লগইন করুন
দু‘আ (الدعاء) অর্থ আহবান করা, ডাকা, প্রার্থনা করা (call, pray, invoke)। ডাকা বা আহবান করা এবং প্রার্থনা করা পরস্পর জড়িত। কারো কাছে প্রার্থন করতে হলে তাকে ডাকা হয় এবং সাধারণত কারো ডাকার উদ্দেশ্য তার সাহায্য প্রার্থনা করা।
দু‘আ বা প্রার্থনার বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে দু‘আকে অনেক সময় ‘ইসতি‘আনাহ (الاستعانة) অর্থাৎ ‘আওন’ বা সাহায্য প্রার্থনা, ‘ইসতিম্দাদ’ (الاستمداد), অর্থাৎ ‘মদদ’ বা সাহায্য প্রার্থনা, ‘ইসতিগাসাহ’ (الاستغاثة) অর্থাৎ ‘গাউস’ বা ত্রাণ বা উদ্ধার প্রার্থনা ইত্যাদি বলা হয়। সবকিছুরই মূল ‘দু‘আ’।
প্রার্থনা করা বা ডাকার বিষয় বস্তুত দুই প্রকারের হতে পারে। এক প্রকার লৌকিক বা জাগতিক সাহায্য-সহযোগিতা যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে করতে পারে। এ সকল বিষয় প্রকৃতিগতভাবে একজন মানুষ আরেকজনের নিকট চেয়ে থাকে এবং মানুষ জাগতিকভাবে তা প্রদান করতে পারে। যেমন, কারো কাছে টাকাপয়সা চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, পানিতে পড়ে গেলে উঠানোর জন্য সাহায্য চাওয়া, মাথার বোঝা পড়ে গেলে উঠাতে সাহায্য চাওয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি অগণিত। জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস নির্বিশেষে সকলেই এ ধরনের সাহায্য প্রার্থনা করে।
দ্বিতীয় প্রকার প্রার্থনা বা ডাকা অলৌকিক বা অপার্থিব। জাগতিক মাধ্যম ও উপকরণ ছাড়া অলৌকিক সাহায্য, ত্রাণ ইত্যাদি প্রার্থনা করা। এ জাতীয় প্রার্থনা শুধুমাত্র কোনো ‘‘ধর্মের অনুসারী’’ বা ‘‘বিশ্বাসী’’ করেন। ‘‘বিশ্বাসী’’ কেবলমাত্র ‘আল্লাহ’, ‘ঈশ্বর’ বা সর্বশক্তিমান বলে যাকে বিশ্বাস করেন, অথবা যার সাথে ‘ইশ্বরের’ বিশেষ সম্পর্ক ও যার মধ্যে ‘ঐশ্বরিক’ ক্ষমতা আছে, তার কাছেই এরূপ প্রার্থনা করেন বা তাকেই এভাবে ডাকেন।
দ্বিতীয় প্রকারের এ প্রার্থনা বা ডাকাই ইবাদত-এর সার্বজনীন প্রকাশ। সকল যুগে সকল ধর্মের মানুষই মূলত তার আরাধ্য বা উপাস্যকে ডাকে ও তার কাছে প্রার্থনা করে অপার্থিব ও অলৌকিক সাহায্য লাভের জন্য। উৎসর্গ, কুরবানি (sacrifice), নযর, মানত, ফুল, সাজদা, গড়াগড়ি ইত্যাদি সবই মূলত দু‘আর জন্যই। যেন পূজিত ব্যক্তি বা বস্ত্ত এ সকল ভেট বা উৎসর্গে খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি প্রার্থনা পূরণ করেন বা হাজত মিটিয়ে দেন সে জন্যই বাকি সকল প্রকারের ইবাদত ও কর্ম। এভাবে আমরা দেখছি যে দু‘আই হলো ইবাদত-এর সর্বজনীন ও সর্বপ্রধান প্রকাশ।
নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, নবীজী (ﷺ) বলেন :
الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ
‘‘দু‘আ বা প্রার্থনাই ইবাদত।’’ একথা বলে তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করলেন[1]:
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
‘‘তোমাদের প্রভু বলেন: তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব বা তোমাদের প্রার্থনা পূরণ করব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদত থেকে অহঙ্কার করে (আমার কাছে প্রার্থনা না করে) তারা শীঘ্রই লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’[2]
দু‘আ, কেন্দ্রিক শিরকের বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রাহ) বলেন: ‘‘মুশরিকগণ আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নিকট হাজত বা প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করত। অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা, দরিদ্র ব্যক্তির সচ্ছলতা ইত্যাদি প্রয়োজনে তারা তাদের নিকট প্রার্থনা করত। এ সকল উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার জন্য তারা তাদের নামে মানত করত। তারা আশা করত যে, এ সকল মানতের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং বিপদাপদ কেটে যাবে। তারা বরকত লাভের উদ্দেশ্যে এ সকল উপাস্যের নাম পাঠ করত। একারণে আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা সালাতের মধ্যে বলবে:
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
