লগইন করুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলমুল গাইবের দাবির আরেকটি পরিভাষা তাঁকে ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করা। হাযির-নাযির দুইটি আরবী শব্দ। (حاضر) হাযির অর্থ উপস্থিত। (ناظر) নাযির অর্থ দর্শক, পর্যবেক্ষক বা সংরক্ষক। ‘হাযির-নাযির’ বলতে বোঝান হয় ‘সদাবিরাজমান ও সর্বজ্ঞ বা সবকিছুর দর্শক’। অর্থাৎ তিনি সদা-সর্বদা সবত্র উপস্থিত বা বিরাজমান এবং তিনি সদা সর্বদা সবকিছুর দর্শক। স্বভাবতই যিনি সদাসর্বত্র বিরাজমান ও সবকিছুর দর্শক তিনি সর্বজ্ঞ ও সকল যুগের সকল স্থানের সকল গাইবী জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘হাযির-নাযির’ দাবি করেন, তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি শুধু সর্বজ্ঞই নন, উপরন্তু তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
এখানেও কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত, এই গুণটি শুধুমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ আল্লাহ বারংবার এরশাদ করেছেন যে, বান্দা যেখানেই থাক্ তিনি তার সাথে আছেন, তিনি বান্দার নিকটে আছেন... ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কে কখনোই ঘুনাক্ষরেও কুরআন বা হাদীসে বলা হয় নি যে, তিনি সর্বদা উম্মাতের সাথে আছেন, অথবা সকল মানুষের সাথে আছেন, অথবা কাছে আছেন, অথবা সর্বত্র উপস্থিত আছেন, অথবা সবকিছু দেখছেন। কুরআনের আয়াত তো দূরের কথা একটি যয়ীফ হাদীসও দ্ব্যর্থহীনভাবে এই অর্থে কোথাও বর্ণিত হয় নি। কোনো একটি সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি বলেছেন ‘আমি হাযির-নাযির’। অথচ তাঁর নামে এ মিথ্যা কথাটি বলা হচ্ছে। এমনকি কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা ইমাম কখনোই বলেন নি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাযির-নাযির’।
দ্বিতীয়ত, কুরআন-হাদীসে বারংবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গোপন জ্ঞানের অধিকারী নন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করা উক্ত সকল স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করা।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন হাদীসে তিনি বলেছেন, উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কবরে উপস্থিত করা হয়। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হাযির-নাযির বলে দাবি করার অর্থ হলো, এ সকল হাদীস সবই মিথ্যা। উম্মাতের দরুদ-সালাম তাঁর কাছে উপস্থিত হয় না, বরং তিনিই উম্মাতের কাছে উপস্থিত হন!! কাজেই যারা এ দাবিটি করছেন, তাঁর শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। উপরন্তু তাঁরা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করেন, নাঊযু বিল্লাহ!
চতুর্থত, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলমুল গাইব ও সদাসর্বদা সর্বত্র বিরাজমান হওয়ার মত পোষণ করেছেন, তারা একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ফযীলত বা মর্যাদা বিষয়ক মতামত হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বরং একে মুমিনের ঈমানের অংশ বলে দাবি করেছেন।
ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, দশাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, ওফাতের পরে মহাবিশ্বের সর্বত্র বা সকল উম্মাতের কাছে ‘হাযির-নাযির’ থেকে তাদের সকল পরিবর্তন বা অন্যায়-অপকর্ম অবলোকন করার ঝামেলা মহান আল্লাহ তাঁকে দেন নি। অনুরূপভাবে কুরআনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, অতীত উম্মাতগুলির নিকটও তিনি উপস্থিত বা হাযির-নাযির ছিলেন না। আল্লাহ বলেন:
ذَلِكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ
‘‘এ গাইবের সংবাদ যা আমি ওহীর মাধ্যমে তোমাকে অবহিত করছি। মার্য়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে তার জন্য যখন তারা কলম নিক্ষেপ করছিল তখন তুমি তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না।’’[1]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَى مُوسَى الأمْرَ وَمَا كُنْتَ مِنَ الشَّاهِدِينَ ... وَمَا كُنْتَ ثَاوِيًا فِي أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِنَا وَلَكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا
‘‘মূসাকে যখন আমি বিধান দিয়েছিলাম তখন পশ্চিম প্রান্তে তুমি উপস্থিত ছিলে না এবং তুমির শাহিদ বা প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলে না। ... তুমি তো মাদয়া্নবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিলে না তাদের নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করার জন্য। আমিই তো ছিলাম রাসূল প্রেরণকারী। মূসাকে যখন আমি আহবান করেছিলাম তখন তুমি তূর পর্বতের পার্শে উপস্থিত ছিলে না...।’’[2]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
ذَلِكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ
‘‘এ গাইবের সংবাদ যা তোমাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি। ষড়যন্ত্রকালে যখন তারা মতৈক্যে পৌঁছেছিল তখন তুমি তাদের সংগে ছিলে না।’’[3]
আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনী, সীরাত, সাহাবীগণের কর্ম, মতামত ইত্যাদি সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান আছে তিনিও বুঝতে পারেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তিনি নিজে কখনো কোনোভাবে দাবি করেন নি যে, তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বা সকল উম্মাতের কাছে ‘হাযির-নাযির’ বা তাদের কাছে উপস্থিত থেকে তাদের সব কিছু দেখছেন। অনুরূপভাবে সাহাবীগণও কখনোই এরূপ কোনো কথা কল্পনা করেন নি।
তাদের এ মতের পক্ষে পেশকৃত দলিলগুলি নিম্নরূপ:
স্বভাবতই কুরআন কারীম বা হাদীস শরীফ থেকে কোনো একটি সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যও তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন না। বিভিন্ন আয়াত বা হাদীসের ব্যাখ্যা বা ব্যাখ্যা-ভিত্তিক যুক্তি-তর্কই তাদের দলিল। তাঁদের এ জাতীয় দলিল-প্রমাণাদির মধ্যে রয়েছে:
প্রথম দলীল: কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘শাহিদ’ ও ‘শাহীদ’ (شاهد وشهيد) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[4] এই শব্দ দুইটির অর্থ ‘সাক্ষী’, ‘প্রমাণ’, ‘উপস্থিত’ (witness, evidence, present) ইত্যাদি। সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুফাস্সিরগণ এই শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে (ﷺ) দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে ও সাক্ষীরূপে প্রেরণ করেছেন। যারা তাঁর প্রচারিত দ্বীন গ্রহণ করবেন, তিনি তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। এছাড়া পূর্ববর্তী নবীগণ যে তাদের দীন প্রচার করেছেন সে বিষয়েও তিনি এবং তাঁর উম্মাত সাক্ষ্য দিবেন। অনেকে বলেছেন, তাঁকে আল্লাহ তাঁর একত্বের বা ওয়াহদানিয়্যতের সাক্ষী ও প্রমাণ-রূপে প্রেরণ করেছেন।[5]
এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক স্থানে মুমিনগণকেও মানব জাতির জন্য ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[6] অনেক স্থানে আল্লাহকে ‘শাহীদ’ বলা হয়েছে।[7]
যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী’ বা ‘হাযির-নাযির’ বলে দাবি করেন তাঁরা এই ‘দ্ব্যর্থবোধক’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ গ্রহণ করেন। এরপর সেই অর্থের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কুরআনের সকল সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী বাতিল করে দেন। তাঁরা বলেন, ‘শাহিদ’ অর্থ উপস্থিত। কাজেই তিনি সর্বত্র উপস্থিত। অথবা ‘শাহিদ’ অর্থ যদি সাক্ষী হয় তাহলেও তাঁকে সর্বত্র উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ না দেখে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। আর এভাবে তিনি সদা সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান বা হাযির-নাযির ও সকল স্থানের সকল গোপন ও গাইবী জ্ঞানের অধিকারী।
তাঁদের এই ব্যাখ্যা ও দাবির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
প্রথমত, তাঁরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের মতামত গ্রহণ না করে নিজেদের মর্জি মাফিক ব্যাখ্যা করেন এবং সাহাবী-তাবিয়ীদের ব্যাখ্যা বাতিল করে দেন।
দ্বিতীয়ত, তাঁরা একটি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যাকে মূল আকীদা হিসাবে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা নিজেদের মর্জিমাফিক বাতিল করে দিলেন। তাঁরা এমন একটি অর্থ গ্রহণ করলেন, যে অর্থে একটি দ্ব্যর্থহীন আয়াত বা হাদীসও নেই। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী বা কোনো ইমামও কখনো এ কথা বলেন নি।
তৃতীয়ত, তাঁদের এ ব্যাখ্যা ও দাবি মূলতই বাতিল। তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রত্যেক মুসলমানকেই ‘ইলমে গাইবের অধিকারী’ ও হাযির-নাযির বলে দাবি করতে হবে। কারণ মুমিনগণকেও কুরআনে ‘শাহীদ’ অর্থাৎ ‘সাক্ষী’ বা ‘উপস্থিত’ বলা হয়েছে এবং বারংবার বলা হয়েছে যে, তাঁরা পূর্ববর্তী সকল উম্মাত সহ পুরো মানব জাতি সম্পর্কে কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবেন। আর উপস্থিত না হলে তো সাক্ষ্য দেওয়া যায় না। কাজেই তাঁদের ব্যাখ্যা ও দাবি অনুসারে বলতে হবে যে, প্রত্যেক মুমিন সৃষ্টির শুরু থেকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বদা বিরাজমান এবং সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। কারণ না দেখে তাঁরা কিভাবে মানবজাতির পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন?!
