লগইন করুন
এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি এই যে, কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহর নাম ও সিফাতের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তা সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করা, আল্লাহর কোনো নাম, কর্ম বা বিশেষণকে সৃষ্টির নাম, কর্ম বা বিশেষণের সাথে তুলনা করা পরিহার করা এবং সাথেসাথে আল্লাহর নাম, কর্ম বা বিশেষণের সরল ও স্বাভাবিক অর্থের বাইরে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করা বর্জন করা। যেমন কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন। আবার পাশাপাশি মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, কথোপকথন, হস্ত, মুখমণ্ডল, আরশের উপর সমাসীন হওয়া, ক্রোধান্বিত হওয়া, সন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি বিশেষণ ও কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুজাস্সিমা বা মুশাবিবহা ফিরকা আল্লাহর এ সকল বিশেষণ সৃষ্টির বিশেষণের মত বলে কল্পনা করেছে। পক্ষান্তরে মু’তাযিলী, জাহমী, কাদারী ও অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকা মহান আল্লাহ সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন যুক্তিতে মহান আল্লাহর অন্যান্য সকল বিশেষণ ও কর্ম অস্বীকার করেছে। তারা বলে, মহান আল্লাহকে শ্রবণ, দর্শন, হস্ত, মুখমণ্ডল, আরশের উপর সমাসীন হওয়া, ক্রোধান্বিত হওয়া, কথা বলা ইত্যাদি বিশেষণ বা কর্মে বিশেষিত করার অর্থই হলো তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। কারণ সৃষ্টি শ্রবণ করে, কথা বলে, সমাসীন হয়, সৃষ্টির হস্ত আছে, মুখমণ্ডল আছে....। কাজেই কখনোই বলা যাবে না যে, মহান আল্লাহ এ সকল বিশেষণের অধিকারী। বরং তিনি এ সকল বিশেষণ থেকে পবিত্র। কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত এ সকল বিশেষণকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। যেমন তাঁর হস্ত অর্থ তাঁর ক্ষমতা বা করুণা, আরশের উপর সমাসীন হওয়ার অর্থ আধিপত্য লাভ করা। ক্রোধান্বিত হওয়ার অর্থ শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা করা, ইত্যাদি।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এ বিষয়ে ওহীর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পন করেন। তাঁরা সকল সিফাত বা বিশেষণ তার প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস করেন এবং বিশেষণের ধরণ ও পৃকৃতির বিষয় মহান আল্লাহর উপর ছেড়ে দেন। সাথে সাথে তাঁরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে, তাঁর এ সকল সিফাত বা বিশেষণ কোনোভাবেই সৃষ্টির বিশেষণের মত নয়। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:
لا يشبه شيئا من الأشياء من خلقه، ولا يشبهه شيء من خلقه. لم يزل ولا يزال بأسمائه وصفاته الذاتية والفعلية. أما الذاتية فالحياة والقدرة والعلم والكلام والسمع والبصر والإرادة، وأما الفعلية فالتخليق والترزيق والإنشاء والإبداع والصنع وغير ذلك من صفات الفعل. لم يزل ولم يزال بصفاته وأسمائه لم يحدث له صفة ولا اسم. ... وصفانه كلها بخلاف صفات المخلوقين. يعلم لا كعلمنا، ويقدر لا كقدرتنا، ويري لا كرؤيتنا، ويتكلم لا ككلامنا، ويسمع لا كسمعنا .... وله يد ووجه ونفس كما ذكره الله تعالي في القرآن. فما ذكره الله تعالي في القرآن من ذكر الوجه واليد والنفس فهو له صفات بلا كيف. ولا يقال: إن يده قدرته أو نعمته؛ لأن فيه إبطال الصفة. وهو قول أهل القدر والاعتزال، ولكن يده صفته بلا كيف، وغضبه ورضاه صفتان من صفات الله تعالي بلا كيف.
