লগইন করুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর প্রতি দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে এবং দু ভাবে তা সংরক্ষিত হয়েছে: কিতাব ও হিকমাহ বা সুন্নাত। এখানে আমরা এই দু প্রকারের ওহীর বিষয়ে আলোচনা করব। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর প্রতি প্রেরিত ওহীর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে তাঁর সহচর-সাহাবীগণের মতামতের গুরুত্বও আমরা আলোচনা করব।
১. ২. ৪. ১. কুরআন মাজীদ
কুরআন কারীম মানব জাতির কাছে প্রেরিত মহান আল্লাহর সর্বশেষ বাণী। এর প্রতিটি অক্ষর, শব্দ ও বাক্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। মহানবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর বযস যখন ৪০ বৎসর তখন থেকে আল্লাহ তাঁর কাছে ওহীর মাধ্যমে কুরআন প্রেরণ করতে শুরু করেন। পরবর্তী ২৩ বৎসর যাবৎ বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন মত কুরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াত অবতীর্ণ করা হয়। ২৩ বৎসরে তা পরিপূর্ণরূপে অবতারিত হয়। আল্লাহর নিকট থেকে প্রধান ফিরিশতা (Archangel) জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ করে নিতেন। এরপর তিনি তার সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন তা মুখস্থ করার জন্য এবং লিখে রাখার জন্য। এভাবে পরিপূর্ণ কুরআন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর জীবদ্দশায় পৃথক পৃথক কাগজ, চামড়া, হাড় ইত্যাদিতে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং অসংখ্য সাহাবী তা মুখস্থ করে নেন। তাঁর সময় থেকেই তিনি ও সাহাবীগণ সাধারণ সালাতে এবং বিশেষত রাত্রিতে তাহাজ্জুদের সালাতে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও খতম করতেন, অর্থাৎ পরিপূর্ণ কুরআন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ পাঠ করতেন। অনেক সাহাবীই ৩ থেকে ৭ রাত্রিতে তাহাজ্জুদের সালাতে কুরআন খতম করতেন। কেউ কেউ একটু বেশি সময় ধরে কমবেশি এক মাসের মধ্যে তাহাজ্জুদ সালাতে কুরআন খতম করতেন। এছাড়া নিজের কাছে সংরক্ষিত লিখিত পান্ডুলিপি থেকে দেখে দেখে দিবসে ও রাত্রিতে তা পাঠ করা ছিল সাহাবীগণের প্রিয়তম ইবাদত ও হৃদয়ের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি ও আনন্দের কর্ম।
এভাবে মূলত মুমিনদের হৃদয়ে মুখস্থ রেখে ও নিয়মিত রাতের সালাতে (তাহাজ্জুদে) খতমের মাধ্যমেই কুরআনকে অবিকল আক্ষরিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন আল্লাহ। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর ওফাতের পরের বৎসর খলীফা আবূ বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সময়ে লিখিত পৃথক কাগজ, চামড়া, হাড় ইত্যাদি থেকে একত্রিত করে পুস্তকাকারে সংকলন করান। পরবর্তীকালে খলীফা উসমান (রা) তাঁর শাসনামলে নতুন মুসলিম প্রজন্মের মানুষদের বিশুদ্ধ কুরআন শিক্ষা ও মুখস্থ করণের সুবিধার্থে আবূ বাক্র (রা) কর্তৃক পুস্তকাকারে সংকলিত কুরআনটির বিভিন্ন অনুলিপি তৈরি করে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন।
এভাবে সকল মুসলিমের প্রাত্যহিক পাঠের প্রিয়তম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কুরআন কারীম পরিপূর্ণ ও অবিকৃতভাবে অগণিত মানুষের হৃদয়পটে এবং পুস্তকাকারে সংরক্ষিত হয়। যেভাবে তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর উপর অবতারিত হয়েছে আজ পর্যন্ত ঠিক তেমনিভাবে অবিকৃত ও অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সকল যুগেই লক্ষ লক্ষ মুসলিম তা পরিপূর্ণ মুখস্থ করে রেখেছেন।
এ কুরআনই মানব জাতির পথের দিশারী এবং সকল কল্যাণের উৎস। এতে রয়েছে সকল উপদেশ, শিক্ষা ও সকল আত্মিক ও মানসিক অসুস্থতার মহৌষধ। কুরআনের বৈশিষ্ট্য কুরআন কেন্দ্রিক ঈমান, আকীদা ও জীবন গঠন সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে ‘আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান’ ও ‘কুরআনের প্রতি ঈমান’ পরিচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করব। কুরআনই প্রত্যেক মুমিনের বিশ্বাস, ঈমান বা আকীদার মূল ভিত্তি। কুরআন কারীমে যা কিছু বলা হয়েছে তা আক্ষরিকভাবে ও সরলভাবে বিশ্বাস করাই ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি। কোন্ বিষয়ে বিশ্বাস করতে হবে, কিভাবে বিশ্বাস করতে হবে, কিসে বিশ্বাস নষ্ট হবে, কিসে কুফরী হবে, কিসে শিরক হবে, কিভাবে ও কি কারণে পূর্ববর্তী উম্মাতগণ ঈমান লাভ করার পরেও বিভ্রান্ত হয়েছিল, কিভাবে বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষা করা যায়, কিভাবে ঈমানদার ব্যক্তি জীবনযাপন করবেন, ইত্যাদি বিষয়ই হলো, কুরআন কারীমের মূল শিক্ষা। আল-কুরআনই ইসলামী আকীদার প্রধান ও মূল উৎস।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআনের আয়াত থেকে আক্ষরিক, সরল ও স্বাভাবিক যে অর্থ বুঝা যায় তাই আকীদার মূল উৎস, কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা নামে পরিচিতি পরবর্তী যুগগুলির আলিমগণের মতামত আকীদার উৎস নয়। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমকে সহজ ও অত্যন্ত সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল করেছেন এবং তা বুঝা সহজ করেছেন বলে কুরআন কারীমে বারংবার উল্লেখ করেছেন। সাধারণভাবে কুরআন কারীম নিজেই নিজের ব্যাখ্যা করে। এছাড়া কুরআনের ব্যাখ্যার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হলে তাও ওহীর ব্যাখ্যা বলে গণ্য। এছাড়া আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়ীগণের ব্যাখ্যাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদাণ করা হয়। পরবর্তী যুগের আলিমগণ তাফসীরের ক্ষেত্রে যা কিছু বলেছেন তা আলিমগণের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ, রায় বা মতামত হিসেবে পর্যালোচনার গুরুত্ব লাভ করে, কিন্তু কখনোই তা ওহীর সমতুল্য বা সম্পূরক নয় এবং তা আকীদার ভিত্তি নয়। আমরা আকীদার উৎস বিষয়ে বিভ্রান্তি আলোচনাকালে বিষয়টি পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।