লগইন করুন
আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা লেখাতেন এবং মুখস্থ করাতেন। তিনি কুরআন কারীমের ব্যাখ্যা হিসাবে যা বলতেন বা শেখাতেন সে সকল শিক্ষা অর্থাৎ হাদীস তিনি সাধারণত লিখতে নিষেধ করতেন। কারণ তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিল, যা মুসলিমগণ মুখস্থ করতেন এবং বিক্ষিপ্ত চামড়ার টুকরো, মাটির পাত, পাথর, খেজুর গাছের বাকল ইত্যাদিতে লিখে নিতেন। এ অবস্থায় হাদীস লেখা হলে ভুলবশত একজন মুসলিম কোনো হাদীসকে কুরআনের লিখিত পৃষ্ঠার সাথে মিশিয়ে ফেলতে পারেন এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পরে কুরআন নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। কুরআনের পরিপূর্ণ বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য তিনি মুসলিমদেরকে কুরআন মুখস্থ করতে ও লিখতে বলতেন। আর তাঁর বাণী ও কর্ম ,অর্থাৎ হাদীস শুধমাত্র মুখস্থকরে বর্ণনা করতে ও মানুষদেরকে শেখাতে বলতেন। এক্ষেত্রে তিনি হাদীস মুখস্থ করা ও বর্ণনার ক্ষেত্রে পরির্পর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন কেউ তাঁর নামে মিথ্যা না বলে, বা এমন কথা তাঁর নামে না বলে যা তিনি বলেন নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لا تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّي وَلا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ [متعمدا] فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ"
‘‘তোমরা আমার কাছ থেকে কিছু লিখবে না। যদি কেউ কুরআন ছাড়া আর কিছু লিখে থাক তাহলে তা মুছে ফেলবে। তোমরা আমার হাদীস মৌখিকভাবে বর্ণনা কর, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে (ইচ্ছা করে) মিথ্যা কথা বলবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দ হবে।’’[1]
মাদানী জীবনের শেষ দিকে তিনি কোনো কোনো সাহাবীকে হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেন। বিশেষত বিদায় হজ্জের সময় তিনি হাদীস লেখার অনুমতি দেন। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে সাধারণভাবে হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয় নি। কোনো কোনো সাহাবী কিছু হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। অধিকাংশ সাহাবী তাঁর শিক্ষা, বাণী, কর্ম অত্যন্ত যত্নের সাথে মুখস্থ করতেন, পরস্পরে তা আলোচনা করতেন এবং সেভাবে জীবন পরিচালনা করতেন।
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাদীস হুবহু মুখস্থ করে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিযেছেন।[2] অপরদিকে কোনো মানবীয় কথা যেন তাঁর নামে প্রচারিত হতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নামে মিথ্যা বা অতিরিক্ত কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন। উপরের হাদীসে আমরা তা দেখেছি। ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’-সহ প্রায় ১০০ জন সাহাবী এই মর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাবধান বাণী বর্ণনা করেছেন। আর কোনো হাদীস এত বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি।[3] উম্মাতের মধ্যে জালিয়াত ও জাল হাদীসের প্রাদুর্ভাব ঘটবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।[4] যাচাই না করে কোনো হাদীস গ্রহণ করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদীস বলে গ্রহণ করে ও বর্ণনা করে তাহলে হাদীস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে।[5]
এ সকল নির্দেশনার ভিত্তিতে সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাঁরা সাধারণত হাদীস বলতেন না। কখনো হাদীস বললে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বলতেন। অন্যের বলা হাদীস যাচাই বাছাই না করে গ্রহণ করতেন না। বর্ণনার নির্ভুলতা বা বিশুদ্ধতায় সন্দেহ হলে বর্ণনাকারীকে প্রশ্ন করে, অন্যান্য ব্যক্তিদেরকে প্রশ্ন করে বা বর্ণনাকারীকে শপথ করিয়ে বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। এরপরও সন্দেহ থাকলে তারা হাদীস গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করতেন। সাহাবী ছাড়া অন্য কেউ হাদীস বললে সনদ ছাড়া হাদীস গ্রহণ করতেন না। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার লেখা ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে।