দ্বিতীয় দলীল: কুরআন কারীমে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
النَّـبِـيُّ أَوْلَى بِالْمُـؤْمِـنِيـنَ مِـنْ أَنْـفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّـهَـاتُـهُمْ وَأُوْلُو الأرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ
‘‘নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর (closer) এবং তাঁর স্ত্রী তাদের মাতা। এবং আল্লাহর কিতাবে আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর।’’[8]
এখানে ‘আউলা’ (أولى) শব্দটির মূল হলো ‘বেলায়াত’ (الولاية), অর্থাৎ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ‘আউল’ অর্থ ‘অধিকতর ওলী’। অর্থাৎ অধিক বন্ধু, অধিক নিকটবর্তী, অধিক যোগ্য বা অধিক দায়িত্বশীল (more entitled, more deserving, worthier, closer)।
এখানে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর (closer) বলতে ভক্তি, ভালবাসা, দায়িত্ব, সম্পর্ক ও আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতা বুঝানো হচ্ছে। মুমিনগণ রাসূলুল্লাহকে তাঁদের নিজেদের চেয়েও বেশি আপন, বেশি প্রিয় ও আনুগত্য ও অনুসরণের বেশি হক্কদার বলে জানেন। এই ‘আপনত্বের’ একটি দিক হলো যে, তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মাতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আবার উম্মাতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরদ ও প্রেম তার আপনজনদের চেয়েও বেশি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেছেন। জাবির, আবূ হুরাইরা প্রমুখ সাহাবী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَا مِنْ مُؤْمِنٍ إِلا وَأَنَا أَوْلَى بِهِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ. فَأَيُّمَا مُؤْمِنٍ مَاتَ وَتَرَكَ مَالا فَلْيَرِثْهُ عَصَبَتُهُ مَنْ كَانُوا وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضَيَاعًا فَلْيَأْتِنِي (فَإِلَيَّ وَعَلَيَّ، عَلَيَّ قَضَاؤُهُ) فَأَنَا مَوْلاهُ
‘‘প্রত্যেক মুমিনের জন্যই দুনিয়া ও আখেরাতে আমি তার অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর বাণী পাঠ কর: ‘‘নবী মু’মিনগণের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর’’। কাজেই যে কোনো মুমিন যদি মৃত্যুবরণ করে এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীগণ যারা থাকবে তারা সেই সম্পদ গ্রহণ করবে। আর যদি সে ঋণ রেখে যায় বা অসহায় সন্তান-সন্ততি রেখে যায় তবে তারা যেন আমার নিকট আসে; সে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার উপরেই থাকবে। কারণ আমিই তার আপনজন।’’[9]
কিন্তু ‘হাযির-নাযির’-এর দাবিদারগণ দাবি করেন যে, এখানে দৈহিক নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। কাজেই তিনি সকল মুমিনের নিকট হাযির আছেন।
এখানেও আমরা দেখছি যে একটি বানোয়াট ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তারা কুরআন ও হাদীসে অগণিত দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাঁর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যাখ্যাকেও গ্রহণ করছেন না। সর্বোপরি তাদের এই ব্যাখ্যা সন্দেহাতীতভাবেই বাতিল। কারণ এই আয়াতেই বলা হয়েছে যে ‘‘আত্মীয়গণ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর’’। অন্যত্রও বলা হয়েছে যে, ‘‘আত্মীয়গণ একে অপরের ঘনিষ্ঠতর বা নিকটতর।’’[10] তাহলে এদের ব্যাখ্যা অনুসারে আমাদের বলতে হবে যে, সকল মানুষই হাযির নাযির। কারণ সকল মানুষই কারো না কারো আত্মীয়। কাজেই তার সদাসর্বদা তাদের কাছে উপস্থিত এবং তাদের সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন!
অন্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী (ﷺ) ও মুমিনগণ মানুষদের মধ্যে ইবরাহীম (আঃ)-এর সবচেয়ে ‘নিকটতর’ বা ‘ঘনিষ্ঠতর’ (أولى)।[11] এখানে দাবি করতে হবে যে, সকল মুমিন ইবরাহীমের নিকট উপস্থিত...!
