লগইন করুন
উপরের বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গাইবী জ্ঞান সম্পর্কিত বিতর্ক। কুরআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহই একমাত্র অদৃশ্য বা গাইবী ইলমের অধিকারী বা ‘আলিমুল গাইব’। তিনি ছাড়া কেউ গাইবী ইলমের অধিকারী নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কেও বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ইলমুল গাইব জানতেন না। কেবলমাত্র যে জ্ঞান ওহীর মাধ্যমে তাঁর নিকট আসত তিনি তাই অনুসরণ করতেন ও প্রচার করতেন। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ
‘‘বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গাইব বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।’’[1]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لا يَعْلَمُهَا إِلا هُوَ
‘‘অদৃশ্যের কুঞ্জি তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত কেউ তা জানে না।’’[2]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِع
‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর গাইব তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা!’’[3]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَإِلَيْهِ يُرْجَعُ الأمْرُ كُلُّهُ
‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই নিকট সব কিছু প্রত্যানীত হবে।’’[4]
إنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الأرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
‘‘কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকট রয়েছে, তিনি বৃyুষ্ট বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা জরায়ুতে আছে। কোনো প্রাণীই জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কোনো প্রাণীই জানে না কোন্ স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।’’[5]
এভাবে কুরআন কারীমে বহু স্থানে মহান আল্লাহ বারংবার ঘোষণা করেছেন যে গাইবের বিষয় ও ভবিষ্যতের বিষয় মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, কোনো প্রাণীই নয়। এ বিষয়ক কিছু আয়াত আমরা আখিরাতে বিশ্বাস সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
কুরআন কারীমে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে যতটুকু জানিয়েছেন এর অতিরিক্ত কোনো গাইবী জ্ঞান নবীগণের ছিল না। ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট ফিরিশতাগণ এসেছেন তিনি চিনতে পারেন নি। অনুরূপভাবে লূত, দাঊদ, সুলাইমান, মূসা, ইয়াকূব, ঈসা (আঃ) সকলের ক্ষেত্রেই বিষয়টি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সকল নবী-রাসূলগণের বিষয়ে একত্রে কুরআন কারীমে বলা হয়েছে:
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ
‘‘যে দিন (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ রাসূলদেরকে একত্র করবেন এবং বলবেন, তোমারা কী উত্তর পেয়েছিলে? তারা বলবে, আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই, তুমিই তো অদৃশ্য সম্মন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’’[6]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানতেন না বলে কুরআন কারীমে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَيَقُولُونَ لَوْلا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَقُلْ إِنَّمَا الْغَيْبُ لِلَّهِ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ
‘‘তারা বলে, তার প্রতিপালকের নিকট থেকে তার নিকট কোনো নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? বল, ‘অদৃশ্যের জ্ঞান তো কেবল আল্লাহরই আছে। সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমি তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।’’[7]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلا تَتَفَكَّرُونَ
‘‘বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ রয়েছে, অদৃশ্য (গায়েব) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই, আর আমি তোমাদেরকে একথাও বলি না য, আমি ফিরিশতা। আমি তো শুধুমাত্র আমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করা হয় তারই অনুসরণ করি।’’[8]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
