লগইন করুন
উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পর অর্ধ শতাব্দী পার না হতেই নতুন প্রজন্মের মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভক্তির উন্মেষ ঘটে। তবে এদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। সাধারণ মুসলিমগণ সাহাবীগণের অনুসরণ করতেন। বিশেষ করে সাহাবীগণের সাহচার্য লাভকারী তাবিয়ীগণ সুদৃঢ়ভাবে সাহাবীগণের পথ অনুসরণ করতেন। কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের মতামতকে তারা সত্যের মাপকাঠি বলে গণ্য করতেন। সাহাবীগণ যা বলেন নি বা করেন নি তা বলা বা করা তাঁরা অন্যায় মনে করতেন। তাঁরা এ সকল বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টিকারীদেরকে ‘আহলুল বিদ‘আত’ বা ‘বিদ‘আত পন্থী’ বলে অভিহিত করতেন।
প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (মৃত্যু ১১০হি) বলেন:
لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنْ الإِسْنَادِ فَلَمَّا وَقَعَتْ الْفِتْنَةُ قَالُوا سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ فَلا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ
‘‘তাঁরা (সাহাবীগণ) হাদীসের সনদ বা তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতেন না। যখন (আলী (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ৩৫-৪০ হি) ফিতনা-ফাসাদ ঘটে গেল তখন তাঁরা বললেন: তোমাদেরকে যারা হাদীস বলেছেন তাদের নাম উল্লেখ কর। কারণ দেখতে হবে, তারা যদি আহলুস সুন্নাত বা সুন্নাত পন্থিগণের অন্তর্ভুক্ত হন তবে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে। আর তারা যদি আহলুল বিদ‘আত বা বিদ‘আত পন্থিগণের অন্তর্ভুক্ত হন তবে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে না।’’[1]
ইবনু সিরীন প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধের অনেক সাহাবীর সাহচার্য লাভ করেন। এখানে আমরা দেখছি যে, এ সময় থেকেই সাহাবীগণ ও তাবিয়ীগণ মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির ধারা দুটি নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথম ধারা ‘আহলুস সুন্নাত’ ও দ্বিতীয় ধারা ‘আহলুল বিদ‘আত’। মুসলিম উম্মাহর ইফতিরাক বা আকীদাগত বিভক্তি বুঝতে হলে এ পরিভাষাগুলি আমাদের বুঝতে হবে। আমরা এখানে বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
৬. ৫. ১. আহল
আহল (أهل) অর্থ পরিজন, জনগণ, অনুসারী (relatives, folks, people, members, followers) ইত্যাদি। এভাবে আমরা দেখছি যে আহলুস সুন্নাত অর্থ সুন্নাতের জনগণ বা সুনণাতের অনুসারী এবং আহলুল বিদ‘আত অর্থ বিদ‘আতের জনগণ বা বিদ‘আতের অনুসারী।
৬. ৫. ২. সুন্নাত - ৬. ৫. ২. ১. সুন্নাতের অর্থ ও পরিচয়
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, আভিধানিক ভাবে ‘সুন্নাহ’ বা ‘সুন্নাত’ শব্দের অর্থ: মুখ, ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদি। আর ইসলামী শরীয়তে ‘সুন্নাত’ অর্থ রাসূলে আকরাম (ﷺ) -এর কথা, কর্ম, অনুমোদন বা এক কথায় তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ।
৬. ৫. ২. ২. ইত্তিবায়ে সুন্নাতের গুরুত্ব
ইফতিরাক বিষয়ক হাদীসগুলিতে আমরা দেখেছি যে, নাজাত, মুক্তি, জান্নাত ও সত্যের মাপকাঠি ও একমাত্র পথ ‘সুন্নাতের অনুসরণ’। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবী ও হাওয়ারীদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন: (১) নবীর (ﷺ) সুন্নাত আঁকড়ে ধরা ও (২) তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করা। এ হাদীসে তিনি বিভ্রান্তদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন: (১) মুখের দাবির সাথে কর্মের অমিল এবং (২) অনির্দেশিত কর্ম। অন্য হাদীসে তিনি তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের মত ও পথের উপর থাককেই নাজাতের মানদন্ড বলে উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে রিসালাতের ঈমান প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণের গুরুত্ব ও অনুকরণের ব্যতিক্রমের ভয়াবহতা বিষয়ক অনেক আয়াত ও হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি এবং ইত্তিবায়ে সুন্নাতের গুরুত্ব জানতে পেরেছি। এ অধ্যায়ে বিদ‘আত প্রসঙ্গেও আমরা ইত্তিবায়ে সুন্নাতের গুরুত্ব জানতে পেরেছি।
