লগইন করুন
বস্তুত আমরা একথা বলতে পারি না অমুক কর্ম সবাই করছে বা আমাদের সমাজে যুগ ধরে চালু আছে, কাজেই তা ঠিক এবং আমরা তা করব। কারণ কোনো কর্ম বা বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত থাকা বা পিতা পিতামহদের যুগ থেকে অর্চিত হওয়া তার সঠিক হওয়ার বা নির্ভুল হওয়ার প্রমাণ নয়। সমাজের প্রচলিত কর্ম বা বিশ্বাস ঠিকও হতে পারে, ভুলও হতে পারে। সঠিক বা ভুল প্রমাণিত হবে জ্ঞানের মাধ্যমে।
যেমন মনে করুন কোনো সমাজে প্রচলিত আছে যে কারো জ্বুর হলে অমুক গাছের রস বা ফল খেলে সুস্থ হয়ে যাবে। সেখানে এ কথাও প্রচলিত যে অমুক কর্ম করলে আল্লাহ তাকে পুরস্কার বা বরকত দান করবেন বা সে মৃত্যুর পরে শান্তি পাবে।
সমাজে প্রচলিত থাকা এই ধারণা দুইটির সঠিকত্বের প্রমাণ নয়। এগুলো ঠিক না ভুল তা জানতে হলে আমাদের জ্ঞানের সন্ধান করতে হবে। আমাদের জ্ঞান দু প্রকারের: প্রথমত, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যুক্তি বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং দ্বিতীয়ত, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহীলব্ধ জ্ঞান।
প্রথম ধারণাটি, অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি গাছের রস বা ফল খেলে জ্বর সেরে যাবে এই বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে আমাদের ল্যাবরেটরীর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এভাবে আমরা জানতে পারব যে, উপরোক্ত ধারণাটি সঠিক অথবা সঠিক নয়।
দ্বিতীয় ধারণাটি, অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি কর্মে আল্লাহ খুশি হবেন বা বরকত দান করবেন বা তাতে মুত্যুর পরে শান্তি পাওয়া যাবে, এই বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে আমাদেরকে ওহীলব্ধ জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে; কারণ এই বিষয়টি আমাদের মানবীয় গবেষণা ও অভিজ্ঞতার উর্ধ্বে। এজন্য আমরা এক্ষেত্রে দেখব আল্লাহ বিষয়টি ওহীর মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন কিনা।
এ জন্য আমরা দেখি যে, বিভিন্ন যুগে ও জাতিতে যখন কাফিররা তাদের প্রতি প্রেরিত রাসূলের উপর ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে এবং তাদের সমাজে প্রচলিত ধর্ম ও বিশ্বাসকে সঠিক বলে দাবি করেছে, তখন তিনি তাদেরকে ওহীর জ্ঞান থেকে প্রমাণ পেশ করতে আহবান করেছেন এবং ঈমানের ব্যাপারে ওহীর উপর নির্ভর না করার নিন্দা করেছেন।[1]
মক্কার কাফিরদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। তারা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনতে অস্বীকার করলো এবং তাদের সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস ও আচার আচরণকে সঠিক বলে দাবি করলো, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের বিশ্বাস ও ধর্মের পক্ষে অহীলব্ধ জ্ঞান থেকে প্রমাণ পেশ করার আহবান জানান। আল্লাহ বলেন:
قُلْ أَرَأَيْتُمْ شُرَكَاءَكُمُ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ أَمْ آَتَيْنَاهُمْ كِتَابًا فَهُمْ عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْهُ بَلْ إِنْ يَعِدُ الظَّالِمُونَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا إِلا غُرُورًا
‘‘বল, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে তা আমাকে দেখাও, অথবা আকাশমন্ডলীর সৃষ্টিতে তাদের কোনো অংশ আছে কি? না কি আমি তাদেরকে কোনো কিতাব দিয়েছি (ওহীর জ্ঞান দান করেছি) যার প্রমাণের উপর তারা নির্ভর করে? বস্তুত জালিমরা একে অপরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।’’[2]
এখানে কুরআন কারীমের প্রমাণপেশের পদ্ধতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমে সাধারণ মানবীয় বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির উপর নির্ভর করা হয়েছে এবং এরপর ওহীর প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। এরপর তাদের শিরকের প্রকৃত অবস্থা বলা হয়েছে।
সাধারণ মানবীয় বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির তো দাবি এই যে, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সকল ক্ষমতার মালিক তাকেই একমাত্র ডাকতে হবে এবং ইবাদত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, ঈসা (আঃ), উযাইর (আঃ), ইবরাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ), অন্যান্য নবীগণ, ফিরিশতাগণ বা কাল্পনিক দেব-দেবিগণ আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে বিপদে আপদে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকা হয় তাদের ডাকার পিছনে যৌক্তিকতা বা দলীল কি? তারা কি বিশ্বের কোনো কিছু সৃyুষ্ট করেছেন? পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, মুশরিকগণ একবাক্যে স্বীকার করছে যে, তারা কোনোকিছুই সৃষ্টি করেন নি, বরং মহান আল্লাহই মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক। এতে