সাহাবীগণের কর্মপদ্ধিতর অনুসরণে তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করেছেন। যাচাই-বাছাইয়ে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হাদীসকে তারা ‘সহীহ’ বা ‘হাসান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর অশুদ্ধ হাদীসকে যয়ীফ হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন। যয়ীফ হাদীসের মধ্যে রয়েছে বানোয়াট বা জাল হাদীস।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়: (১) ‘আদালত’: হাদীসের সকল রাবী (বর্ণনাকারী) পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত, (২) ‘যাবত’: তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত, (৩)‘ইত্তিসাল’: সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত, (৪) ‘শুযূয মুক্তি’: হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত এবং (৫) ‘ইল্লাত মুক্তি’: হাদীসটির মধ্যে সুক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত। প্রথম তিনটি শর্ত সনদ কেন্দ্রিক ও শেষের দুইটি শর্ত মূলত অর্থ কেন্দ্রিক। দ্বিতীয় শর্তে সামান্য দুর্বলতা থাকলে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে।[6] এ সকল শর্তের অবর্তমানে হা্দীসটি যয়ীফ বা দুর্বল অথবা বানোয়াট বা মাউযূ হাদীস বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার জন্য ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য।
আকীদার ক্ষেত্রে অবশ্যই কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের উপরেই নির্ভর করতে হবে। সকল যুগে সকল ইমাম ও আলিম এ বিষয়ে সতর্ক থেকেছেন। তাঁরা সর্বদা সহীহ্ বা বিশুদ্ধ হাদীসের উপর নির্ভর করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) বলেছেন:
إذا جاء الحديث الصحيح الإسناد عن النبي (ﷺ) أخذنا به ولم نَعْدُهُ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া গেলে তাঁর উপরেই আমরা নির্ভর করব, তার বাইরে যাব না।’’[7]
ইমাম আবু হানীফা (রাহ) তাঁর রচিত ‘আল ফিকহুল আকবার’ নামক গ্রন্থে বলেছেন:
وسائر علامات يوم القيامة على ما وردت به الأخبار الصحيحة حق كائن
‘‘কিয়ামতের অন্যান্য সকল পূর্বাভাস, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই সত্য এবং ঘটবেই।’’[8]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদের (রাহ) মাযহাবের ভিত্তিতে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম আবূ জাফার তাহাবী (৩২১ হি) বলেন:
وجميع ما صح عن رسول الله (ﷺ) من الشرع والبيان حق. ... وكل ما جاء في ذلك من الحديث الصحيح عن رسول الله (ﷺ) فهو كما قال ...
‘‘শরীয়ত এবং বিবরণ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যাক কিছু সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে সবই হক্ক। ..... এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ হাদীসে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই তিনি যেরূপ বলেছেন সেরূপই বিশ্বাস করতে হবে।’’[9]
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৩৩-৩৪; আবু দাউদ, আস-সুনান ৩/৩২২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৮৪-৮৬; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১/২৬৮, ২৭১, ৪৫৫; হাকিম নাইসাপূরী, আল-মুসতাদরাক ১/১৬২, ১৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৩৮-১৩৯।
[3] নববী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ (৬৭৬হি), শারহু সাহীহ মুসলিম ১/৬৮, ইবনুল জাউযী, আল-মাউযূ‘আত ২৮-৫৬।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১০।
[6] বিস্তারিত দেখুন: ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ. ৫৬-১২৩।
[7] ইবনু আব্দিল বার, আল ইনতিকা ফী ফাযাইলিল সালালাতিল আইম্মা, পৃ ১৪৪।
[8] মোল্লা আলী কারী, শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৯০-১৯২ ও ৩২৭।
[9] আবূ জাফার তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১০, ১৪।