তৃতীয় দলীল: আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) ذَاتَ يَوْمٍ فَلَمَّا قَضَى الصَّلاةَ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ (رَقِيَ الْمِنْبَرَ) فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي إِمَامُكُمْ فَلا تَسْبِقُونِي بِالرُّكُوعِ وَلا بِالسُّجُودِ وَلا بِالْقِيَامِ وَلا بِالانْصِرَافِ (أَتِمُّوا الصُّفُوفَ) فَإِنِّي أَرَاكُمْ أَمَامِي وَمِنْ خَلْفِي (خَلْفَ ظَهْرِي/مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي)، فِي الصَّلاةِ وَفِي الرُّكُوعِ إِنِّي لأَرَاكُمْ مِنْ وَرَائِي كَمَا أَرَاكُمْ (مِنْ أَمَامِيْ) (أَقِيمُوا الرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ فَوَاللَّهِ إِنِّي لأَرَاكُمْ مِنْ بَعْدِي وَرُبَّمَا قَالَ مِنْ بَعْدِ ظَهْرِي إِذَا رَكَعْتُمْ وَسَجَدْتُمْ)
‘‘একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। সালাতের পরে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে (অন্য বর্ণনায়: মিম্বরে আরোহণ করে) তিনি বলেন: হে মানুষেরা, আমি তোমাদের ইমাম। কাজেই তোমরা আমার আগে রুকু করবে না, সাজদা করবে না, দাঁড়াবে না এবং সালাত শেষ করবে না। অন্য বর্ণনায়: কাতারগুলি পূর্ণ করবে। কারণ আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই আমার সামনে এবং আমার পিছনে, যখন তোমরা রুকু কর এবং যখন তোমরা সাজদা কর। অন্য বর্ণনায়: সালাতের মধ্যে এবং রুকুর মধ্যে আমি আমার পিছন থেকে তোমাদেরকে দেখি যেমন আমি সামনে থেকে তোমাদেরকে দেখি। অন্য বর্ণনায়: তোমরা রুকু এবং সাজদা পূর্ণ করবে; কারণ আল্লাহর কসম, আমি তোমাদেরকে আমার পরেও, অথবা বলেন: আমার পিঠের পরেও দেখি যখন তোমরা রুকু কর এবং সাজদা কর।’’[12]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা (রা) থেকেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি্ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
هَلْ تَرَوْنَ قِبْلَتِي هَا هُنَا وَاللَّهِ مَا يَخْفَى عَلَيَّ رُكُوعُكُمْ وَلا خُشُوعُكُمْ وَإِنِّي لأَرَاكُمْ وَرَاءَ ظَهْرِي
‘‘তোমরা কি এখানে আমার কিবলাহ দেখতে পাচ্ছ? আল্লাহর কসম, তোমাদের রুকু, সাজদা এবং বিনম্রতা আমার কাছে অপ্রকাশিত থাকে না এবং আমি তোমাদেরকে আমার পিঠের পিছনে দেখি।’’[13]
এ হাদীস থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারছি। এ হাদীসের আলোকে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, অন্যান্য মানুষ যেভাবে সামনে দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পিছনেও দেখতেন। এখন কেউ ‘বাশারিয়্যাত’ বা মানবত্বের বিশেষণকে ভিত্তি করে পিছনে দেখার এই বৈশিষ্ট্যটির ব্যাখ্যা করে বলতে পারেন যে, এখানে ‘দেখি’ অর্থ ‘ধারণা করি’, কারণ ‘দেখা’ আরবীতে ‘ধারণা’ বা মনের দেখা অর্থে ব্যবহৃত হয়, অথবা দেখি অর্থ আমাকে সংবাদ দেওয়া হয়... ইত্যাদি। তবে এরূপ ব্যাখ্যা ও অর্থ-করণ ওহীর সীমা লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে। বরং বাশারিয়্যাত ও পশ্চাত-দর্শন উভয়কেই স্বাভাবিক ও প্রসিদ্ধ অর্থে গ্রহণ করা এবং উভয়কে সরলভাবে বিশ্বাস করা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে যদি কেউ দেখা অর্থ জানা বলেন এবং সামনের মত পিছনে দেখা বলতে অতীতের মত ভবিষ্যত সম্পর্কে জানা বলেন তবে তা নিঃসন্দেহে মনগড়া অর্থ হবে।
