লগইন করুন
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, উৎসর্গ, জবাই, কুরবানী ইত্যাদি শিরক। জীবিত বা মৃত কোনো পীরের নামে, বাবার নামে, ওলীর নামে, তাঁর মাযারের নামে মানত করা, জবাই করা, মানত বা উৎসর্গের মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য পোষণ করা এ পর্যায়ের শিরক।
প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন আল-হাসকাফী (১০৮৮ হি) আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বলেন:
وَاعْلَمْ أَنَّ النَّذْرَ الَّذِي يَقَعُ لِلأَمْوَاتِ مِنْ أَكْثَرِ الْعَوَّامِ وَمَا يُؤْخَذُ مِنْ الدَّرَاهِمِ وَالشَّمْعِ وَالزَّيْتِ وَنَحْوِهَا إلَى ضَرَائِحِ الأَوْلِيَاءِ الْكِرَامِ تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ فَهُوَ بِالإِجْمَاعِ بَاطِلٌ وَحَرَامٌ مَا لَمْ يَقْصِدُوا صَرْفَهَا لِفُقَرَاء الأَنَامِ وَقَدْ اُبْتُلِيَ النَّاسُ بِذَلِكَ ، وَلا سِيَّمَا فِي هَذِهِ الأَعْصَارِ
‘‘জেনে রাখ, মৃতদের জন্য নযর-মানত যা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ করে থাকে এবং আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার-কবরের জন্য যে সব টাকাপয়সা, মোমবাতি, তেল ও অনুরূপ দ্রব্য গ্রহণ করা হয় তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য তা সবই বাতিল ও হারাম বলে ইজমা হয়েছে। যদি না তারা দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য তা ব্যয় করার মানত করে। মানুষেরা এরূপ নিষিদ্ধ নযর-মানতের মধে নিপতিত হয়েছে, বিশেষত বর্তমান যুগে।’’[1]
এর ব্যাখ্যায় আল্লমা ইবনু আবেদীন শামী (১২৫২ হি) ‘‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার’’ গ্রন্থে বলেন:
قَوْلُهُ (تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ ) كَأَنْ يَقُولَ يَا سَيِّدِي فُلانٌ إنْ رُدَّ غَائِبِي أَوْ عُوفِيَ مَرِيضِي أَوْ قُضِيَتْ حَاجَتِي فَلَكَ مِنْ الذَّهَبِ أَوْ الْفِضَّةِ أَوْ مِنْ الطَّعَامِ أَوْ الشَّمْعِ أَوْ الزَّيْتِ ... ( قَوْلُهُ بَاطِلٌ وَحَرَامٌ ) لِوُجُوهٍ: مِنْهَا أَنَّهُ نَذَرَ لِمَخْلُوقٍ وَالنَّذْرُ لِلْمَخْلُوقِ لا يَجُوزُ لأَنَّهُ عِبَادَةٌ وَالْعِبَادَةُ لا تَكُونُ لِمَخْلُوقٍ. وَمِنْهَا أَنَّ الْمَنْذُورَ لَهُ مَيِّتٌ وَالْمَيِّتُ لا يَمْلِكُ. وَمِنْهُ أَنَّهُ إنْ ظَنَّ أَنَّ الْمَيِّتَ يَتَصَرَّفُ فِي الأُمُورِ دُونَ اللَّهِ تَعَالَى وَاعْتِقَادَهُ ذَلِكَ كُفْرٌ
‘‘আওলিয়া কেরামের মাযারে তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য মানত করার ধরন এই যে, মানতকারী বলবে, হে অমুক হুজুর বা অমুক বাবা, যদি আমার হারানো ব্যক্তি ফিরে আসে বা আমার অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয় বা আমার হাজত পূর্ণ হয় তবে তোমার জন্য অমুক পরিমান স্বর্ণ, রৌপ্য, খাদ্য, মোমবাতি বা তেল দেব। এ প্রকারের মানত বাতিল ও হারাম হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে:
প্রথমত, তা মাখলূক বা সৃষ্টির জন্য নযর-মানত করা, আর কোনো সৃষ্টির জন্য মানত-নযর জায়েয নয়। কারণ মানত-নযর ইবাদত এবং কোনো মাখলুকের বা সৃষ্টির ইবাদত করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, যার জন্য মানত করা হয়েছে তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তি কোনো মালিকানা লাভ করতে পারে না।
তৃতীয়ত, এরূপ মানতকারী ধারণা করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া মৃত মানুষও কাজে কর্মে বা দুনিয়ার পরিচালনায় কিছু করতে পারেন, আর তার এ আকীদা কুফর।’’[2]
আল্লামা ইবনু নুজাইম (৯৭০ হি) ‘আল-বাহরুর রায়িক’ গ্রন্থেও একই কথা বলেছেন।[3]
যারা কবরে, মযারে আউলিয়ায়ে কেরামের নামে মানত বা জবাই করেন তাদের অনেকে মনে করেন যে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর নাম নিয়েই জবাই করছি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত করছি, কেবলমাত্র পশুটাকে বাবার বা ওলীর মাযারে এনে জবাই করছি, যেন তিনি সাওয়াব পান। এখানে প্রশ্ন হলো, যদি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত বা জবাই করা হয় তাহলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে জবাই করেই তো নিয়্যাত করা যেত যে, আল্লাহ এ সাদকার সাওয়াবটি অমুককে পৌঁছে দিন, এত কষ্ট করে পশুটি মাযারে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? মাজার ময়লা করতে?
