লগইন করুন
পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, যীশু খ্রিষ্টের শিষ্যরা ও প্রশিষ্যরা যখন খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতেন তখন পুরাতন নিয়মের চূড়ান্ত রূপ যেমন ছিল না, তেমনি ‘নতুন নিয়ম’ বলেও কিছুই ছিল না।
বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হলেও বাস্তব। সাধারণত ধর্মের অনুসারীরা ধর্মপ্রবর্তক থেকে মূলত ধর্মগ্রন্থটাই গ্রহণ করেন। যেমন ইহুদিরা মূসা (আ.) থেকে তৌরাত গ্রহণ করেন। পরিবর্তন-বিবর্তন যাই হোক না কেন, মূসার সময় থেকেই ইহুদি সমাজে ‘তৌরাত’ প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টধর্মের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখা যায়। সকল খ্রিষ্টান পণ্ডিত একমত যে, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কোনো চার্চে কোনো গসপেল পঠিত হত অথবা প্রথম শতাব্দীর কোনো গসপেলের পাণ্ডুলিপির কোনো খণ্ডতে অংশ কোনো চার্চে পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায় না। এ সময়ে শিষ্যদের কিছু পত্র বা পুস্তক প্রসিদ্ধি লাভ করে, তবে ইঞ্জিলের কোনো খবর পাওয়া যায় না।
পরবর্তী আলোচনায় আমরা বিস্তারিত জানব যে, এর প্রধান কারণ ছিল দুটো:
প্রথমত: যীশু বারবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, শিষ্যদের জীবদ্দশায়ই কিয়ামত হবে। এজন্য শিষ্যরা যতটুকু সম্ভব প্রচার করেছেন। কিন্তু কিয়ামত যেহেতু খুবই সন্নিকট সেহেতু ধর্মগ্রন্থ লিখে রাখা অবান্তর বলে মনে করেছেন। নিজেরা প্রচারের জন্য যা কিছু প্রয়োজন লেখেছেন।
দ্বিতীয়ত: প্রথম শতাব্দীর খ্রিষ্টানরা নিজেদেরকে ইহুদি বলেই বিশ্বাস করতেন। ইহুদি ধর্মগ্রন্থকেই তাদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ বলে বিশ্বাস করতেন। পৃথক ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের চিন্তাই তারা করেননি। মূলত দ্বিতীয় খ্রিষ্টীয় শতকের শেষ দিকে সেন্ট আরিয়ানূস (Saint Irenaeus: 130AD-202AD) খ্রিষ্টধর্মকে পৃথক কিতাবী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু করেন। এজন্য প্রায় ২০০ বছরে প্রথম তিন/চার প্রজন্মের খ্রিষ্টানরা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন দেশে যীশুর নামে ধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউই যীশুর শিক্ষা বা সুসমাচারের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেননি বা সাথে রাখেননি। সবাই যা শুনেছেন বা বুঝেছেন তাই নিজের মনমত প্রচার করেছেন।
প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিশপ নিযুক্ত হয়েছেন। স্বভাবতই প্রত্যেক চার্চে অন্তত কয়েক কপি ‘ইঞ্জিল’ থাকার কথা ছিল। প্রত্যেক খ্রিষ্টানের নিকট না হলেও হাজার হাজার খ্রিষ্টানের মধ্যে অনেকের কাছেই ধর্মগ্রন্থ থাকার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃত বিষয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সকল বিশপের অনেকের অনেক চিঠি বা বই এখনো সংরক্ষিত আছে। তাতে অনেক উপদেশ রয়েছে। কিন্তু তাতে এ সকল ইঞ্জিলের কোনো উল্লেখই নেই।
এ সময়ের মধ্যে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, অনেক কথা লেখেছেন, সবই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল। কেউই তাকে ঐশ্বরিক প্রেরণা নির্ভর বলে মনে করেননি। নইলে প্রথম শতকের শেষভাগে মথি, মার্ক, লূক বা যোহন তার ইঞ্জিলটা লেখে সকল বিশপের নিকট পাঠিয়ে দিতে পারতেন এই বলে যে, ঈশ্বরের প্রেরণায় আমি এ ইঞ্জিলটা লেখলাম। একে মান্য করতে হবে।... কখনোই তারা তা করেননি। তৃতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত অগণিত পুস্তকের মধ্য থেকে তৎকালীন ধর্মগুরুরা নিজেদের যুক্তি ও পছন্দ অনুসারে কিছু পুস্তক বাছাই করে বিশুদ্ধ বা ‘ক্যাননিক্যাল’ বলে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এগুলোর মধ্যেও সংযোজন বিয়োজন অব্যাহত থেকেছে।