৬. ৫. ২. ৩. সুন্নাতুস সাহাবা
আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনসারগণের নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করাকে জান্নাত ও সফলতার পথ বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের কর্ম ও মতের উপর থাকাকে হাদীসে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভক্তি ও মতভেদের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ মর্মে আরো অনেক নির্দেশনা কুরআন-হাদীসে রয়েছে। এক হাদীসে উতবা ইবনু গাযওয়ান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ أَيَّام الصَّبْر، للمتمسك فيهن يومئذ بما أنتم عليه أجر خمسين منكم. قالوا يَا نَبِيَّ اللَّهِ أَوَ مِنْهُمْ قَالَ بَلْ مِنْكُمْ
‘‘তোমাদের সামনে রয়েছে ধৈর্যের সময়, এখন তোমরা যে কর্মের উপর আছ সে সময়ে যে ব্যক্তি তোমাদের এ পদ্ধতি আকড়ে ধরে থাকবে, সে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর নবী, আমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সাওয়াব না তাদের মধ্যকার?’’ তিনি বলেন, ‘‘না, বরং তোমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সমপরিমাণ সাওয়াব।’’[2]
৬. ৫. ২. ৪. কর্ম ও বর্জনের সুন্নাত
‘আহলুস সুন্নাত’-এর পরিচয় বুঝতে হলে হাদীসে নববীতে এবং সাহাবী ও তাবিয়ীগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘সুন্নাত’ বলতে কী বুঝানো হয় তা জানতে হবে। এ বিষয়ে ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, কর্ম ও বর্জনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হুবহু অনুকরণই সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে কথা যেভাবে যতটুকু বলেছেন তা সেভাবে ততটুকুই বলা, যে কর্ম যেভাবে যতটুকু করেছেন সে কর্ম সেভাবে ততটুকু করা এবং তিনি যে কথা বলেন নি তা না বলা এবং যে কাজ করেন নি তা না করাই সুন্নাত।
তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণের ব্যতিক্রম করার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে এ বিষয়ক কয়েকটি হাদীস আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর হাদীসে তিনি বলেন: ‘‘...রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন: তুমি কি প্রতিদিন রোযা রাখ? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বলেন: তুমি কি সারা রাত জেগে নামায পড়? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: কিন্তু আমি তো রোযাও রাখি আবার মাঝে মাঝে বাদ দিই, রাতে নামায পড়ি আবার ঘুমাই, স্ত্রীদেরকে সময় প্রদান করি। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।... এরপর তিনি বলেন: প্রত্যেক আবেদের কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এই তীব্রতা এক সময় থেমে যায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার প্রশান্তি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। আর যার প্রশান্তি অন্য কিছুর দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’