বাহ্যত এ কষ্টের কারণ হলো, পৃথিবীর যে কোনো স্থানে জবাই করলে তো আল্লাহ পাবেন, কবরস্থ ওলী বা ‘বাবা’ সরাসরি পাবেন না, আল্লাহর মাধ্যমে পাবেন। আর মাযারে নিয়ে জবাই করলে এক ঢিলে দু পাখি মারা হবে, আল্লাহর প্রতি ভক্তিও প্রকাশ করা হবে এবং কবরস্থ ‘বাবার’ প্রতি ভক্তিও প্রকাশ করা হবে। যদিও দ্বিতীয়টিই মূল উদ্দেশ্য এবং সে জন্যই এত কষ্ট করা, তবে আল্লাহকে শরীক রাখলে অসুবিধা নেই, এতে ‘বাবা’ নারায হবেন না!!
এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী বলেন: ‘‘মহান্ আল্লাহ বলেছেন[4]: ‘‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না...।’’ যারা আল্লাহর ওলীগণের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এখানে তাদের নিন্দার প্রতি ইশারা করা হয়েছে; কারণ তারা বিপদে আপদে তাদের নিকট ত্রাণপ্রার্থনা করে এবং মহান আল্লাহর নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করা থেকে গাফিল থাকে এবং এ সকল ওলীর জন্য তারা নযর-মানত করে। তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা বলে, এ সকল ওলীরা হলেন আল্লাহর নিকট আমাদের ওসীলা। এবং বলে যে, আমরা আল্লাহর জন্যই নযর-মানত করি এবং এর সাওয়াব ওলীর জন্য প্রদান করি। এ কথা সুস্পষ্ট যে, তাদের প্রথম দাবির বিষয়ে তারা মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও মূর্তিপূজকদের মতই, যারা বলত[5]: আমরা এদের ইবাদত করি তো এজন্যই যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।’
তাদের দ্বিতীয় দাবিটি আপত্তিকর হবে না, যদি তারা এরূপ মানতের মাধ্যমে ওলীগণের নিকট থেকে তাদের অসুস্থব্যক্তিদের সুস্থতা, তাদের হারানো মানুষের প্রত্যাবর্তন বা অনুরূপ কোনো হাজত প্রার্থনা না করে। কিন্তু তাদের বাহ্যিক অবস্থা প্রমাণ করে যে, তারা এদের নিকট মানতের দ্বারা এরূপ কিছুই প্রার্থনা করে। এর প্রমাণ এই যে, তাদেরকে যদি বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহর জন্য মানত কর এবং এর সাওয়াব তোমাদের পিতামাতার জন্য দান কর, কারণ এ সকল ওলী-আওলিয়ার চেয়ে তোমাদের পিতামাতগণেরই সাওয়াবের প্রয়োজন বেশি, তবে তারা তা করবে না। আমি এদের অনেককে দেখেছি যে, তারা ওলীগণের কবরের পাথরের বেদিমূলে সাজদা করছে।
এদের অনেকে দাবি করে যে, সকল ওলীই তাদের কবরে বসে দুনিয়া পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের বেলায়াতের মর্তবা অনুসারে তাদের ক্ষমতার কমবেশি রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বিশ্ব পরিচালনা এরূপ ক্ষমতা ৪ বা ৫ জন কবরবাসীর জন্য সীমাবদ্ধ করেন। তাদের নিকট যদি প্রমাণ চাওয়া হয় তবে তারা বলেন, কাশফ দ্বারা তা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! এরা কত বড় জাহিল!! আর এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি কত ব্যাপক!!!