হাদীসটি পাঠ করলে বা শুনলে যে কেউ অনুভব করবেন যে, বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টি ও দর্শনের বিষয়ে। মানুষ সামনে যেরূপ সামনের দিকে দেখতে পায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতের মধ্যে সেভাবেই পিছনে দেখতে পেতেন। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায় যে, এই দর্শন ছিল সালাতের মধ্যে ও রুকু সাজাদরা মধ্যে। অন্য সময়ে তিনি এইরূপ দেখতেন বলে কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। তা সত্ত্বেও যদি তা মনে করা হয় যে, তিনি সর্বদা এইরূপ সামনে ও পিছনে দেখতে পেতেন, তবুও এ হাদীস দ্বারা কখনোই বুঝা যায় না যে, তিনি দৃষ্টির আড়ালে, ঘরের মধ্যে, পর্দার অন্তরালে, মনের মধ্যে বা অনেক দূরের সবকিছু দেখতে পেতেন। তা সত্ত্বেও যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত ও বিরোধী না হতো, তবে আমরা এই হাদীস থেকে দাবি করতে পারতাম যে, তিনি এভাবে সর্বদা সর্বস্থানের সর্বকিছু দেখতেন এবং দেখছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন আয়াতে ও অগণিত সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বারংবার এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। মূলত মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়মত রাসূল (ﷺ)-কে এইরূপ ঝামেলা ও বিড়ম্বনাময় দায়িত্ব থেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন।
ইবনু হাজার আসকালানী বলেন:
ظاهر الحديث إن ذلك يختص بحالة الصلاة ويحتمل أن يكون ذلك واقعا في جميع أحواله وأغرب الداودي الشارح فحمل البعدية هنا على ما بعد الوفاة يعني أن أعمال الأمة تعرض عليه وكأنه لم يتأمل سياق حديث أبي هريرة حيث بين فيه سبب هذه المقالة
‘‘হাদীসের বাহ্যিক বা স্পষ্ট অর্থ থেকে বুঝা যায় যে, পিছন থেকে দেখতে পাওয়ার এ অবস্থাটি শুধুমাত্র সালাতের জন্য খাস। অর্থাৎ তিনি শুধু সালাতের মধ্যেই এইরূপ পিছন থেকে দেখতে পেতেন। এমনও হতে পারে যে, সর্বাবস্থাতেই তিনি এইরূপ দেখতে পেতেন।.... দাঊদী[14] নামক ব্যাখ্যাকার একটি উদ্ভট কথা বলেছেন। তিনি এ বর্ণনায় ‘পরে’ শব্দটির অর্থ ‘মৃত্যুর পরে’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে পেশ করা হবে। সম্ভবত তিনি আবূ হুরাইরার (রা) হাদীসের সামগ্রিক অর্থ চিন্তা করেন নি, যেখানে এ কথার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে...।[15]
এখানে লক্ষণীয় যে, দাঊদীর যুগ বা হিজরী ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত এরূপ উদ্ভট ব্যাখ্যাকারীরাও ‘দেখা’ বলতে ‘উম্মাতের কর্ম তাঁর কাছে উপস্থিত করা হলে দেখেন’ বলে দাবি করতেন। তিনি নিজে মদীনায় থেকে সবত্র সবকিছু দেখতেন অথবা সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিত হয়ে সব কিছু দেখতেন বলে কেউ কল্পনা করে নি। কিন্তু যুগের আবর্তন, ইসলামী মূল্যবোধের অবক্ষয়, পার্শবর্তী ধর্মের প্রভাব ও অতিভক্তির প্লাবনে পরবর্তী যুগে ‘ইলমুল গাইব’ বা ‘হাযির-নাযির’ দাবিদারগণ এখানে ‘তোমাদেরকে দেখতে পাই’ কথাটির ব্যখ্যায় বলেন যে, তিনি সদা সর্বদা সর্বস্থানে সর্বজনকে দেখতে পান। আমরা দেখছি যে, এই ব্যখ্যাটি শুধু হাদীসটির বিকৃতিই নয়, উপরন্তু অগণিত আয়াত ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিরোধী।
সর্বোপরি সামনে ও পিছনে ‘দেখা’ বা ‘গায়েবী দেখা’ দ্বারা ‘সদা সর্বদা সর্বত্র উপস্থিতি’ বা সবকিছু দেখা প্রমাণিত হয় না। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে, শয়তান ও তার দল মানুষদেরকে গায়েবীভাবে দেখে:
إِنَّـهُ يَـرَاكُـمْ هُـوَ وَقَـبِـيـلُهُ مِنْ حـَيْثُ لا تَـرَوْنَـهُمْ
‘‘সে ও তার দল তোমাদিগকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।’’[16]
এখানে কি কেউ দাবি করবেন যে, যেহেতু ‘‘তেমাদিগকে দেখে’ (يراكم) বর্তমান কালের ক্রিয়া, সেহেতু শয়তান ও তার দলের প্রত্যেকে সদা সর্বদা সকল স্থানের সকল মানুষকে একই ভাবে দেখতে পাচ্ছে বা দেখেইে চলেছে?!