এ হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো ‘কর্ম’ অনুসরণ পরিত্যাগ করেন নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাহাজ্জুদ আদায় করতেন এবং আব্দুল্লাহ (রাঃ)-ও তাঁর সুন্নাত অনুসরণ করে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নফল সিয়াম পালন করতেন এবং আব্দুল্লাহ (রাঃ)-ও তাঁর অনুসরণে নফল সিয়াম পালন করতেন। কেবলমাত্র পদ্ধতিগত সামান্য ব্যতিক্রম ছিল, তা হলো, তিনি এ দুটি নেক কর্ম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে বেশি করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় এবং সারামাস নফল সিয়াম আদায় বর্জন করতেন, কিন্তু আব্দুল্লাহ তা করতেন। মূল কর্ম সুন্নাত-সম্মত নেককর্ম হওয়া সত্ত্বেও কর্মের পাশাপাপশি বর্জনের ক্ষেত্রে বা পালনে ও বর্জনে হুবহু অনুসরণ না করার কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ (ﷺ)-এর কর্মে আপত্তি প্রকাশ করেছেন।
অন্য হাদীসে আমরা দেখেছি যে, তিন জন সাহাবী ইবাদতের আবেগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর চেয়ে অতিরিক্ত কিছু নফল ইবাদত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি তাদেরকে বলেন: ‘‘তোমরা কি এ ধরনের কথা বলেছ? তোমরা জেনে রাখ! আমি তোমাদের সকলের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি, তাকওয়ার দিক থেকে আমি তোমাদের সবার উপরে অবস্থান করি। তা সত্ত্বেও আমি মাঝেমাঝে নফল রোযা রাখি, আবার মাঝেমাঝে রোযা রাখা পরিত্যাগ করি। রাতে কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করি এবং কিছু সময় ঘুমাই। আমি বিবাহ করেছি, স্ত্রীদেরকে সময় প্রদান করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অপছন্দ করল তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’
এ হাদীসেও এ সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বর্জন করেন তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এজন্য তিনি তাদেরকে কঠিনভাবে নিষেধ করেন।
তাবিয়ী আবূ ওয়ায়িল বলেন, আমি পবিত্র কাবা গৃহের খিদমত ও সংরক্ষেণর দায়িত্বে নিয়োজিত সাহাবী শাইবা ইবনু উসমান (রাঃ)-এর নিকট বসেছিলাম। তিনি বলেন,
جَلَسَ إِلَيَّ عُمَرُ فِي مَجْلِسِكَ هَذَا فَقَالَ: لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ لا أَدَعَ فِيهَا صَفْرَاءَ وَلا بَيْضَاءَ إِلا قَسَمْتُهَا بَيْنَ الْمُسْلِمِينَ قُلْتُ مَا أَنْتَ بِفَاعِلٍ قَالَ لِمَ قُلْتُ لَمْ يَفْعَلْهُ صَاحِبَاكَ قَالَ هُمَا الْمَرْءَانِ يُقْتَدَى بِهِمَا
‘‘তুমি যেখানে বসেছ, উমার (রাঃ) তথায় বসে বললেন: ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কাবা ঘরের মধ্যে যুগযুগ ধরে সংরক্ষিত যত স্বর্ণ ও রৌপ্য রয়েছে তা কোনো কিছুই আমি রাখব না, বরং তা সবই আমি মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করে দেব।’ আমি বললাম, ‘আপনি তা করতে পারেন না।’ তিনি বললেন: ‘কেন?’ আমি বললাম, ‘কারণ আপনার সঙ্গীদ্বয় (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর ) তা করেন নি।’ তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ, তাঁরাই সে দুই মানুষ যাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে।’’[3]
এখানে উমার (রাঃ) অনুসরণ-অনুকরণ করা বলতে ‘না-করা’-য় বা ‘বর্জন করা’-য় অনুসরণ অনুকরণ করা বুঝাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গীদ্বয়, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) কিছুই করেন নি। কাবা ঘরের মধ্যে যুগ যুগ ধরে মানুষের দান, মানত ইত্যাদির স্বর্ণ-রৌপ্য সংরক্ষিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এগুলির বিষয়ে কিছুই করেন নি। যেমন ছিল তেমনি রেখে দিয়েছেন। তিনি এগুলি বণ্টন করেন নি এবং করতে নিষেধও করেন নি। এ বিষয়ে তিনি কোনো কিছু করা থেকে বিরত থেকেছেন। আবূ বাকর (রাঃ)-ও একইভাবে চলে গিয়েছেন। উমার (রাঃ)-এর অধিকার ছিল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। তিনি এ বিষয়ে কিছু করার চেয়ে কোনো কিছু করা বর্জন করে তাঁদের ‘অনুসরণ’ বা ইত্তিবা ও ইকতিদা করা উত্তম বলে মনে করেছেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কর্ম এবং বর্জন উভয়ই সুন্নাত। কর্মের ক্ষেত্রে যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হুবহু অনুকরণ করা সুন্নাত, তেমনি বর্জনের ক্ষেত্রেও তাঁর অনুকরণ করাই সুন্নাত। এমনকি যে বিষয়ে তিনি কোনে আপত্তি বা নিষেধ করেন নি, শুধু বর্জন করেছেন সে বিষয়েও অনুকরণ বলতে বর্জন করাই বুঝায়। তিনি যা করেন নি এবং নিষেধও করেন নি তা করা অবৈধ নাও হতে পারে, তবে তা করলে অনুকরণ করা হয় না।