তাদের মধ্যে অনেকে দাবি করে যে, এ সকল ওলী-আউলিয়া তাদের কবর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করেন। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বলে, এ সকল ওলীর রূহ প্রকাশিত হয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায় এবং কখনো কখনো তারা বাঘ, সিংহ, হরিন বা অনুরূপ প্রাণীর আকৃতি ধারণ করে। এ সবই ভিত্তিহীন বাতিল কথা। কুরআন, সুন্নাহ এবং উম্মাতের প্রথম যুগে ইমামগণের কথার মধ্যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এ সকল মিথ্যাচারী মানুষে দীন-ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য বাতিল ও বিকৃত ধর্মের মানুষদের নিকটেও এরা হাসি-মস্করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি বাতিল মতবাদ ও নাস্তিকতার অনুসারীরাও এদের নিয়ে হাস্যকৌতুক করে। আমরা আল্লার নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।’’[6]
শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘কবর পূজারীদেরকে পীর পুরস্ত বা পীর পূজারীও বলা হয়। কবর পূজারী সম্প্রদায় কবর পূজাকে ফরয ইবাদত তথা নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি হইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সুন্নত ইবাদত ও অযীফা করার চেয়ে কবর পূজাকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ও সাওয়াবের কাজ মনে করে। তাই তাহারা কবর পূজাকে যে কোন প্রকার ইবাদতের পরিবর্তে করিয়া থাকে এবং ইহাকেই যথেষ্ট মনে করে। বস্ত্তত তারা কিন্তু কবর পূজার পরিবর্তে আল্লাহর কোন ইবাদতকে গুরুত্ব দেয় না এবং উহাকে যথেষ্ট মনে করে না। যখন কোন বুযর্গের উরশ বা মেলা ইত্যাদি হয় তখন সেখানে বহু দূর দূরান্ত হইতে বহু লোকের সমাগম হয়। এই ক্ষেত্রে কবর পূজারীরা সেই মেলায় উপস্থিত হওয়া ফরয ইবাদত মনে করে এবং অন্যান্য ফরয অর্জনকরার চেয়ে এটাকেই অধিক প্রয়োজন মনে করিয়া থাকে।
কবর পূজারীদের আমলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জঘন্যময় কাজ হইল যাবতীয় পাথিব বিপদাপদ ও সঙ্কটময় কাজের সমাধান হওয়ার জন্য কবরের নিকট গিয়া এমন বিনয়তা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সাথে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে যে, মসজিদে বা অন্য কোথাও আল্লাহকে হাযির নাযির মনে করিয়া উহার শত ভাগের এক ভাগও করে না। কবরে শায়িত বুযর্গের নাম ধরিয়া তাহাকে ডাকে এবং দোআ করে এবং তাহার নিকট জীবিকা ও সন্তানাদি কামনা করে। অত্যন্ত বিনয় ও মনযোগের সহিত মাথানত (করিয়া) কাপড়ের গেলাফ এবং চাদর লাগায়; কবরের উপর সুগন্ধি ছড়ায়। পূণ্যের কাজ মনে করিয়া লোবান, আগর বাতি জ্বালায় এবং কবরকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করে। এই অযথা কাজে পীরের আত্মাকে খুশী করার নিয়তে তাহার সানিধ্য লাভের চেষ্টা করে। আপাতঃদৃষ্টে দেখা যায় যে হিন্দু ও মুশরিক সম্প্রদায় তাহাদের প্রতিমার জন্য যেভাবে অর্চনা করিয়া থাকে ঠিক সেই ভাবেই এই কবর পূজারিগণও সেই সমস্ত কাজকে পুণ্যময় মনে করিয়া সম্পাদন করিয়া থাকে।’’[7]
[2] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯।
[3] ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক ২/৫২০।
[4] সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৩ আয়াত।
[5] সূরা (৩৯) যুমারের ৩ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
[6] আলূসী, রুহুল মা‘আনী ১৩/১৫৫।
[7] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ১৮।