‘‘তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোনো কিছুর মত নয়। তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান রয়েছেন তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্ত্বার সাথে সংশ্লিষ্ট) ও ফি’লী (কর্মমূলক) সিফাতসমূহ-সহ। তাঁর যাতী বা সত্ত্বাগত সিফাতসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী বা কর্মবাচক সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ। তিনি তাঁর গুণাবলি এবং নামসমূহ-সহ তিনি অনাদি-অনন্তরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোনো নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটে নি। ... তাঁর সকল বিশেষণই মাখলূকদের বা সৃষ্টপ্রাণীদের বিশেষণের বিপরীত বা ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, তবে তাঁর জানা আমাদের জানার মত নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন, তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মত নয়। তিনি কথা বলেন, তবে তাঁর কথা বলা আমাদের কথার মত নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মত নয়। ... তাঁর ইয়াদ (হস্ত) আছে, ওয়াজহ (মুখমণ্ডল) আছে, নফস (সত্তা) আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলি উল্লেখ করেছেন। কুরআন কারীমে আল্লাহ যা কিছু উল্লেখ করেছেন, যেমন মুখমণ্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তার বিশেষণ কোনোরূপ ‘স্বরূপ’, কিরূপ, প্রকৃতি বা কিভাবে তা নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর ক্ষমতা অথবা তাঁর নিয়ামত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ বাতিল করে দেওয়া। এরূপ ব্যাখ্যা করা কাদারীয়া ও মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের মানুষদের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর বিশেষণ (সিফাত), কোনো স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দুটি বিশেষণ (সিফাত), আল্লাহর অন্যান্য বিশেষণের মতই, কোনোরূপ কিরূপ, কিভাবে বা কেমন করে প্রশ্ন করা ছাড়াই।[1]
মোল্লা আলী কারী বলেন:
وقال الإمام الأعظم رحمه الله في كتابه الوصية: "نقر بأن الله على العرش استوى، من غير أن يكون له حاجة إليه واستقرار عليه، وهو الحافظ للعرش وغير العرش، فلو كان محتاجا إليه لما قدر على إيجاد العالم وتدبيره كالمخلوق، ولو صار محتاجا إلى الجلوس والقرار فقبل خلق العرش أين كان الله تعالى؟ فهو منزه عن ذلك علوا كبيراً"، انتهى. ونعم ما قال الإمام مالك رحمه الله حيث سئل عن ذلك الاستواء، فقال: الاستواء معلوم، والكيف مجهول، والسؤال عنه بدعة، والإيمان به واجب
‘‘ইমাম আ‘যম (রাহ) তাঁর ‘ওসীয়াত’ নামক পুস্তকে বলেছেন: ‘‘আমরা স্বীকার ও বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন, আরশের প্রতি তাঁর কোনোরূপ প্রয়োজন ব্যতিরেকে এবং আরশের উপরে স্থিরতার প্রয়োজন ব্যতিরেকে। তিনি আরশ ও অন্য সবকিছুর সংরক্ষক। তিনি যদি আরশের মুখাপেক্ষী হতেন তাহলে বিশ্ব সৃষ্টি করতে ও পরিচালনা করতে পারতেন না, বরং তিনি মাখলূকের মত পরমুখাপেক্ষী হয়ে যেতেন। আর যদি তার আরশের উপরে উপবেশন করার বা স্থির হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে তবে আরশ সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কাজেই আল্লাহ এ সকল বিষয় থেকে পবিত্র ও অনেক অনেক ঊর্ধ্বে।’’
এ বিষয়ে ইমাম মালিক (রাহ) খুবই ভাল কথা বলেছেন। তাঁকে আল্লাহর আরশের উপরে সমাসীন হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: ‘‘সমাসীন হওয়ার বিষয়টি পরিজ্ঞাত, এর পদ্ধতি বা স্বরূপ অজ্ঞাত, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত এবং এ বিষয় বিশ্বাস করা জরুরী।’’[2]
ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন,
وتعالى عن الحدود والغايات، الأركان والأعضاء الأدوات، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات.. والعرش والكرسي حق. وهو مستغن عن العرش وما دونه. محيط بكل شيء وفوقه، وقد أعجز عن الإحاطة خلقه.
‘‘আল্লাহ্ সীমা-পরিধি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও উপাদান-উপকরণের বহু উর্ধে। যাবতীয় উদ্ভাবিত সৃষ্ট বস্ত্তর ন্যায় তাঁকে ষষ্ঠ দিক পরিবেষ্টন করতে পারে না। আল্লাহর আরশ ও কুরসী (আসন) সত্য। প্রতিটি বস্তুত তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সবকিছুর উর্ধে। সৃষ্টিজগত তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না।’’[3]
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ইফতিরাকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মতভেদীয় বিষয়ই মহান আল্লাহর তাওহীদুল আসমা ও সিফাত বিষয়ক। আর এ জাতীয় সকল বিষয়েই তাঁরা এ মুলনীতি অনুসরণ করেছেন।
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৭০।
[3] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০, ১৩।