লগইন করুন
প্রথম কারণ হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের তাওহীদ, অর্থাৎ ইবাদতের তাওহীদ (তাওহীদুল উলূহিয়্যা) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদ বা জ্ঞানের তাওহীদের ফসল ও ফলাফল। যেহেতু আল্লাহ একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান কাজেই একমাত্র তাঁরই ইবাদাত উপসনা করা দরকার। যেহেতু সকল ক্ষমতাই তাঁর সেহেতু তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে উপসনা করা নিতান্তুই অর্থহীন ও জঘন্য অন্যায়। এজন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বারবার আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের (তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্র) কথা উল্লেখ করে একমাত্র তাঁরই ইবাদাতের আহবান জানিয়েছেন।
বস্ত্তত, ‘ইলাহ’ (উপাস্য) এবং ‘রাবব’ (প্রতিপালক)-এর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। তাওহীদ পন্থী মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কারো ‘ইলাহ’ বলতে পারেন না; কারণ মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ কোনোভাবে কোনো মুমিনের ‘ইলাহ’ বা উপাস্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কারো পালনকর্তা বা মালিক হিসেবে ‘রাবব’ বলতে পারে। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ জাওহারী (৩৯৫ হি) বলেন:
رَبُّ كلِّ شيءٍ: مالكُهُ. والربُّ: اسم من أسماء الله عَزَّ وجَلَّ، ولا يقال في غيره إلا بالإضافة
‘‘রাবব অর্থ মালিক বা স্বত্বাধিকারী, যে কোনো কিছুর রাবব অর্থ তার মালিক বা স্বত্বাাধিকারী। ‘আর-রাবব’ মহান আল্লাহর একটি নাম। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এ নামটি ব্যবহার করা যায় শুধু সম্পর্কের সাথে (অমুকের রাবব)।’’[1]
ইউসুফ (আঃ)-এর কারাবাসের ঘটনায় আল্লাহ বলেন:
وَقَالَ لِلَّذِي ظَنَّ أَنَّهُ نَاجٍ مِنْهُمَا اذْكُرْنِي عِنْدَ رَبِّكَ فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ
‘‘উভয়ের মধ্যে যে মুক্তি পাবে বলে ইউসুফ ধারণা করেছিল তাকে সে বলল, তোমার রবেবর (প্রভুর) নিকট আমার কথা বলো; কিন্তু শয়তান তাকে তার তার রবেবর (প্রভুর) নিকট তার বিষয় বলার কথা ভুলিয়ে দেয়।’’[2]
এখানে রাববুকা ও রাববুহু বলতে বাদশাহকে বুঝানো হয়েছে।
আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য কাফির-মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র প্রতিপালক ও সার্বভৌম সর্বশক্তিমান মালিক বা ‘রাবব’ বলে মানত, অথচ তাঁকে একমাত্র ‘ইলাহ’ হিসেবে মানত না। বিষয়টি ছিল একান্তই অযৌক্তিক ও মানবীয় জ্ঞানের সাথে সাংঘষিংক। কারণ যিনি একমাত্র প্রতিপালক তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো নিকট ‘চূড়ান্ত ভয় ও আশা-সহ চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে যাব কেন?
এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, ইলাহ এবং রাবব-এর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য থাকলেও, ব্যবহারে দুটি শব্দ একই সত্তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়া উচিৎ। যিনিই রাবব তিনিই ইলাহ হবেন। আর যিনি রাবব নন তার ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা থাকতে পারে না। এজন্য অনেক সময় ইলাহ অর্থে রাবব ও রাবব অর্থে ইলাহ ব্যবহার করা হয়।
এ কারণে কুরআন কারীমে বারংবার কাফিরদের কর্ম ও বিশ্বাসের এ অযৌক্তিকতা তুলে ধরে বারংবার মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে বারংবার রাবব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যেহেতু তিনিই একমাত্র রাবব বলে তোমরাও স্বীকার করছ, তবে কেন তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করছ?
আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন ‘তাওহীদুর রূবুবিয়্যাহ’ সম্পর্কে কাফিরদেরকে প্রশ্ন করতে। এ সকল প্রশ্নের উদ্দেশ্য জ্ঞানের তাওহীদ থেকে কর্মের তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া। যেহেতু তোমরাই স্বীকার করছ যে, আল্লাহই একমাত্র স্র্ষ্টা, প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান, সেহেতু তাকে ছাড়া আর কারও উপাসনা করা, প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া, জবাই, মানত বা উৎসর্গ করা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। এভাবে কাফিরদেরকে তাদের শির্কের অসারতা সুস্পষ্টভাবে বুঝানো হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কর্মের অসারতা স্বীকার করে নিয়েছে।
এ ছাড়াও কুরআন করীমে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের কথা উল্লেখ করে একমাত্র তারই ইবাদত করার নির্দেশ দেওয় হয়েছে। এখানে দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ.
