লগইন করুন
৪. ৬. ১. তাকদীরে বিশ্বাসের অর্থ
‘কাদ্র’ ও ‘কাদার’ (القَدْرُ والقَدَرُ) শব্দ মূলত পরিমাপ, পরিমান, মর্যদা, শক্তি ইত্যাদি বুঝায়। তাকদীর অর্থ পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা, সীমা নির্ণয় করা ইত্যাদি।[1] ইসলামের পরিভাষায় ‘ঈমান বিল কাদার’ (الإيمان بالقَدَر) অর্থ আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যপী জ্ঞান, তাঁর ইচ্ছা এবং তাঁর নির্ধারণ বা তাক্বদীরে বিশ্বাস করা। এ বিশ্বের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টির জন্য যে সুশৃঙ্খল নিয়ম, কার্যপ্রণালী বা ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাকেই তাক্বদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ বলা হয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, এই বিশ্বের ভাল মন্দ, আনন্দ, কষ্টের যা কিছু ঘটে তা সবই আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে। তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছার বাইরে কিছুই সংঘটিত হয়না। সবকিছুই আল্লাহ নির্ধারিত ‘পরিমাপ’ বা ‘ক্বাদার’-এর মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ
‘‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধাারিত পরিমাপে।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
اللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثَى وَمَا تَغِيضُ الأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ
‘‘প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জনেন এবং তাঁর বিধানে প্রত্যেক বস্ত্তরই এক নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ আছে।’’[3]
অন্যত্র তিনি বলেন:
وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلا عِنْدَنَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّلُهُ إِلا بِقَدَرٍ مَعْلُومٍ
‘‘আমারই নিকট আছে প্রত্যেক বস্তুর ভান্ডার এবং আমি তা পরিজ্ঞাত পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি।’’[4]
তাকদীরে বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনেক মতভেদ ও বিভ্রান্তি জন্ম নেয়। এখানে তাকদীরে বিশ্বাসের মূল বিষয়গুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
৪. ৬. ২. তাকদীরে বিশ্বাসের বিষয়াবলি
তাকদীরে বিশ্বাসের অর্থ নিম্নের ৫টি বিষয়ে বিশ্বাস করা:
৪. ৬. ২. ১. আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞানে বিশ্বাস
মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ। কোনো সৃষ্টির জ্ঞানের সাথে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনা হয়না। সৃষ্টির আগেই তিনি বিশেবর সকল বিষয় কোথায় কিভাবে সংঘটিত হবে সবই জানেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো পরিবর্তন নেই।
৪. ৬. ২. ২. আল্লাহর লিখনে বিশ্বাস
ইসলামী বিশ্বাসের অংশ হলো যে, আল্লাহ তাঁর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও সর্বব্যাপী জ্ঞান ‘কিতাবে মুবীন’ (সুস্পষ্ট কিতাব) বা ‘লাওহে মাহফুজে’ (সংরক্ষিত পত্রে) লিখে রেখেছেন। লিখনের প্রকৃতি আমরা জানিনা। কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন:
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لا يَعْلَمُهَا إِلا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلا يَعْلَمُهَا وَلا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلا رَطْبٍ وَلا يَابِسٍ إِلا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
‘‘অদৃশ্যের কুঞ্জি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত; তাঁর অজ্ঞাতসারে একটা পাতাও পড়ে না; মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোনো শস্য কণাও নেই অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্ত্ত নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’’[5]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَمَا تَتْلُو مِنْهُ مِنْ قُرْآَنٍ وَلا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفِيضُونَ فِيهِ وَمَا يَعْزُبُ عَنْ رَبِّكَ مِنْ مِثْقَالِ ذَرَّةٍ فِي الأَرْضِ وَلا فِي السَّمَاءِ وَلا أَصْغَرَ مِنْ ذَلِكَ وَلا أَكْبَرَ إِلا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
‘‘তুমি যে কোন কর্মে রত হও এবং তুমি তৎসম্পর্কে কুরআন হতে যা আবৃতি কর এবং তোমরা যে কোন কাজ কর, আমি তোমাদের পরিদর্শক যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও । আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ ও তোমার প্রতিপালকের অগোচর নয় এবং তা অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর অথবা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’’[6]
অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে:
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
‘‘ভূপৃষ্টে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই; তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে।’’[7]
আল্লাহ তাবারাকা ও তা‘আলা আরো বলেন:
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالأرْضِ إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘‘তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা অবগত আছেন? এ সকলই আছে এক কিতাবে; ইহা আল্লাহর নিকট সহজ।’’[8]