قُلْ لا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلا ضَرًّا إِلا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতাও আমার নেই। আমি যদি গাইব (গোপন জ্ঞান) জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম, আর কোনো অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো কেবলমাত্র ভয়পপ্রদর্শনকারী এবং সুসংবাদদাতা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।’’[9]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلا بِكُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ وَمَا أَنَا إِلا نَذِيرٌ مُبِينٌ
‘‘বল, আমি তো প্রথম রাসূল নই। আর আমি জানি না, আমার এবং তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমি আমার প্রতি যা ওহী প্রেরণ করা হয় কেবলমাত্র তারই অনুসরণ করি। আমি তো একজন স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’’[10]
অন্য আয়াতে আল্লাহ জাললা শানুহূ আরো বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ قُلْ إِنَّمَا يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَهَلْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ آَذَنْتُكُمْ عَلَى سَوَاءٍ وَإِنْ أَدْرِي أَقَرِيبٌ أَمْ بَعِيدٌ مَا تُوعَدُونَ إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ مِنَ الْقَوْلِ وَيَعْلَمُ مَا تَكْتُمُونَ وَإِنْ أَدْرِي لَعَلَّهُ فِتْنَةٌ لَكُمْ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ
‘‘এবং আমি তো তোমাকে কেবল বিশ্ব-জগতের রহমত-রূপেই প্রেরণ করেছি। বল, আমার প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র একজনই, অতএব তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হয়ে যাও। আর যদি তারা (আপনার ডাকে সাড়া না দিয়ে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলে দাও, আমি তোমাদেরকে যথাযথভাবে জানিয়ে দিয়েছি। তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা শীঘ্রই আসবে না দেরী করে আসবে তা আমি জানি না। নিশ্চয় আল্লাহ যা কথায় ব্যক্ত করা হয় এবং যা তোমরা গোপন কর তা সব জানেন। আর আমি জানি না, হয়ত তা তোমাদের জন্য একটি পরীক্ষা এবং কিছু সময়ের জন্য উপভোগের বিষয়।’’[11]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ
‘‘মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ, তারা কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে জান না; আমি তাদেরকে জানি।’’[12]
لا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا
‘‘তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন।’’[13]
সাহাবী মাহমূদ ইবনু লাবীদ (রা) বলেন,
إنَّ نَاقَةَ النَّبِيِّ (ﷺ) ضَلَّتْ فَقَالَ زَيْدُ بْنُ اللَّصِِْيتِ: يَزْعُمُ مُحَمَّدٌ (ﷺ) أَنَّهُ نَبِيٌ وَيُخْبِرُكُمْ عَنْ خَبَرُ السَّمَاءِ وَهُوَ لاَ يَدْرِيْ أَيْنَ نَاقَتُهُ! فَقَالَ النَّبِيُّ (ﷺ): إِنَّ رَجُلاً يَقُوْلُ كَذا وَكَذا، وَاِنِّيْ وَاللهِ لاَ أَعْلَمُ اِلاَّ مَا عَلَّمَنِي اللهُ وَقَدْ دَلَّنِي اللهُ عَلَيْهَا وَهِيَ فِيْ شِعْبِ كَذا قَدْ حَبَسَتْهَا شَجَرَةٌ فَذَهَبُوا فَجَاءُوْهُ بِهَا
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি উটনী হারিয়ে যায়। তখন যাইদ ইবনুল লাসীত নামক একব্যক্তি বলে, মুহাম্মাদ (ﷺ) দাবি করেন যে, তিনি নবী এবং তোমাদেরকে তিনি আকাশের খবর বলেন, অথচ তাঁর নিজের উটটি কোথায় আছে তা তিনি জানেন না! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: এক ব্যক্তি এমন এমন কথা বলেছে। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে যা জানান তা ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আল্লাহ আমাকে উটনীটির বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সেটি অমুক প্রান্তরে অমুক গাছের সাথে আটকে আছে। তখন তারা তথায় যেযে উটনীটি নিয়ে আসেন।’’[14]