‘‘আমরা শুধু তোমরই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’’[3]
মহান আল্লাহ বলেন:
فَلا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا
‘‘সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেক না।’’[4]
কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, এখানে ‘ডাকা’ অর্থ ‘ইবাদত’ করা। তাদের এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। স্পষ্টতই ‘ডাকা’ অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন[5]:
بَلْ إِيَّاهُ تَدْعُونَ فَيَكْشِفُ مَا تَدْعُونَ إِلَيْهِ إِنْ شَاءَ وَتَنْسَوْنَ مَا تُشْرِكُونَ
‘‘(বল, তোমরা ভেবে দেখ যে, আল্লাহর শাস্তি তোমাদের উপর আপতিত হলে, অথবা তোমাদের নিকট কিয়ামত উপস্থিত হলে তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকবে? যদি তোমরা সত্যবাদী হও?) বরং তোমরা শুধু তাকেই ডাকবে। তিনি ইচ্ছা করলে যে বিপদের জন্য তাকে ডাকবে তোমাদের সে বিপদ তিনি দূর করবেন এবং যাদেরকে তোমরা শরীক করতে তাদেরকে তোমরা ভুলে যাবে।’’[6]
যেহেতু দু‘আই ইবাদতের মূল প্রকাশ এবং এক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি শিরকে লিপ্ত হয় মানুষ, সেহেতু কুরআনে এই ইবাদতের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে বা একমাত্র তাঁরই কাছে দু‘আ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোথাও আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করার অসারতা বর্ণনা করা হয়েছে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়েছে, কোথাও মুশরিকরা যে তাদের উপাস্যদের ডাকত বা তাদের কাছে দুআ করার মাধ্যমে শিরক করত তা বারংবার বলা হয়েছে। কুরআনে দু-শতাধিক স্থানে এ ব্যপারে বলা হয়েছে।
একটি উদাহরণ থেকে আমরা লৌকিক ত্রাণ প্রার্থনা বা ডাকা এবং শিরকী ত্রাণ প্রার্থনা বা ডাকার মধ্যে পার্থক্য বুঝার চেষ্টা করি। মনে করুন আমার গরুটি পালিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে কোনো মানুষ দেখে বা কোনো মানুষ থাকতে পারে মনে করে চিৎকার করে বললাম, ভাই, আমার গরুটি একটু ধরে দেবেন! অথবা আমি পথ চিনতে পারছি না, তাই কোনো মানুষকে দেখে অথবা কোনো বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে মানুষ আছে অনুমান করে চিৎকার করে বলছি, ভাই অমুক স্থানে কোন দিক দিয়ে যাব একটু বলবেন!
এখানে আমি লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি। ঐ মানুষের মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব বা ঐশ্বরিক গুণ কল্পনা করছি না। ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিচয়ও আমার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমি জানি যে, স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ একটি গরু ধরতে পারে বা উক্ত স্থানের একজন বাসিন্দা স্বাভাবিকভাবে পথটি চিনবে বলে আশা করা যায়। এজন্য আমি তার থেকে এই লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি।
যদি কোথাও এই প্রকারের জাগতিক সমস্যা হয় এবং সেখানে কোনো মানুষজন না থাকে তাহলে উপস্থিত অদৃশ্য ফিরিশতাগণের নিকটও সাহায্য চাওয়া যেতে পারে বলে একটি দুর্বল সনদের হাদীস থেকে জানা যায়। মুমিন জানেন যে, আল্লাহর অগণিত ফিরিশতাগণ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন। এছাড়া অদৃশ্য সৃষ্টি জীনেরাও বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে। উপরের পরিস্থিতিতে যদি কোনো দৃশ্যমান মানুষকে না দেখে তিনি অদৃশ্য ফিরিশতা বা জ্বিনের কাছে লৌকিক সাহায্য চান তাহলে তা জায়েয হবে। কারণ তিনি কোনো নির্দিষ্ট সৃষ্টির মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা অলৌকিকত্ব কল্পনা করছেন না। তথায় কোন্ ফিরিশতা আছেন বা কোন্ জ্বিন রয়েছেন তাও তিনি জানেন না বা জানা তার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তিনি জানেন যে, এখানে কোনো ফিরিশতা বা জ্বিন থাকতে পারেন। আল্লাহর অন্য কোনো বান্দাকে দেখছি না, কাজেই এখানে উপস্থিত আল্লাহর অদৃশ্য বান্দাদের কাছে একটু সাহায্য চেয়ে দেখি কী হয়। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন :
إِنَّ لِلهِ عَزَّ وَجَلَّ مَلاَئِكَةً سِوَى الْحَفَظَةِ يَكْتُبُوْنَ مَا سَقَطَ مِنْ وَّرَقِ الشَّجَرِ فَإِذَا أَصَابَ أَحَدَكُمْ عَرْجَةٌ بِأَرْضِ فَلاَةٍ فَلْيُنَادِ أَعِيْنُوا عِبَادَ اللهِ يَرْحَمُكُمُ اللهُ تَعَالَى
‘‘বান্দার সাথে তার সংরক্ষণে নিয়োজিত ফিরিশতাগণ ছাড়াও আল্লাহর অনেক ফিরিশতা আছেন যারা সারা বিশ্বে কোথায় কোন গাছের পাতা পড়ছে তাও লিখেন। যদি তোমাদের কেউ কোনো নির্জন প্রান্তরে আটকে পড়ে বা অচল হয়ে পড়ে তাহলে সে ডেকে বলবে: হে আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদের রহমত করুন।’’[7]
এ প্রকার লেŠকিক বা জাগতিক সাহায্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে যদি কেউ অনুপস্থিত কাউকে ডাকেন বা অনুপস্থিত কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তাহলে তা শিরক হবে। যেমন, কারো রিকশা উল্টে গেছে বা গাড়িটি খাঁদে পড়েছে, তখন স্বাভাবিক লৌকিক কর্ম যে, সে কাউকে দেখতে পাক বা না পাক, সে চিৎকার করে সাহায্য চাইবে: কে আছ একটু সাহায্য কর। এখানে সে লৌকিক সাহায্য চাচ্ছে। কিন্তু যদি সে এ সময়ে সেখানে অনুপস্থিত কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে ডাকতে থাকে তাহলে সে শিরকে লিপ্ত হবে। কারণ সে মনে করছে, অনুপস্থিত অমুক ব্যক্তি সদা সর্বদা সবত্র বিরাজমান বা সদা সর্বদা সকল স্থানের সবকিছু তার গোচরিভূত। কাজেই, তিনি দূরবর্তী স্থান থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন বা আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন এবং দূর থেকে অলৌকিকভাবে আমার বিপদ কাটিয়ে দেওয়ার মতো ‘‘অলৌকিক’’ ক্ষমতা তার আছে। এভাবে সে একটি নির্দিষ্ট সৃষ্টির মধ্যে অলৌকেকত্ব, ঐশ্বরিক শক্তি বা মহান আল্লাহর গুণাবলী আরোপ করে শিরকে নিপতিত হয়েছে। এছাড়াও সে মহান আল্লাহর ক্ষমতাকে ছোট বলে মনে করেছে।
এ প্রার্থনাকারী বা আহবানকারী ঐ বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে যে ক্ষমতা কল্পনা করেছে তা একান্তভাবেই মহান আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। এ প্রাথনাকারী এই গুণাবলীকে শুধুমাত্র আল্লাহর বলে মনে করে না। সে বিশ্বাস করে যে, এই ক্ষমতার মধ্যে আল্লাহর শরীক আছে। এই ক্ষমতাটি যেমন আল্লাহর আছে, তেমনি অমুক ব্যক্তিরও আছে। তবে সে সম্ভবত তার কল্পনার মানুষটির ক্ষমতাকে এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ক্ষমতার চেয়ে বেশি বা দ্রুত বলে বিশ্বাস করে। এজন্যই সে আল্লাহকে না ডেকে তাকে ডেকেছে। এক্ষেত্রে মুশরিকদের দাবি যে, এ সকল খাজা বাবা, সাঁই বাবা, মা, সান্তা, সেন্ট, ফিরিশতা বা জ্বিনদেরকে আল্লাহই ক্ষমতা প্রদান করেছেন। ক্ষমতা মূলত আল্লাহরই, তিনি এদেরকে কিছু বা সকল ক্ষমতা প্রদান করেছেন। শিরকের হাকীকাত বিষয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রাহ)-এর বক্তব্যে আমরা তা দেখেছি।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২১১; আবু দাউদ, আস-সুনান ২/৭৬; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৫৮; ইবনু হিববান, আস-সুনান ৩/১৭২; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৬৭। হাদীসটি সহীহ।
[3] সূরা (১) ফাতিহা: ৪ আয়াত।
[4] সূরা (৭২) জিন্ন: ১৮ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আনআম: ৪০-৪১ আয়াত।
[6] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৮৫।
[7] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৬/৯১, আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ ৯/১৭৭, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১০/২১৭, ১৭/১১৭, বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ১/১৩৮, ৬/১২৮, হাইসামী, মাজমাউয় যাওয়াইদ ১০/১৩২, মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ১/৩০৭, শওকানী, তুহফাতুয যাকিরীন, পৃ. ১৫৫, আলবানী, যায়ীফাহ ২/১০৮-১১০, নং ৬৫৫, যায়ীফুল জামিয়, পৃ. ৫৫, ৫৮, নং ৩৮৩, ৪০৪। হাদীসটির সনদ যয়ীফ।