তিনি আরো বলেন:
وَمَا مِنْ غَائِبَةٍ فِي السَّمَاءِ وَالأرْضِ إِلا فِي كِتَابٍ مُبِين
‘‘আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন রহস্য নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’’[9]
অন্যত্র তিনি বলেন:
لا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ وَلا أَصْغَرُ مِنْ ذَلِكَ وَلا أَكْبَرُ إِلا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে তার অগোচর নয় অণূ পরিমাণ কিছু কিংবা অদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু, বরং এসবের প্রত্যেকটিই (লিপিবদ্ধ) আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’’[10]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَاجًا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَى وَلا تَضَعُ إِلا بِعِلْمِهِ وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُعَمَّرٍ وَلا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلا فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘‘আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা হতে, অতঃপর তোমাদেরকে করেছেন যুগল! আল্লাহর অজ্ঞাতসারে কোন নারী গর্ভধারণ করে না এবং প্রসবও করে না। কোন দীর্ঘায়ু ব্যক্তির আয়ু বৃদ্ধি করা হয় না অথবা তার আয়ু হ্রাস করা হয় না, কিন্তু তা তো রয়েছে ‘কিতাবে’। তা আল্লাহর জন্য সহজ।’’[11]
অন্যত্র তিনি বলেন:
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الأَرْضِ وَلا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
‘‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই কিতাবে (লিপিবদ্ধ) থাকে; আল্লাহর পক্ষে এ খুবই সহজ।’’[12]
তিনি আরো বলেন:
لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ يَمْحُوا اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ
‘‘প্রত্যেক বিষয়ের নির্ধারিত কাল লিপিবদ্ধ। তিনি যা ইচ্ছা মুছে ফেলেন আর যা ইচ্ছা রেখে দেন, আর তার কাছেই আছে উম্মুল কিতাব বা মূল গ্রন্থ।’’[13]
৪. ৬. ২. ৩. আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস
কুরআন ও হাদীসের নির্দেশে আমরা বিশ্বাস করি যে, এই মহাবিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয় তা সবই আল্লাহর ইচ্ছায় ও তার জ্ঞানে। তাঁর ইচ্ছা ও জ্ঞানের বাহিরে এই মহাবিশ্বের কোথাও সামান্যতম কোনো ঘটনাও ঘটেনা। কুরআন কারীমে বারংবার তা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَا تَشَاءُونَ إِلا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا يُدْخِلُ مَنْ يَشَاءُ فِي رَحْمَتِهِ وَالظَّالِمِينَ أَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
‘‘তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু জালিমরা তাদের জন্য তো তিনি প্রস্ত্তত করে রেখেছেন মর্মন্তুদ শাস্তি।’’[14]
إِنْ هُوَ إِلا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
‘‘এ তো শুধু বিশ্ব-জগতের জন্য উপদেশ। তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায় তার জন্য। তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।’’[15]
৪. ৬. ২. ৪. আল্লাহর সৃষ্টিতে বিশ্বাস
মুমিন বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি ছাড়া সবই সৃষ্ট। মানুষের কর্মও আল্লাহ সৃষ্টি করেন। কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لا إِلَهَ إِلا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
‘‘এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক; তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই; তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা; সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদাত কর; তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।’’[16]
أَمْ جَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ خَلَقُوا كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
‘‘তবে কি তারা আল্লাহর এমন শরীক করেছে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করেছে, যে কারণে সৃষ্টি তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে! বল, আল্লাহ সকল কিছুর স্রষ্টা; তিনি এক, পরাক্রমশালী।’’[17]
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُون
‘‘এবং আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তা।’’[18]
[2] সূরা (৫৪) কামার: ৪৯ আয়াত।
[3] সূরা (১৩) রা’দ: ৮ আয়াত।
[4] সূরা (১৫) হিজর: ২১ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ৫৯ আয়াত।
[6] সূরা (১০) ইউনূস: ৬১ আয়াত।
[7] সূরা (১১) হূদ: ৬ আয়াত।
[8] সূরা (২২) হাজ্জ: ৭০ আয়াত।
[9] সূরা (২৭) নামল: ৭৫ আয়াত।
[10] সূরা (৩৪) সাবা: ৩ আয়াত।
[11] সূরা (৩৫) ফাতির: ১১ আয়াত।
[12] সূরা (৫৭) হাদীদ: ২২ আয়াত।
[13] সূরা (১৩) রা’দ: ৩৮-৩৯ আয়াত।
[14] সূরা (৭৬) ইনসান (দাহর): ৩০-৩১ আয়াত।
[15] সূরা (৮১) তাকবীর: ২৭-২৯ আয়াত।
[16] সূরা (৬) আন‘আম: ১০২ আয়াত।
[17] সূরা (১৩) রা’দ: ১৬ আয়াত।
[18] সূরা (৩৭) সাফ্ফাত: ৯৬ আয়াত।