তাবিয়ী নাফি‘ (রাহ) বলেন :
إنَّ رَجُلا عَطَسَ إِلَى جَنْبِ ابْنِ عُمَرَ فَقَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَالسَّلامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ، قَالَ ابْنُ عُمَرَ: وَأَنَا أَقُولُ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَالسَّلامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ وَلكِنْ لَيْسَ هَكَذَا عَلَّمَنَا رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) عَلَّمَنَا (إِذَا عَطَسَ أَحَدُنَا) أَنْ نَقُولَ الْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ
‘‘এক ব্যক্তি ইবনু উমরের (রাঃ) পাশে বসে হাঁচি দেয় এবং বলে: ‘আল-হামদু লিল্লাহ, ও আস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ (প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর রাসূলের উপর সালাম)।’ তখন ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, আমিও বলি: ‘আল-হামদুলিল্লাহ ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ’, তবে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আমাদেরকে (হাঁচি দিলে) এভাবে দোয়া পড়তে শেখাননি, তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, আমরা হাঁচি দিলে বলব: ‘‘আলহামদু লিল্লাহ আলা কুল্লি হাল (সকল অবস্থায় প্রশংসা আল্লাহর)।’’[4]
এখানে লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম পাঠ করা ইসলামের অন্যতম ইবাদত। ইহলৌকিত বরকত ও পারলৌকিক মুক্তি ও মর্যাদার জন্য তা অন্যতম মাধ্যম। এ বিষয়ে অনেক হাদীসে বিশেষ নির্দেশনা ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম সদা সর্বদা সালাত ও সালাম পাঠ করতে ভালবাসতেন। তাঁরা একান্তে, সমাবেশে সর্বদা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে নিজের মতো সালাত ও সালাম পড়তেন। সালাত ও সালাম পাঠের এত বেশি মর্যাদা ও সাওয়াব এবং এত বেশি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সাহাবী ইবনু উমর কেন হাঁচির পরে সালাম পাঠ অনুমোদন করছেন না? তাহলে কি কোনো কোনো সময়ে সালাত ও সালাম পাঠ নিষেধ করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)? তাহলে কি হাঁচির পরে দরুদ বা সালাম পাঠ নিষিদ্ধ? তা কখনোই নয়। এখানে ইবনু উমার (রাঃ) সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণ বা কর্ম ও বর্জনে হুবহু অনুসরণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আল্লাহর হামদ পাঠ ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর সালাম পাঠ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মুমিন সর্বদা তা পালন করবেন। তবে হাঁচির দু‘আ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাম পাঠ শেখান নি। তিনি এ সময়ে সালাম পাঠ বর্জন করেছেন। কাজেই এ দু‘আর মধ্যে তা বর্জন করাই সুন্নাত।
তাবিয়ী মুজাহিদ (রাহ) বলেন: আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমরের (রাঃ) সঙ্গে ছিলাম। এমন সময়ে এক ব্যক্তি যোহর বা আসরের সালাতের জন্য ডাকাডাকি করল। তখন তিনি বললেন :
اخْـرُجْ بِـنَا فَـإِنَّ هَـذِهِ بِـدْعَـةٌ