চতুর্থ দলীল: ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ কুরতুবী (৬৭১ হি) বলেন:
أخبرنا ابن المبارك، أخبرنا رجل من الأنصار، عن المِنْهَال بنِ عمرٍو، حدثه أنه سمع سعيد بن المُسَيَّبِ يقول: ليس من يوم إلا تعرض على النبي (ﷺ) أمته غُدْوة وعَشيّة، فيعرفهم بأسمائهم وأعمالهم، فلذلك يشهد عليهم،
‘‘(প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি) বলেন, আনসারী এক ব্যক্তি আমাদেরকে বলেছেন, মিনহাল ইবনু আমর তাকে বলেন, তিনি (প্রসিদ্ধ তাবিয়ী) সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (৯০ হি)-কে বলতে শুনেছেন: প্রতি দিনই সকালে বিকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে তাঁর উম্মাতকে পেশ করা হয়, ফলে তিনি তাদেরকে তাদের নামে ও কর্মে চিনতে পারেন। এজন্য তিনি তাদের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’[17]
সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িবের এ বক্তব্যকে ‘হাযির-নাযির’ মতবাদের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(১) সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িবের এ বক্তব্যটি তাঁর থেকে কোনো সহীহ সনদে বর্ণিত হয় নি। একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কথাটি মিনহালের সূত্রে জেনেছেন বলে দবি করেছেন। হাদীসের সনদ বিচার সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অধিকারী যে কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, এরূপ বর্ণনার কোনোরূপ নির্ভরযোগ্যতা নেই মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের নিকট।
(২) ৭ম হিজরী শতকে আল্লামা কুরতুবী ২য় শতকের প্রসিদ্ধ আলিম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকের সূত্রে বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকের সুপরিচিত গ্রন্থসমূহে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। অপরিচিত হস্তলিখিত পান্ডুলিপিগুলির মধ্যে লিপিকারগণ অনেক সংযোজন বিয়োজন করত। কাজেই বক্তব্যটি আদৌ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক কর্তৃক সংকলিত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া কষ্টকর।
(৩) সর্বাবস্থায় এ বক্তব্যটি তাবিয়ী সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িাবের ব্যক্তিগত মতামত মাত্র। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা কোনো সাহাবীর বক্তব্য নয়।
(৪) ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, দশজনেরও অধিক সাহাবী থেকে অনেক সহীহ সনদে বর্ণিত এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, তাঁর ওফাতের পরে সাক্ষী বা হাযির-নাযির হয়ে উম্মাতের সকল কর্ম দেখাশুনা করার ঝামেলা মহান আল্লাহ তাকে দেন নি। বরং তাদের অনেকের পরিবর্তন-উদ্ভাবন তিনি জানবেন না। এর পাশাপাশি কোনো সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় নি যে, উম্মাতের সকল কর্ম তাঁর নিকট পেশ করা হয়।
(৫) ইবনুল মুসাইয়িবের এ বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টতই জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘হাযির-নাযির’ (সদা-সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান ও সবকিছুর দর্শক) নন; বরং তিনি রাওযা মুবারাকার মধ্যে বিদ্যমান এবং উম্মাতের কর্ম তাঁর নিকট হাযির করা হয়, তিনি উম্মাতের নিকট হাযির (উপস্থিত) হন না।
পঞ্চম দলীল: মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বলেন:
وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِنَ الأَمْرِ لَعَنِتُّمْ
‘‘এবং তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন; তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পেতে ....।’’[18]
এ আয়াত দ্বারা তাঁরা প্রমাণ করতে চান যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বত্র বিরাজমান। অথচ এ আয়াতের অর্থ খুবই স্পষ্ট। সুস্পষ্টতই এখানে সাহাবীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াত ও আগের ও পরের আয়াতগুলি থেকে তা সুস্পষ্ট। সাহাবীগণও কখনো বুঝেন নি যে, ‘তোমাদের মধ্যে রয়েছেন’ অর্থ প্রত্যেকের সাথে রয়েছেন বা সর্বত্র রয়েছেন।
ষষ্ঠ দলীল: হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত্যুর পরে কবরস্থ ব্যক্তিকে ফিরিশতাগণ তার প্রতিপালক, দীন ও নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। এ বিষয়ে বারা ইবনু আযিব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, তাকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে:
مَنْ رَبُّكَ وَمَا دِينُكَ وَمَنْ نَبِيُّكَ
‘‘তোমার প্রতিপালক কে? এবং তোমার দীন কী? এবং তোমার নবী কে?’’[19]
এ হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তৃতীয় প্রশ্নটির ভাষা হবে নিম্নরূপ:
مَا هَذَا الرَّجُلُ؟
‘‘এই ব্যক্তি কে (তাঁর পদমর্যাদা কী)?’’[20]
হাযির-নাযির মতের অনুসারিগণ দাবি করেন যে, এখানে ‘হাযা’ (هذا) বা ‘এই’ (this) বলা হয়েছে, আর নিকটবর্তী কোনো কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করতেই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এতে বুঝা যায় যে, প্রশ্নের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিকটেই থাকবেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি সদা সর্বদা সবত্র বিরাজমান ও সব কিছুর দর্শক, অর্থাৎ হাযির-নাযির!
