লগইন করুন
ইসমাত (العصمة) শব্দটি ‘আসামা’ (عَصَمَ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত, যার অর্থ নিষেধ করা, সংরক্ষন করা বা হেফাযত করা (to hold back, restrain, curb, check, prevent, guard, safeguard, protect)। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ
‘‘হে রাসূল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষদের থেকে রক্ষা করবেন।[1]
ইসমাতুল আম্বিয়া বলতে নবীগণের অভ্রান্ততা বা নিষ্পপত্ব (sinlessness, infallibility) বুঝানো হয়। নবীগণকে আল্লাহ সংরক্ষণ করেন বা হেফাযত করেন, ফলে তাঁরা বিভ্রান্তি বা পাপের মধ্যে নিপতিত হন না। কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, সকল নবী-রাসূলই আল্লাহর মনোনীত নিষ্কলুষ নিষ্পাপ প্রিয় বান্দা ছিলেন। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার ঘোষণা করেছেন যে, নবীগণ বিশেষভাবে আল্লাহর রহমত, হেদায়াত ও মনোনয়ন প্রাপ্ত। মহান আল্লাহ বলেন:
اللَهُ أَعلَمُ حَيثُ يَجعَلٌ رِسالَتَهُ
‘‘আল্লাহ উত্তম জানেন কোথায় তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব অর্পন করবেন।’’[2]
এ থেকে বুঝা যায় যে, বিশেষ মনোনীত ও নিষ্কলুষ নিষ্পাপ ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আল্লাহ এ দায়িত্ব প্রদান করেন না। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا
‘‘এরা নবীগণের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ প্রদান করেছেন, তারা আদমের ও যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভুত, ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশোদ্ভুত ও যাদেরকে আমি পথ-নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলম।’’[3]
আল্লাহ বারংবার নবীগণকে পবিত্র, একনিষ্ঠ, সৎ ইত্যাদি বিশেষণে ভুষিত করেছেন।[4] সর্বোপরি মহান আল্লাহ মানব জাতিকে নবী-রাসূলদের ‘ইত্তিবা’ বা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশও প্রমাণ করে যে, তাঁরা ‘নিষ্পাপ’ ছিলেন। কারণ যার থেকে পাপ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাকে নিঃশর্ত ‘ইত্তিবা’ করার নির্দেশ আল্লাহ দিবেন না।
কুরআন ও হাদীসের এ সকল নিদের্শনার আলোকে মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাস এই যে, নবীগণ সকলেই আল্লাহর বিশেষ করুণাপ্রাপ্ত ও প্রিয় বান্দা ছিলেন। তারা সবাই পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তারা সবাই নিষ্পাপ ছিলেন সকল প্রকার পাপ বা অন্যায় থেকে মুক্ত ছিলেন। মানবীয় ভুলত্রুটি ছাড়া কোনো পাপে তারা কখনও লিপ্ত হননি।
ইসমাতুল আম্বিয়া বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:
الأنبياء كلهم مُنَزَّهُون عن الصغائر والكبائر والكفر والقبائح، وقد كانت منهم زلات وخطيئات. ومحمد (ﷺ) نببه، وعبده ورسوله، وصفيه ونقيه، ولم يعبد الصنم ولم يشرك بالله تعالي طرفة عين قط، ولم يرتكب صغيرة ولا كبيرة قط.