এ হাদীস উল্লেখ করে ইবনু হাজার আসকালানী বলেন:
فان بعض من لم يرسخ في الإيمان كان يظن ذلك حتى كان يرى أن صحة النبوة تستلزم اطلاع النبي (ﷺ) على جميع المغيبات ... فاعلم النبي (ﷺ) أنه لا يعلم من الغيب الا ما علمه الله
‘‘যাদের ঈমান পূর্ণ হয় নি এরূপ কেউ কেউ ধারণা করত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইলমুল গাইব জানেন। এমনকি তারা মনে করত যে, নুবুওয়াতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করার জন্য নবীকে সকল গাইব জানতে হবে। .... এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ যা জানান তা ছাড়া আর কিছুই তিনি জানেন না।’’[15]
সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ বুজুর্গ সাহাবী ছিলেন উসমান ইবনু মাযঊন (রা)। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুধ-ভাই ছিলেন এবং জাহিলী যুগেও তিনি মদপান বা মুর্তিপূজা করেন নি। তিনি প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজিরদের অন্যতম ছিলেন। মহিলা সাহাবী উম্মুল আলা উসমান ইবনু মাযঊনের (রা) ওফাতের পরের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন:
فَدَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ (ﷺ) فَقُلْتُ رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَيْكَ أَبَا السَّائِبِ شَهَادَتِي عَلَيْكَ لَقَدْ أَكْرَمَكَ اللَّهُ فَقَالَ النَّبِيُّ (ﷺ) وَمَا يُدْرِيكِ أَنَّ اللَّهَ أَكْرَمَهُ قَالَتْ قُلْتُ (لا أَدْرِي) بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَنْ يُكْرِمُهُ الله؟ قَالَ أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ وَاللَّهِ الْيَقِينُ وَاللَّهِ إِنِّي لأَرْجُو لَهُ الْخَيْرَ وَمَا أَدْرِي وَاللَّهِ وَأَنَا رَسُولُ اللَّه مَا يُفْعَلُ بِي قَالَتْ فَوَاللَّهِ لا أُزَكِّي أَحَدًا بَعْدَهُ
‘‘তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আসলেন। আমি বললাম, হে আবুস সাইব (উসমান ইবনু মাযঊন) আমি আপনার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: তুমি কিভাবে জানলে যে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন? আমি বললাম, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবানী হোন, আমি তো জানি না, তবে তাঁকে যদি আল্লাহ সম্মানিত না করেন তবে আর কাকে করবেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তার কাছে একীন এসেছে, আল্লাহর কসম, আমি তার বিষযে ভাল আশা করি। আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর রাসূল, আমিও জানি না যে, আমার বিষয়ে কি করা হবে।’ উম্মুল আলা (রা) বলেন, আল্লাহর কসম! এরপর আমি আর কাউকে ভাল বলি না।’’[16]
মহিলা সাহাবী রুবাই’ বিনতু মু‘আওয়িয বলেন:
دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) صَبِيحَةَ عُرْسِي وَعِنْدِي جَارِيَتَانِ يَتَغَنَّيَتَانِ ... وَتَقُولانِ فِيمَا تَقُولانِ: وَفِينَا نَبِيٌّ يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ فَقَالَ أَمَّا هَذَا فَلا تَقُولُوهُ، مَا يَعْلَمُ مَا فِي غَدٍ إِلا اللَّهُ
‘‘আমার বিবাহের দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার ঘরে প্রবেশ করেন, তখন আমার কাছে দ’জন বালিকা বসে গীত গাচ্ছিল। তারা তাদের কথার মাঝে মাঝে বলছিল: ‘আমাদের মধ্যে একজন নবী রয়েছেন যিনি আগামীকাল (অর্থাৎ ভবিষ্যতে) কি আছে তা জানেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বলেন: ‘এ কথা বলো না, আগামীতে (ভবিষ্যতে) কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না।’’[17]
আয়েশা, উম্মু সালামা, আসমা বিনত আবী বাকর, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আনাস ইবনু মালিক, আবূ সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনু সা’দ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ প্রায় দশ জন সাহাবী () থেকে অনেকগুলি সহীহ সনদে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কেয়ামতের দিন অনেক মানুষ আমার কাছে (হাউযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না, বাধা দেওয়া হবে। আমি বলব : এরা তো আমারই উম্মত। তখন উত্তরে বলা হবে:
إِنَّـكَ لاَ تَـدْرِيْ مَـا عَـمِـلُوا بَـعْـدَكَ
‘‘আপনার পরে তারা কী আমল করেছে তা আপনি জানেন না।’’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ: وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘‘নেকবান্দা ঈসা ইবনু মারিয়াম (আঃ) যা বলেন আমি তখন তা-ই বলব[18]: ‘‘যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কার্যকলাপের শাহীদ-সাক্ষী। কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী (শাহীদ)।’’[19]
এ সকল নির্দেশনার পাশাপাশি কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ তাঁকে গাইব বা অদৃশ্য জ্ঞানের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنْ أَدْرِي أَقَرِيبٌ مَا تُوعَدُونَ أَمْ يَجْعَلُ لَهُ رَبِّي أَمَدًا عَالِمُ الْغَيْبِ فَلا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَصَدًا لِيَعْلَمَ أَنْ قَدْ أَبْلَغُوا رِسَالاتِ رَبِّهِمْ وَأَحَاطَ بِمَا لَدَيْهِمْ وَأَحْصَى كُلَّ شَيْءٍ عَدَدًا
‘‘বল, আমি জানি না তোমাদেরকে যে (শাস্তির) প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা কি আসন্ন, না আমার প্রতিপালক তার জন্য দীর্ঘ মেয়াদ স্থির করবেন। তিনি গায়েবের (অদৃশ্যের) জ্ঞানী, তিনি গায়েবের (অদৃশ্যের) জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না, তার মনোনীত রাসূল ব্যতীত, সেক্ষেত্রে আল্লাহ সেই রাসূলের আগে ও পিছে প্রহরী নিয়োগ করেন, যেন তিনি জানতে পারেন যে, রাসূলগণ তাদের প্রভুর রিসালাতের বাণী পৌঁছিয়েছেন কি না। তাদের কাছে যা আছে তা তাঁর জ্ঞানগোচর এবং তিনি সমস্ত কিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন।’’[20]
এভাবে আমারা জানতে পারছি যে, রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহ তাঁর মনোনিত রাসূলদেরকে গায়েবের জ্ঞান প্রকাশ করেন। সাথে সাথে আমরা জানতে পারছি যে, সার্বিক গায়েব বা ভবিষ্যতের কথা তিনি রাসূলদেরকেও জানান না। কাফেরদেরকে যে শান্তির ওয়াদা করা হয়েছে তা কি শীঘ্রই আসবে না দেরী করে আসবে তা তিনি জানেন না।
আসমা বিনতু আবী বাক্র (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সূর্যগ্রহণের সময় সালাত আদায়ের পরে বলেন:
مَا مِنْ شَيْءٍ لَمْ أَكُنْ أُرِيتُهُ إِلا رَأَيْتُهُ فِي مَقَامِي حَتَّى الْجَنَّةُ وَالنَّارُ
‘‘যা কিছু আমাকে ইতোপূর্বে দেখানো হয়েছিল না তা সবই আমি আমার এই অবস্থানে থেকে দেখেছি, এমনকি জান্নাত ও জাহান্নামও।’’[21]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
أَتَانِي اللَّيْلَةَ رَبِّي تَبَارَكَ وَتَعَالَى فِي أَحْسَنِ صُورَةٍ قَالَ أَحْسَبُهُ قَالَ فِي الْمَنَامِ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ هَلْ تَدْرِي فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلأُ الأَعْلَى قَالَ قُلْتُ لا قَالَ فَوَضَعَ يَدَهُ بَيْنَ كَتِفَيَّ حَتَّى وَجَدْتُ بَرْدَهَا بَيْنَ ثَدْيَيَّ أَوْ قَالَ فِي نَحْرِي فَعَلِمْتُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ، وفي رواية:فَعَلِمْتُ مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، وفي رواية: حَتَّى تَجَلَّى لِي مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ ثُمَّ تَلا هَذِهِ الآيَةَ: (وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَوَاتِ وَالأرْضِ وَلِيَكُونَ مِنْ الْمُوقِنِينَ). قَالَ يَا مُحَمَّدُ هَلْ تَدْرِي فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلأُ الأَعْلَى قُلْتُ نَعَمْ قَالَ فِي الْكَفَّارَاتِ وَالْكَفَّارَاتُ الْمُكْثُ فِي الْمَسَاجِدِ بَعْدَ الصَّلَوَاتِ وَالْمَشْيُ عَلَى الأَقْدَامِ إِلَى الْجَمَاعَاتِ وَإِسْبَاغُ الْوُضُوءِ فِي الْمَكَارِهِ وَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ عَاشَ بِخَيْرٍ وَمَاتَ بِخَيْرٍ وَكَانَ مِنْ خَطِيئَتِهِ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ. ...