স্বাভাবিক বিবেক ও বুদ্ধি দ্বারা যে কোনো জ্ঞানী মানুষ স্বীকার করবেন যে, মহান আল্লাহই যেহেতু একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সকল ক্ষমতার মালিক, তাহলে তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করা বা বিপদে আপদে অন্য কাউকে ডাকা বিবেক-বিরুদ্ধ ও অর্থহীন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ওহীর প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। তাদের এ বিবেক ও যুক্তিবিরুদ্ধ কর্মের পক্ষে তারা দাবি করত যে, যাদেরকে তারা ইবাদত করে বা বিপদে আপদে যাদেরকে ডাকে তারা আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা আল্লাহর ‘সন্তান’, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন। তাদের এ দাবি আংশিক সত্য ছিল। আমরা দেখেছি যে, এদের অনেকেই মূলত নবী, ফিরিশতা বা নেককার মানুষ ছিলেন। আর কিছু ছিল কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব। তবে আল্লাহর প্রিয় হওয়া তো ইবাদত পাওয়ার বা ইলাহ হওয়ার কোনো প্রমাণ নয়। এজন্য মুশরিকগণ এক্ষেত্রে আরো দুটি দাবি করত। প্রথমত তারা দাবি করত যে, এদের ডাকলে বা এদের ইবাদত করলে এরা আল্লাহর নৈকট্য মিলিয়ে দেন।[3] দ্বিতীয়ত তারা দাবি করত যে, আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করে আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন।[4]
তাদের এ সকল যুক্তি সবই ছিল কল্পনা, ধারণা, অনুমান এবং প্রকৃত ওহীর শিক্ষার অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি। এজন্য আল্লাহ বারংবার তাদের কাছে ‘কিতাব’ বা ওহীর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা দাবি করেছেন। যুক্তি ও বিবেক দাবি করে যে, একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালককেই ইবাদত করতে হবে। তবে তিনি যদি ওহীর মাধ্যমে বলে দেন যে, আমার ইবাদতের প্রয়োজন নেই, আমার নৈকট্য পেতে হলে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের ইবাদত করতে হবে, তাহলে তারা তোমাদেরকে আমার নৈকট্য পাইয়ে দেবে, অথবা আমার কাছে সরাসরি কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবে না, বরং আমার প্রিয় বান্দাদের নিকট তোমাদের আব্দার পেশ করবে, তারা আমার কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করবে। যদি এরূপ কোনো নির্দেশ তিনি সুস্পষ্টভাবে দিতেন তবে আমরা তার নির্দেশ পালন করতাম। এরূপ কোনো নির্দেশ তিনি কখনোই দেন নি। কাজেই তোমাদের কর্ম যুক্তি ও বিবেক বিরুদ্ধ এবং ওহীর নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক।
সবশেষে তাদের শিরকের প্রকৃত অবস্থা মহান আল্লাহ জানিয়েছেন। বস্ত্তত মুশরিকগণ একে অপরকে তাদের মিথ্যা কল্পনা প্রসূত প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তোমরা এদের ইবাদত কর, এদের কাছে প্রার্থনা কর, এদেরকে ডাক, এরা তোমাদের ত্রাণ করবে, আখিরাতে মুক্তি দেবে ইত্যাদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই তাদের একমাত্র সম্বল।
মক্কার কাফিররা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে বলে বিশ্বাস করত। তাদের এই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল কল্পনা ও সমাজের প্রচলিত কথা। কোনো ওহীলব্ধ জ্ঞানের উপর এই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল না। পবিত্র কুরআনে তাদের এই বিশ্বাসের অযৌক্তিকতা ও বিভ্রান্তি বর্ণনা করার পরে তাদে কাছে তাদের বিশ্বাসের পক্ষে অহীলব্ধ জ্ঞান থেকে, অর্থাৎ আল্লাহ পক্ষ থেকে প্রেরিত গ্রন্থ থেকে প্রমাণ চেয়ে বলা হয়েছে:
أَمْ لَكُمْ سُلْطَانٌ مُبِينٌ فَأْتُوا بِكِتَابِكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
‘‘তোমাদের কাছে কি কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে? তাহলে তোমাদের ওহীলব্ধ কিতাবটা নিয়ে এস, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’’[5]
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, বিশ্বাসের ভিত্তি অবশ্যই ওহী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো জ্ঞানের উপর হতে হবে। আল্লাহ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে ও জাতিতে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং ওহী পাঠিয়েছেন, এসকল ওহীর কিতাব (Divine Scripture) সবই নষ্ট বা বিকৃত হয়ে গিয়েছে, যে বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব। এক মাত্র সর্বশেষ রাসূল মহানবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর কাছে পাঠানো ওহীই নির্ভূলভাবে সংরক্ষিত হয়েছে , যার উপর আমরা আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করতে পারি।
[2] সূরা (৩৫) ফাতির: ৪০ আয়াত।
[3] সূরা (৩৯) যুমার: ৩ আয়াত।
[4] সূরা (১০) ইউনূস: ১৮ আয়াত।
[5] সুরা (৩৭) সাফফাত: ১৫৬-১৫৭ আয়াত। আরো দেখুন: সুরা যুখরুফ: ২১ আয়াত।