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত, তাঁদের এ দাবিটি প্রমাণ করে যে, তাঁরা কুরআন, হাদীস ও আরবী ব্যবহার বিধির সাথে ভালভাবে পরিচিত নন, অথবা এ বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান গোপন করতে চান। ‘হাযা’ বা ‘এই’ শব্দটি কেবলমাত্র দৈহিকভাবে নিকটবর্তী ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করতেই ব্যবহার করা হয় না, উপরন্তু মানসিকভাবে নিকটবর্তী বা দৈহিক ও মানসিকভাবে দূরবর্তীর প্রতি ইঙ্গিতের জন্যও ব্যবহার করা হয়। অন্য কোনো উদাহরণ না দিয়ে অবিকল এই বাক্যটিই বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত অন্য হাদীস থেকে উদ্ধৃত করছি। আমর ইবনু সালামা (রা) মরুবাসী আরব গোত্রের মানুষ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইসলাম প্রচার শুরু করলে এ খবর তাদের কানেও পৌঁছায়। তারা সেই দূর মরুপ্রান্তরে বসেই তাঁর বিষয়ে বিভিন্ন কাফেলার মানুষদেরকে প্রশ্ন করতেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,
كُنَّا بِمَاءٍ مَمَرَّ النَّاسِ وَكَانَ يَمُرُّ بِنَا الرُّكْبَانُ فَنَسْأَلُهُمْ مَا لِلنَّاسِ؟ مَا لِلنَّاسِ؟ مَا هَذَا الرَّجُلُ؟ فَيَقُولُونَ يَزْعُمُ أَنَّ اللَّهَ أَرْسَلَهُ أَوْحَى إِلَيْهِ
‘‘আমরা মানুষের যাতায়াতের পথে এক জলাধারের পাশে বসবাস করতাম। আমাদের নিকট দিয়ে কাফেলাগুলি অতিক্রম করত। আমরা তাদেরকে প্রশ্ন করতাম: মানুষদের খবর কি? মানুষদের খবর কি? ‘‘এই ব্যক্তি কে (তাঁর পদমর্যাদা কী)?’’ তারা বলত, তিনি দাবি করেন যে, আল্লাহ তাঁকে রাসূল রূপে প্রেরণ করেছেন এবং তার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন...।’’[21]
এখানে আমরা দেখছি যে, সুদূর মক্কায় অবস্থিত মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ‘হাযা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই শুধু ‘হাযা’ শব্দের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক দিয়ে এরূপ একটি ধর্ম বিশ্বাস তৈরি করার প্রক্রিয়া সঠিক নয়।
দ্বিতীয়ত, যদি এ কথা ধরে নেওয়া হয় যে, মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার নিকটবর্তী হবেন তবুও এদ্বারা কোনোভাবেই ‘হাযির-নাযির’-এর তত্ত্ব প্রমাণ করা যায় না। পারলৌকিক জীবন ও মৃত্যু পরবর্তী জগৎটি সম্পূর্ণভাবেই এ পার্থিব জীবন ও জগত থেকে ভিন্ন। সে জগতের দর্শন, নৈকট্য ইত্যাদি এ জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পূর্ববর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ এরূপ দর্শন বা নৈকট্যের অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু মৃতকে প্রশ্নের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দর্শন করা বা নিকটবর্তী হওয়া দ্বারা সদা-সর্বদা তিনি মৃতদের নিকট উপস্থিত বা সর্বত্র বিরাজমান বলে দাবি করার মত কল্পনা কারো মনে উদয় হয়েছে বলে জানা যায় না।
এভাবে আমরা দেখছি যে, এ মত যারা পোষণ করেছেন, তাঁরা তাঁদের কথাগুলির পক্ষে একটিও দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করছেন না। তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক বা দ্ব্যর্থবোধক কিছু আয়াত বা হাদীসকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং এরপর এরূপ ব্যাখ্যার উপরে নির্ভর করে তাঁরা অগণিত আয়াত ও সহীহ হাদীস বাতিল করে দেন। যারা এরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান তাঁদের অনেকের নেক নিয়্যাত ও ভক্তি-ভালবাসার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা ভাল উদ্দেশ্যে ওহীর নামে মিথ্যা বলেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে এমন কথা বলেছেন যা তিনি কখনোই নিজের বিষয়ে বলেন নি। সর্বোপরি তারা এমন কিছু কথা দাবি করছেন যেগুলিকে সঠিক প্রমাণ করতে শুধু কুরআন ও হাদীসের অগণিত শিক্ষাই নয়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সমগ্র জীবনের সকল ঘটনারই বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ সর্বপ্রকারের ইলমুল গাইবের অধিকারী হলে এবং সদাসর্বদা সবত্র বিরাজমান হলে নুবুওয়াত, ইসরা, মি’রাজ, হিজরত, হজ্জ, ওমরা ইত্যাদি সবই অর্থহীন হয়ে যায়।
কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবীগনের পদ্ধতি ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতির ভিত্তিতে মুমিনের দায়িত্ব হলো এ বিষয়ে ওহীর সকল নির্দেশনা সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করা। মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আলিমুল গাইব একমাত্র আল্লাহ। মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ গাইব জানেন না। তিনি আরো বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দুনিয়া, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, ভূত, ভবিষ্যৎ ইত্যাদির অনেক কিছু জানিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে, বরং অন্য সকল নবী-রাসূলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অনেক জ্ঞান তাঁকে আল্লাহ দান করেন। আমরা আগেই দেখেছি তিনি অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং তাঁর আরো অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে বলে প্রতিটি মুসলিম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। তবে আল্লাহর জানানো জ্ঞানের বাইরে কোনো গাইবী ইলম তাঁর ছিল না। তাঁর প্রতিপালক মহান আল্লাহ তাকে কতটুকু জানিয়েছেন তা নিয়ে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের অতিরিক্ত কোনো কল্পনা বা ব্যাখ্যা মুমিন করতে চান না। যেহেতু কুরআন ও হাদীসে এভাবে বলা হয়েছে, তাই আমরা এভাবেই বিশ্বাস করব, এর বাইরে কিছু বাড়িয়ে কিছু বলব না আমরা, কারণ তাতে আমরা বাড়াবাড়ি ও অতিভক্তির মধ্যে নিপতিত হব, যা করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিষেধ করেছেন। কুরআন ও হাদীসে যে শব্দ, বাক্য বা বিশেষণ ব্যবহার করা হয় নি বা সাহাবীগণ যে কথা তাঁর বিষয়ে বলেন নি সেগুলি না বললে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু বলতে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষা, পথ ও আদর্শের ব্যতিক্রমের অপরাধে অপরাধী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
[2] সূরা (২৮ কাসাস: ৪৪-৪৬ আয়াত।
[3] সূরা (১২) ইউসুফ: ১০২ আয়াত।
[4] সূরা: ৩৩ আহযাব ৪৫; সূরা: ৪৮ ফাত্হ ৮; সূরা: ৭৩ মুয্যাম্মিল ১৫; সূরা: ২ বাকারা ১৪৩; সূরা: ৪ নিসা, ৪১; সূরা: ১৬ নাহ্ল, ৮৯; সূরা: ২২ হজ্জ, ৭৮ আয়াত।
[5] তাবারী ২২/১৮, ২৬/৭৩; ইবনু কাসীস ৩/৪৯৮।
[6] সূরা (২) বাকারা, ১৪৩; সূরা (২২) হজ্জ, ৭৮ আয়াত।
[7] সূরা : ৪ নিসা, ৭৯, ১৬৬; সূরা : ৫ মায়িদা ১১৭; সূরা : ১০ ইউনূস, ২৯; সূরা : ১৩ রা’দ, ৪৩; সূরা: ১৭ ইসরা, ৯৬; সূরা : ২৯ আনকাবূত, ৫২; সূরা : ৩৩ আহযাব, ৫৫; সূরা : ৪৬ আহকাফ, ৮; সূরা : ৪৮, ফাত্হ, ২৮ আয়াত।
[8] সূরা (৩৩) আহযাব, ৬ আয়াত।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮০৫, ৮৪৫, ৪/১৭৯৫; ৫/২০৫৪; ৬/২৪৭৬, ২৪৮০; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৯২, ৩/১২৩৭, ১২৩৮।
[10] সূরা (৮) আনফাল, ৭৫ আয়াত।
[11] সূরা (৩) আল-ইমরান, ৬৮।
[12] বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬২, ২৫৩, ২৫৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩১৯, ৩২০, ৩২৪।
[13] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৫৯।
[14] আবূ জাফর আহমদ ইবনু সাঈদ দাঊদী নামক একজন আলিম সহীহ বুখারীর একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন। তাঁর পরিচয় বা ব্যাখ্যাগ্রন্থটির নাম সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ইবনু হাজার আসকালানী ফাতহুল বারী রচনায় এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি থেকে অনেক সময় উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন।
[15] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫১৫, ২/২২৫।
[16] সূরা : ৭ আ’রাফ, ২৭ আয়াত।
[17] কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ, আত-তাযকিরা ফী আহওয়ালিল মাউতা ও উমূরিল আখিরাহ, পৃ. ২৪৯; আল-জামিয় লি আহকামিল কুরআন ৫/১৯৮; ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫০০।
[18] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ৭ আয়াত।
[19] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৯৫। তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
[20] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২৩৯; ইবনু মাজাহ ২/১৪২৬।
[21] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৫৬৪।