‘‘হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। যিনি পুথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা এবং আকাশকে ছাদ করে দিয়েছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকা হিসাবে বিভিন্ন প্রকারের ফল ফসল উৎপাদন করেছেন। অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[3]
অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ. اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَشْكُرُونَ. ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ. كَذَلِكَ يُؤْفَكُ الَّذِينَ كَانُوا بِآَيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ. اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأَرْضَ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَتَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ. هُوَ الْحَيُّ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَمَّا جَاءَنِيَ الْبَيِّنَاتُ مِنْ رَبِّي وَأُمِرْتُ أَنْ أُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ.
তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহঙ্কারে আমার ইবাদতে বিমুখ হয় তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহই তোমাদের বিশ্রামের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন এবং দিনকে আলোকজ্জ্বল করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষদের প্রতি অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সব কিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ (মাবুদ বা উপাস্য) নেই। তাহলে তোমরা কিভাবে বিপথে যাচ্ছ? এইভাবেই বিপথগামী হয় তারা যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে অস্বীকার করে। আল্লাহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বসোপযোগী করেছেন এবং আকাশকে করেছেন ছাদ। তিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম আকৃতি দান করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ, কত মহান তিনি! তিনি চিরজ্ঞীর, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই, সুতরাং তোমরা তারই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাকেই ডাক। জগৎসমুহের প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্ত সকল প্রশংসা। বল, আমার প্রতিপালকের নিকট থেকে আমার কাছে সুষ্পষ্ট নির্দশন আসার পর আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমর ডাক তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে এবং আমাকে জগৎসমূহের প্রতিপালকের কাছে আতণসমর্পণ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।’’[4]
আমরা দেখেছি যে, ‘ডাকা’ বা প্রার্থনা করাই ইবাদতের মূল। এখানে মহান আল্লাহ প্রথমে আল্লাহকে ডাকতে বা তাঁর কাছেই প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ‘অহঙ্কারবশত’ যারা আল্লাহর ইবাদত করে না, অর্থাৎ আল্লাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ডাকে তাদের পরিণতি উল্লেখ করেছেন। এরপর আল্লাহর রূবুবিয়্যাতের তাওহীদের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে তাদেরকে ইবাদতের তাওহীদের দিকে আহবান করেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, কর্ম পর্যায়ের বা ইবাদতের তাওহীদ জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের স্বাভাবিক প্রকাশ ও ফলাফল। যিনি একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক একমাত্র তাঁরই ইবাদত উপাসনা করা উচিৎ। আর তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে যদি উপাসনা করা হয় তাহলে তাঁকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সব কিছুর মালিক বা সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করা অর্থহীন হয়ে যায়। এজন্যই ইসলামী বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কর্ম পর্যায়ের বা ইবাদতের তাওহীদের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ
‘‘যারা বলে, ‘আমাদের রাবব (প্রতিপালক) তো আল্লাহ’ এবং এতে অবিচলিত থাকে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’’[5]
কাফিরগণ স্বীকার ও বিশ্বাস করত এবং বলত যে ‘রাববুনাল্লাহ’ বা ‘আমাদের রবব তো আল্লাহ’। তারা মহান আল্লাহকে ‘আল্লাহ’ ও ‘আল্লাহুম্মা’ এবং ‘রাববানা’ বা ‘রাববী’ বলেই ডাকত। তবে তাদের এ ডাক ও বিশ্বাস ছিল অর্থহীন। কারণ আল্লাহকে রাবব হিসেবে বিশ্বাস করার পর আবার অন্য কারো ইবাদত করার অর্থ ‘রাববুনাল্লাহ’ বিশ্বাসে অবিচলিত না থেকে তা থেকে বিচ্যুত হওয়া। কাফিরদের এ বিচ্যুতির দিকে বারংবার ইঙ্গিত করে কুরআন কারীমে সর্বদা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
[2] সূরা (১২) ইউসুফ: ৪২ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২১-২২ আয়াত।
[4] সুরা (৪০) মুমিনূন (গফির) ৬০-৬৬ আয়াত
[5] সূরা (৪৬) আহকাফ: ১৩ আয়াত। পুনশ্চ: সূরা হজ্জ: ৪০ ও সূরা ফুস্সিলাত: ৩০ আয়াত।