‘‘আজ রাতে আমার মহিমাময় প্রতিপালক সর্বোত্তম আকৃতিতে আমার নিকট আগমন করেন, তিনি বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেন: স্বপ্নের মধ্যে। তখন তিনি বলেন: হে মুহাম্মাদ, তুমি কি জান সর্বোচ্চ পরিষদ কোন্ বিষয়ে বিতর্ক করছে? আমি বললাম: না। তখন তিনি তাঁর হাত আমার দুই কাঁধের মধ্যে রাখলেন, এমনকি আমি তার শীতলতা আমার বক্ষের মধ্যে অনুভব করলাম। তখন আমি আকাশমন্ডলীর মধ্যে যা আছে এবং যমিনের মধ্যে যা আছে তা জানলাম। অন্য বর্ণনায়: পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যা আছে তা আমি জানলাম। তৃতীয় বর্ণনায়: তখন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে তা আমার কাছে উদ্ভাসিত হলো। তখন তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন: ‘‘এভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব বা পরিচালন-ব্যবস্থা দেখাই, আর যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’’[22] তখন তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, তুমি কি জান সর্বোচ্চ পরিষদ কোন্ বিষয়ে বিতর্ক করছে? আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি বলেন, তারা কাফ্ফারা বা পাপের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বিতর্ক করছেন। আর কাফ্ফারা হলো সালাত আদায়ের পরে মসজিদে অবস্থান করা, পায়ে হেটে জামাতে সালাত আদায়ের জন্য গমন করা এবং অসুবিধা সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা। যে ব্যক্তি এগুলি করবে সে কল্যাণের সাথে জীবন যাপন করবে, কল্যাণের সাথেই মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মাতৃগর্ভ থেকে জন্মের সময় তার পাপ যেরূপ ছিল তদ্রূপ হয়ে যাবে।’’[23]
এভাবে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে আসমান-যমিনের ও পূর্ব-পশ্চিমের অদৃশ্য বিষয়াদি জানিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন। এ দেখানোর অর্থ স্বভাবতই সকল গাইবী ইলম প্রদান করা নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এখানে তা স্পষ্টতই বুঝিয়েছেন। তিনি তাঁর এই দর্শনকে ইবরাহীম (আঃ)-এর দর্শনের সাথে তুলনা করেছেন। কুরআন কারীম থেকে আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব বা পরিচালন-ব্যবস্থা দেখান। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, তাঁকে সকল গাইবী জ্ঞান প্রদান করেন। কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে আমরা দেখি যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর শেষ জীবনে তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের সুসংবাদ নিয়ে এবং লূত (আঃ)-এর দেশের মানুষদের ধ্বংসের দায়িত্ব নিয়ে যখন ফিরিশতাগণ তাঁর কাছে আগমন করেন, তখন তিনি ফিরিশতাদেরকে চিনতে পারেন নি, তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও কিছু জানতে পারেন নি, তাঁর নিজের সন্তান হবে তাও তিনি জানতেন না এবং সন্তানের সুসংবাদ পেয়ে তিনি খুবই আশ্চার্যান্বিত হন। এ সকল বিষয় সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, এরূপ দর্শনের অর্থ গাইবী জগতের অনেক বিষয় দেখা, সকল বিষয়ের স্থায়ী জ্ঞান লাভ নয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের এ সকল আয়াত ও হাদীসের মধ্যে কোনোরূপ বৈপরীত্য কল্পনা করেন নি সাহাবীগণ এবং তাঁদের অনুসারী তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুসলিমগণ। এ সকল নির্দেশ সবই সরল ও স্বাভাবিক অর্থে বিশ্বাস করেছেন তারা। আল্লাহ ছাড়া কেউ গা্ইব জানেন না- কুরআন ও হাদীসের এ নির্দেশনা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানতেন না- কুরআন ও হাদীসের এ নির্দেশনাও সন্দেহাতীতভাবে সত্য। পাশাপাশি মহান আল্লাহ তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হিসেবে নুবওয়াতের দায়িত্ব ও মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গাইবের বিষয়াদি দেখিয়েছেন ও জানিয়েছেন- কুরআন ও হাদীসের এ নির্দেশনাও সন্দেহাতীতভাবে সত্য। যতটুকু জানিয়েছেন বা দেখিয়েছেন বলে কুরআন কারীম বা সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে তা সবই সরল অর্থে তারা বিশ্বাস করেছেন। এর বাইরে কিছু জানা বা না জানা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা-চিন্তা করা মুমিনের দায়িত্ব নয়।