‘‘এখান থেকে বেরিয়ে চল, কারণ এটি একটি বিদ‘আত।’’[5]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সময়ে সালাতের জন্য শুধু আযান প্রদান করা হতো। এতেই সকল মুসলমান মসজিদে এসে উপস্থিত হতেন। পরবর্তী কিছু বছর পরে দেখা গেল অনেক এলাকায় মানুষেরা সালাতে আসতে অবহেলা করছে। তখন অনেক আগ্রহী মুয়াজ্জিন আযানের কিছুক্ষণ পরে আবার ডাকাডাকি করতেন বা জামাতের সময় হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করতেন। আযানের পরে ডাকাডাকি করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেন নি। তবে তিনি তা বর্জন করেছেন। হয়ত অনেক যুক্তি দিয়ে বলা যেত, তিনি অমুক কারণে তা বর্জন করেছেন, বর্তমানে অমুক কারণে তা করা প্রয়োজন। কিন্তু সাহাবীগণ এ সকল যুক্তির ভিতরে না যেয়ে কর্ম ও বর্জনে তাঁর হুবহু অনুকরণ পছন্দ করতেন এবং অতিরিক্ত কর্মকে বিদ‘আত বলে ঘৃণা করতেন। সাহাবীদের কাছে বড় হলো রাসূলে আকরাম (ﷺ) -এর রীতি। তাঁর বাইরে তাঁরা একটুও যেতে রাজি ছিলেন না।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন :
إِنَّ مِنْ أَبْغَضِ الأُمُوْرِ إِلَى اللهِ تَعَالَى الْبِدَعَ، وَإِنَّ مِنَ الْبِدَعِ الاعْتِكَافَ فِيْ الْمَسَاجِدِ الَّتِيْ فِيْ الدُّوْرِ
‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয় হলো বিদ‘আত। আর এ সকল বিদ‘আতের মধ্যে একটি হলো বাড়ির মধ্যে যে সালাতের স্থান বা ঘরোয়া মসজিদ থাকে সেখানে এতেকাফ করা।’’[6]
ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাড়ী বা মহল্লার ঘরোয়া মসজিদে ইতিকাফ নিষেধ করেন নি। এর স্বপক্ষে অনেক কথা বলা যায়। তবে তিনি তা বর্জন করেছেন। এজন্য সাহাবী তা বিদ‘আত বলে অভিহিত করেছেন।
৬. ৫. ২. ৫. হুবহু অনুকরণ
এভাবে আমরা দেখছি যে, সাহাবী-তাবিয়ীগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করেছেন তা করা যেমন সুন্নাত, তেমনি তিনি যা বর্জন করেছেন তা বর্জন করাও সুন্নাত। আর ‘কর্ম’ ও ‘বর্জন’ হুবহু ও অবিকল হলেই তা সুন্নাত হবে, সুন্নাতের সাথে কিছু সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন করে পালন বা বর্জন করেলে তা ইত্তিবায়ে সুন্নাত বলে গণ্য হবে না। এখানে আল্লামা ইবনু সীরীনেরই একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। প্রখ্যাত তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আবিদ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (মৃ ১৮১ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন :
دخل الصلت بن راشد على محمد بن سيرين وعليه جبة صوف وإزار صوف وعمامة صوف [فنظر إليه محمد نظرة كراهة] فاشمأز عنه محمد وقال إن أقواما يلبسون الصوف ويقولون قد لبسه عيسى بن مريم وقد حدثني من لا أتهم أن النبي (ﷺ) قد لبس الكتان والصوف والـقطن وسـنة نبينا أحق أن تتبع
‘‘সাল্ত ইবনু রাশিদ নামক একজন্য তাবি-তাবিয়ী দরবেশ পশমী জুববা, পশমী ইযার ও পশমী পাগড়ি পরিধান করে মুহাম্মাদ ইবনু সিরীনের নিকট প্রবেশ করেন। ইবনু সিরীন তাঁর পোশাক দেখে বিরক্ত হন। তিনি বিরক্তির সাথে তার দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং বলেন: কিছু মানুষ (সর্বদা) পশমি পোশাক পরিধান করেন। তাঁরা বলেন যে, ঈসা (আঃ) পশমি পোশাক পরিধান করতেন। অথচ যাদের বর্ণনা আমি সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণ করি সে সব মানুষেরা (সাহাবীগণ) আমাকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাতান, পশমি ও সুতি কাপড় পরিধান করেছেন। আর আমাদের নবীর সুন্নাত অনুকরণ করাই আমাদের জন্য বেশি প্রয়োজনীয় ও বেশি উচিত।’’[7]
ইমাম ইবনু সিরীন দরবেশগণের ‘সূফী’ বা ‘পশমি’ পোশাক পরিধানের বিষয়ে আপত্তি করে বলছেন যে, ঈসা নবীর সুন্নাতের চেয়ে আমাদের নবীর সুন্নাত অনুসরণ করা উচিত। আবার তিনি নিজেই স্বীকার করছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পশমি পোশাক পরিধান করতেন। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে যে, এসকল দরবেশ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতই অনুসরণ করছেন। তাহলে তাঁর আপত্তিটা কি?