‘‘নবীগণ সকলেই সগীরা গোনাহ, কবীরা গোনাহ, কুফ্র ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন। তবে কখনো কখনো সামান্য পদস্খলন ও ভুলত্রুটি তাদের ঘটেছে। এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নবী, তাঁর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁর মনোনিত নির্বাচিত, তাঁর বাছাইকৃত। তিনি কখনো মুর্তির ইবাদত করেন নি এবং কখনোই এক পলকের জন্যও আল্লাহর সাথে শিরক করেন নি। তিনি কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা কোনো প্রকারের পাপে লিপ্ত হন নি।’’[5]
‘আল-আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ’-এর লেখক আল্লামা উমর ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭হি.) নবীগণের (আঃ)-এর বিষয়ে বলেন:
كلهم كانوا مخبرين مبلغين عن الله تعالى صادقين ناصحين للخلق
‘‘তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশদাতা ও কল্যাণকামী ছিলেন।’’[6]
এ কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী (৭৯১হি), শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ গ্রন্থে বলেন:
في هذا إشارة إلى أن الأنبياء معصومون عن الكذب خصوصا فيما يتعلق بأمر الشرائع وتبليغ الأحكام وإرشاد الأمة. أما عمداً فبالإجماع. وأما سهواً فعند الأكثرين. وفي عصمتهم عن سائر الذنوب تفصيل. وهو أنهم معصومون عن الكفر قبل الوحي وبعده بالإجماع. وكذا عن تعمد الكبائر عند الجمهور، خلافاً للحشوية... وأما سهواً فجوَّزه الأكثرون. أما الصغائر فيجوز عمداً عند الجمهور خلافا للجبائي وأتباعه، ويجوز سهواً بالاتفاق، إلا ما يدل على الخسة، كسرقة لقمة، والتطفيف بحبة. لكن المحققون اشترطوا أن ينبهوا عليه فينتهوا عنه. وهذا كله بعد الوحي، وأما قبله فلا دليل على امتناع صدور الكبيرة. وذهبت المعتزلة إلى امتناعها لأنها توجب النفرة المانعة عن اتباعهم فتفوت مصلحة البعثة. والحق منع ما يوجب النفرة، كعهر الأمهات والفجور، والصغائر الدالة على الخسة. ومنعت الشيعة صدور الصغيرة والكبيرة قبل الوحي وبعده، لكنهم جوزوا إظهار الكفر تقية. وإذا تقرر هذا فما نقل عن الأنبياء عليهم السلام مما يشعر بكذب أو معصية فما كان منقولاً عن طريق الآحاد فمردود، وما كان بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره إن أمكن، وإلا فمحمول على ترك الأولى، أو كونه قبل البعثة.
‘‘এতে ইশারা করা হয়েছে যে, নবীগণ বিশেষভাবে শরীয়তের বিষয়ে, দীনের আহকাম প্রচারের বিষয়ে ও উম্মাতকে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে মা’সূম বা নির্ভুল ও সংরক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করেন না সে বিষয়ে সকলেই একমত এবং অধিকাংশের মতে এক্ষেত্রে তাঁরা অনিচ্ছাকৃত বা বেখেয়ালেও কোনো ভুল করতে পারেন না। অন্যান্য সকল পাপ থেকে তাদের মা’সূম বা নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ: মুসলিম উম্মাহর ইজমা বা ঐকমত্য এই যে, নবীগণ ওহী বা নুবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে কুফ্রী থেকে সংরক্ষিত বা মা’সূম। অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মা’সূম। হাশাবিয়া সম্প্রদায় এ বিষয়ে মতভেদ করেছে (তারা নবীগণ কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সম্ভব বলেছে।) .... আর ইচ্ছাকৃত সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশের মত এই যে, তা সম্ভব। তবে মুতযিলী নেতা আল-জুবাঈ[7] ও তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে মতভেদ করেছে (তাদের মতে নবীগণের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়)। আর নবীগণের জন্য অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সকলের মতেই সম্ভব, তবে যে সকল সগীরা গোনাহ নীচতা প্রমান করে তা তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়, যেমন এক লোকমা খাদ্য চুরি করা, একটি দানা ওযনে কম দেওয়া, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে (সগীরা গোনাহের ক্ষেত্রে) মুহাক্কিক আলিমগণ শর্ত করেছেন যে, নবীগণকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা তা বর্জন করেন। এ সবই ওহী বা নুবুওয়াত প্রাপ্তির পরের বিষয় (তাঁরা কবীরা বা সগীরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে করতে পারেন বা পারেন না বিষয়ক উপরের মতভেদ সবই নবীগণের নুবুওয়াত প্রাপ্তির পরের পর্যায়ের ক্ষেত্রে।)