৭ম-৮ম হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো আলিম দাবি করতে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সামগ্রিক ইলমুল গাইবের অধিকারী ছিলেন বা তিনি ‘আলিমুল গাইব’ ছিলেন। প্রসিদ্ধ ভারতীয় আলিম আব্দুল হাই লাখনবী বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে যে সকল মিথ্যা কথা বলা হয় তার অন্যতম হলো:
إن النبي (ﷺ) أعطي علم الأولين والأخرين مفصلا ووهب له علم كل ما مضى وما يأتي كليا وجزئيا وأنه لا فرق بين علمه وعلم ربه من حيث الاحاطة والشمول ، وإنما الفرق بينهما أن علم الله أزلي أبدي بنفس ذاته بدون تعليم غيره بخلاف علم الرسول فإنه حصل له بتعليم ربه
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকলের ও সকল কিছুর বিস্তারিত জ্ঞান প্রদত্ত হয়েছিলেন। যা কিছু অতীত হয়েছে এবং যা কিছু ভবিষ্যতে ঘটবে সবকিছুরই বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি জ্ঞান তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপকতায় ও গভীরতায় রাসূলুল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র পার্থক্য হলো, আল্লাহর জ্ঞান অনাদি ও স্বয়ংজ্ঞাত, কেউ তাঁকে শেখান নি। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহর জ্ঞান অর্জিত হয়েছে তাঁর প্রভুর শেখানোর মাধ্যমে।’’[24]
এ কথা উল্লেখ করার পর আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী বলেন: ‘‘এগুলি সবই সুন্দর করে সাজানো মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। ইবনু হাজার মাক্কী তার ‘আল-মিনাহুল মাক্কিয়াহ’ গ্রন্থে ও অন্যান্য প্রাজ্ঞ আলিম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই কথাগুিলি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, সামগ্রিক ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। একমাত্র তিনিই সকল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বা আলিমুল গাইব। এই জ্ঞান একমাত্র তাঁরই বিশেষত্ব ও তাঁরই গুণ। আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্য কাউকে এই গুণ প্রদান করা হয় নি। হ্যাঁ, আমাদের নবী (ﷺ)-এর জ্ঞান অন্য সকল নবী-রাসূলের (আঃ) জ্ঞানের চেয়ে বেশি। গাইবী বা অতিন্দ্রীয় বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর প্রতিপালক অন্যান্য সবাইকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার চেয়ে অধিকতর ও পূর্ণতর শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। তিনি জ্ঞান ও কর্মে পূর্ণতম এবং সম্মান ও মর্যাদায় সকল সৃষ্টির নেতা।[25]
মোল্লা আলী কারীও অনুরূপ কথা বলেছেন। কুরআন কারীমের যে সকল আয়াতে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘গাইব’ জানতেন না সেগুলি তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের বিভিন্নন ঘটনা, যেমন আয়েশা (রা)-এর গলার হার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদের ঘটনা ইত্যাদি উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এ সকল ঘটনা প্রমাণ করে যে, এরূপ গাইব কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতেন না এবং এরূপ জানার দাবি তিনি কখনোই করেন নি, বরং তিনি বারংবার বলেছেন যে, আমি গাইব জানি না। এরপর তিনি বলেন: ‘‘নিঃসন্দেহে তাদের এরূপ অতিভক্তি ও সীমালঙ্ঘনের কারণ হলো, তারা মনে করে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের গোনাহগুলি মাফ করে দিবে এবং তাদেরকে জান্নাতে ঢুকিয়ে দিবেন। তারা এভাবে তাঁর বিষয়ে যত বেশি অতিভক্তি ও অতিরিক্ত কথা বলবে ততই তারা তাঁর বেশি প্রিয় হবে। এভাবে ভক্তির নামে এরা তাঁর সবেচেয়ে বেশি অবাধ্যতা করছে এবং তাঁর সুন্নাত সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন করছে। খৃস্টানদের সাথে এদের সাদৃশ্য খুবই স্পষ্ট, যারা ঈসা মাসীহের (আঃ) বিষয়ে অতিভক্তি করেছে, তাঁর শরীয়ত লঙ্ঘন করেছে এবং তার দীনের সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে। প্রকৃত অবস্থা এই যে, এরা মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসগুলি সত্য বলে গ্রহণ করে আর সহীহ হাদীসগুলিকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে বাতিল করে।’’[26]