আপত্তি অনুকরণের ‘হুবহুত্বে’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সামাগ্রিক কর্ম ও বর্জনের সমষ্টিই তাঁর সুন্নাত। তিনি যে কাজ যতটুকু ও যে গুরুত্ব দিয়ে করেছেন এবং যতটুকু ও যে গুরুত্ব দিয়ে বর্জন করেছেন সেই কাজ ততটুকুই করা ও বর্জন করাই সুন্নাত। কর্মে, বর্জনে বা গুরুত্বে তাঁর কাজের বিপরীত করার অর্থ তাঁর সুন্নাত বর্জন করা ও সুন্নাতের বিরোধিতা করা। ইবনু সিরীন এ কথাই বলেছেন।
তাঁর কথার অর্থ, কিছু মানুষ সর্বদা পশমী পোশাক পরিধান করেন। তাঁরা মনে করেন যে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সুতি পোশাক পরিধান বর্জন করে পশমি পরিধান উত্তম। এজন্য তাঁরা স্বেচ্ছায় সুতি পরিধান থেকে বিরত থাকেন এবং এ বর্জনকে তাকওয়া, দরবেশি বা বুজুর্গির পথ বলে মনে করেন। অথচ আমাদের নবীর সুন্নাত ছিল সুবিধা ও সুযোগমত সুতি বা পশমি পোশাক ব্যবহার করা। সুযোগ থাকলেও সুতি পোশাক বর্জন করে পশমি ব্যবহারের অর্থ রাসূলুললাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত বর্জন করা এবং তাঁর সুন্নাতকে দরবেশির জন্য যথেষ্ট বলে মনে না করা। এজন্যই ইবনু সিরীন বলছেন যে, আমাদের নবীর সুন্নাত অনুসরণ করা উত্তম ও উচিত। আর তাঁর সুন্নাত সর্বদা পশমি পোশাক না পরা।
প্রখ্যাত তাবেয়ী আবুল বাখতারী সাঈদ ইবনু ফাইরোয (৮৩ হি.) বলেন, মুস’আব যুবাইরী ইমামরূপে নামায শেষ করার পরে জোরে বলেন: ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’’। তখন তাবিয়ী-শ্রেষ্ঠ প্রসিদ্ধ ফকীহ আবীদাহ ইবনু আমর আস-সালমানী (৭০ হি.), যিনি মসজিদে ছিলেন, বলেন:
قَاتَلَهُ اللهُ! نِعَارٌ بِالْبِدَع
‘‘আল্লাহ একে ধ্বংস করুন! বিদ‘আতের জয়ধ্বনি দিচ্ছে।’’[8]
সালাতের সালাম ফেরানো পরে এরূপ যিকর, তাসবীহ ইত্যাদি সুন্নাত সম্মত ইবাদত। এ ব্যক্তি সুন্নাত সম্মত যিকরের বাক্য সুন্নাত সম্মত সময়ে পাঠ করে একটি সুন্নাত সম্মত ইবাদত পালন করেছেন। শুধু উচচস্বরে তা পালন করে যিকরটি পালনের পদ্ধতিতে সামান্য ব্যতিক্রম করেছে। এরূপ ব্যতিক্রমও তাঁরা গ্রহণ করতেন না। বরং একে বিদ‘আত বলে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন।
[2] মুহাম্মাদ ইবনু নাসর আল-মারওয়াযী, আস-সুন্নাহ, পৃ. ১৪; তাবারানী, আল-মু’জাম আল-কাবীর ১০/১৮২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/২৮২; আলবানী, সাহীহাহ ১/৮৯২-৮৯৩।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫৫; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৩/৪৫৬।
[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৮১; হাকিম, আল-মুস্তাদরাক ৪/২৬৫-২৬৬। হাকিম ও যাহাবী সহীহ বলেছেন।
[5] আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৪৮।
[6] সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা, ১৭ পৃ:।
[7] ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ ৬৪; ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৩৭; শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/১১০। বর্ণনাটির সনদ সহীহ।
[8] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ১/২৭০।