নুবুওয়াত প্রপ্তির পূর্বে নবীগণ থেকে কবীরা গোনাহ প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব বলে কোনো দলীল নেই। মু’তাযিলাগণ মতপ্রকাশ করেছেন যে, নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও নবীগণ কর্তৃক কবীরা গোনাহ সংঘটিত হতে পারে না; কারণ এর ফলে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি অভক্তি সৃষ্টি হয়, যা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সত্য কথা এই যে, যে কর্ম তাঁদের প্রতি অভক্তি সৃষ্টি করে তা তাঁরা করতে পারেন না, যেমন, মাতৃগণের সাথে অনাচার, অশ্লীলতা ও নীচতা জ্ঞাপক সগীরা গোনাহ। শীয়াগণ মনে করেন যে, নবীগণ থেকে নুবুওয়াতের পূর্বে ও পরে কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা গোনাহ প্রকাশিত বা সংঘটিত হতে পারে না। তবে তাঁরা তাকিয়্যাহ বা আত্মরক্ষামূলকভাবে কুফ্র প্রকাশ করা সম্ভব বলে মতপ্রকাশ করেছে।
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বুঝতে পারি যে, নবীগণের (আঃ) বিষয়ে যদি এমন কিছু বর্ণিত হয় যা থেকে বুঝা যায় যে, তাঁরা কেউ মিথ্যা বলেছেন বা পাপ করেছেন, তবে সেক্ষেত্রে নিম্নের মূলনীতি অনুসরণ করতে হবে: যদি এরূপ বিষয় খাবারুল ওয়াহিদ পর্যায়ে বর্ণিত হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। আর এ জাতীয় যা কিছু মুতাওয়াতির পর্যায়ে বর্ণিত তা সম্ভব হলে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ গ্রহণ করতে হবে, অথবা মনে করতে হবে যে, তাঁরা সেক্ষেত্রে অধিকতর উত্তম বিষয় পরিত্যাগ করে বৈধ বিষয় গ্রহণ করেছেন অথবা তা নুবুওয়াতের পূর্বে ঘটেছিল।’’[8]
মোল্লা আলী কারী বলেন, ইবনুল হুমাম বলেছেন: আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য মত এই যে, নবীগণ কবীরা গোনাহ থেকে সংরক্ষিত, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছকৃতভাবে একক সগীরা গোনাহ করে ফেলা থেকে সংরক্ষিত নন। আহলুস সুন্নাতের কেউ কেউ নবীদের ক্ষেত্রে ভুল করাও অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। সঠিকতর বা সহীহ কথা এই যে, কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব। সার কথা এই যে, আহলুস সুন্নাতের সকলেই একমত যে, নবীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিষিদ্ধ কর্ম করতে পারেন না। তবে অসতর্কতা বা ভুলের কারণে যা ঘটে তা পদস্খলন বলে অভিহিত।[9]
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ১২৪ আয়াত।
[3] সূরা (১৯) মারইয়াম: ৫৮ আয়াত।
[4] দেখুন: সূরা নিসা: ৬৯, সূরা আনআম:৮৪-৯০, সূরা মারইয়াম: ৪১-৫৮।
[5] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৯৯-১০১।
[6] সা'দ উদ্দীন তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন-নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ৩১৯।
[7] আবূ আলী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব আল-জুবাঈ (৩০৩ হি)। তিনি মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রসিদ্ধ আলিম ও নেতা ছিলেন। মু’তাযিলাদের একটি সম্প্রদায়ের বা উপদলের নাম ‘জুবাইয়্যাহ’ যারা তার অনুসারী ছিলেন। দেখুন, বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ১৮৩-১৮৪।
[8] সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ৩১৯-৩২১।
[9] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৪-১০৫।