন্য পুরাতন নিয়মের নবী ও সাধুদের জীবন থেকে অনেক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। অথচ তিনি যীশু খ্রিষ্টের বিস্ময়কর জীবন পুরোপুরিই অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করেছেন। সাধু পলও এরূপই করেছেন। অথচ ৬০ বছর পর জাস্টিন মার্টার (১৬৫ খ্রি.) ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিষয়াদির ব্যাপকভাবে উদ্ধৃতি প্রদান করছেন। খ্রিষ্টের অনেক অলৌকিক কর্ম, জন্ম বৃত্তান্ত ইত্যাদি তিনি উল্লেখ করছেন (তবে তিনি এ সকল তথ্যের সূত্র হিসেবে ‘নাম-বিশিষ্ট’ কোনো ইঞ্জিলের কথা উল্লেখ করেননি)। খ্রিষ্টের মৃত্যুর পরে পূর্ণ ১৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আরিয়ানুস চারটা ইঞ্জিলের নাম উল্লেখ করেন।
প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো যাদের নামে প্রচলিত, যদি এগুলো সত্যই তাদের লেখা হত, খ্রিষ্টের মৃত্যুর অল্প সময় পরে লেখা হত এবং সত্য ঘটনার উপর নির্ভর করে লেখা হত তবে কখনোই বিষয়টা এরূপ হত বলে ধারণা করা যায় না।
প্রথম যুগের ধর্মগুরুদের পত্রের মধ্যে খ্রিষ্ট সম্পর্কীয় বর্ণনার ক্রমবর্ধমান বিবর্তন ও উত্তরোত্তর বিসত্মৃতি ঘটেছে। আমি মনে করি, তাদের বর্ণনাগুলোর সাথে প্রকৃত ঘটনা এবং বাস্তব খ্রিষ্টের মিল নেই। বরং এগুলো ক্রম বিবর্তনশীল কল্পকাহিনী বা রূপকথার সাথেই অধিক মিল সম্পন্ন। খ্রিষ্টের জীবন সম্পর্কে পল ও ক্লিমেন্টের নীরবতার ব্যাখ্যা করা কঠিন। একটা সম্ভাবনা মেনে নিলেই শুধু এর ব্যাখ্যা হয়। তা হল তারা এরূপ কোনো জীবনী সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। .....
ক্লিমেন্টের বক্তব্যের তলানি কুড়িয়েও আমরা যীশুর ঐতিহাসিক জীবনীর কিছুই খুঁজে পাই না। তাঁর জীবনের সাথে জড়িত কোনো ঘটনাও পাওয়া যায় না। ক্লিমেন্ট থেকে আমরা শুধু এতটুকুই জানতে পারি যে, যীশু উৎসর্গ হিসেবে তাঁর রক্তপাত করেছেন। খ্রিষ্টের শিক্ষা বিষয়ে সামান্য কিছু ইঙ্গিত বিদ্যমান। কিন্তু প্রচলিত ‘নাম-বিশিষ্ট’ ইঞ্জিলগুলোর কোনোটা থেকে কোনো নির্ভুল উদ্ধৃতি দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ধর্মবিশ্বাসের মূলনীতি, প্রেম, যন্ত্রণা, জুলুম ইত্যাদি ব্যাখ্যা করার জন্য পুরাতন নিয়ম থেকে অগণিত দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। শিষ্যদের জীবন থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। কিন্তু খ্রিষ্টের জীবন থেকে একটাও দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়নি, শুধু তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া। এর একটামাত্রই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। তা হল পলের মতই ক্লিমেন্টও ঐতিহাসিক কোনো যীশুর জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।’’[1]