এক নযরেই আমরা বুঝতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইলমুল গাইব বিষয়ক উপরের এ মতটি একটি বিদ‘আতী বা বিভ্রান্ত মত। কারণ কুরআন কারীমে, কোনো সহীহ মুতাওয়াতির বা আহাদ হাদীসে বা সাহাবীগণের বাণীতে কোথাও এরূপ কথা বলা হয় নি। অন্যান্য বিভ্রান্ত বিদ‘আতী আকীদার ন্যায় কুরআনের কোনো কোনো কথার ব্যাখ্যা, কোনো কোনো হাদীসের ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে এ ‘আকীদা’ তৈরি করা হয়েছে।
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
(১) কুরআনে অনেক স্থানে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহই ‘আলিমুল গাইব’ এবং তিনি ছাড়া আসমান-যমীনের মধ্যে অন্য কেউ গাইব জানেন না। এ কথা বলা হয় নি যে, ‘আল্লাহর মত গাইব’ কেউ জানেন না, বরং বলা হয়েছে আল্লাহ ছাড়া কেউই গাইব জানেন না।
(২) কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাষায় বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানেন না। এর বিপরীতে একটি স্থানেও একটি বারের জন্যও দ্ব্যর্থহীন বা সুস্পষ্টভাবে বলা হয় নি যে, তিনি ‘আল্লামুল গুইঊব’, বা ‘আলিমুল গাইব’ বা সকল গাইবের জ্ঞান তাঁরা আছে।
(৩) অনেক সহীহ হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গাইব জানেন না। এর বিপরীতে একটি হাদীসেও তিনি বলেন নি যে, ‘আমি গাইব জানি’ বা ‘আমি আলিমুল গাইব’।
(৪) এই মতটিতে যে কথাগুলি দাবি করা হয়েছে সে কথাগুলি কখনোই এরূপভাবে বা এ ভাষায় কখনো কোনো সহীহ, যয়ীফ বা জাল হাদীসেও বলা হয় নি।
[2] সূরা (৬) আন‘আম: ৫৮ আয়াত।
[3] সূরা (১৮) কাহাফ: ২৬ আয়াত।
[4] সূরা (১১) হূদ: ১২৩ আয়াত।
[5] সূরা (৩১) লুকমান: ৩৪ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ১০৯ আয়াত।
[7] সূরা (১০) ইউনুস: ২০ আয়াত।
[8] সূরা (৬) আনআম: ৫০ আয়াত। আরো দেখুন (সূরা ১১ হূদ: ৩১ আয়াত)
[9] সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৮ আয়াত।
[10] সূরা (৪৬) আহকাফ: ৯ আয়াত।
[11] সূরা (২১) আম্বিয়া: ১০৭-১১১ আয়াত।
[12] সূরা (৯) তাওবা: ১০১ আয়াত।
[13] সূরা (৬৫) তালাক: ১ আয়াত।
[14] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ ২/৫২৩; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১৩/৩২৬৪। হাদীসটির সনদ হাসান। ড. যাকারিয়্যাহ, আশ-শিরক ২/৯৮৭।
[15] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১৩/৩২৬৪।
[16] বুখারী, আস-সহীহ ১/৪১৯, ৩/১৪২৯, ৬/২৫৭৫।
[17] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৪৬৯, ১৭৩৩, ১৮৪০, ৫/১৯৭৬, ৬/২৬৮৭, ৮/৬০৯ ৯/২০৩; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৬১১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/৩১৫।
[18] সূরা (৫) মায়িদা: ১১৭ আয়াত।
[19] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৯১, ১৭৬৬, ৫/২৩৯১, ২৪০৪, ২৪০৬, ৬/২৫৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৯৩-১৭৯৪।
[20] সূরা (৭২) জিন্ন:২৫-২৮ আয়াত।
[21] বুখারী, আস-সহীহ ১/৪৪, ৩১২।
[22] সূরা (৬) আন‘আম: ৭৫ আয়াত।
[23] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৬৬-৩৬৮; আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/৬৬, ৫/৩৭৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/১৭৬। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান।
[24] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৮।
[25] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৮।
[26] মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩২৩-৩২৫।