লগইন করুন
মানবীয় জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। লোকাচার, যুক্তি, অভিজ্ঞতা, দর্শন, ল্যাবরেটরির গবেষণা ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস থেকে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। এখন প্রশ্ন হলো, ঈমান, বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস বা আকীদা বিষয়ক জ্ঞানের উৎস কী?
আমরা জানি যে, ঈমান বা ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্র মহান স্রষ্টা আল্লাহ। সকল যুগের মানব সমাজের ইতিহাস ও সভ্যতা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সকল যুগে সকল দেশে সকল জাতির ও সমাজের প্রায় সকল মানুষই এ বিশ্বাস করেছেন বা করেন যে, এই বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুবই কম। বর্তমান বিশ্বের শতশত কোটি মানুষের মধ্যেও অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না। এর মূলত দুটো কারণ রয়েছে:
প্রথমত: স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস মানুষের জন্মগত ও প্রাকৃতিক অনুভুতি। আত্মপ্রেম, পিতামাতা বা সন্তানের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদির মত স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস মানুষের অস্থিমজ্জার সাথে মিশে আছে। মহান স্রষ্টা এই বিশ্বাসের অনুভুতি দিয়েই প্রতিটি মানব আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন। এ বিশ্বাস বিকৃত হতে পারে, একে অবদমিত করা যায়, তবে একে একেবারে নির্মূল করা যায় না। তাই যারা নিজেদেকে স্রষ্টায় বিশ্বাসী নন বলে মনে করেন তাঁরাও মূলত মনের গভীরতম স্থান থেকে বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে পারেন নি, যদিও তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন অবিশ্বাস করার।
দ্বিতীয়ত: এই বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টাকে চেনার ও জানার নিদর্শন ও প্রমাণ রয়েছে। তাই সৃষ্টির রহস্য ও সক্ষ্মতা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যত বাড়ছে, স্রষ্টার মহত্তের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ততই গভীর হচেছ। সৃষ্টির রহস্য, জটিলতা, মানবদেহ, জীবজগত, গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদি বিশাল সুশৃঙ্খল সুনিয়ন্ত্রিত বিশ্ব নিয়ে যারাই গবেষণা বা চিন্তাভাবনা করেছেন বা করছেন, তারাই স্রষ্টার মহত্বের উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ হচ্ছেন।
এখানে প্রশ্ন উঠে যে, সকল দেশের সকল মানুষ যখন স্রষ্টার বিশ্বাসে একমত, তাহলে ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এত মতবিরোধ কেন?
এর কারণ, স্রষ্টার অস্তিত্বে মূলত মতবিরোধ নেই। মতবিরোধ হয়েছে স্রষ্টার প্রকৃতি, সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক, স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব, তাঁকে ডাকার বা তাঁর উপাসনা করার নিয়ম পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে। প্রত্যেক মানুষই নিজের জন্মগত অনুভুতি দিয়ে এবং সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তার জ্ঞান, যুক্তি ও বিবেক দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করেন। তবে কিভাবে তাঁকে ডাকতে হবে, কিভাবে তাঁর প্রতি মনের আকুতি প্রকাশ করতে হবে, কিভাবে তাঁর সাহায্য, করুণা বা সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে ইত্যাদি বিষয় মানুষ যুক্তি, বিবেক বা গবেষণার মাধ্যমে বুঝতে পারে না । এক্ষেত্রে যখনই মানুষ নিজের ধারণা বা কল্পনার অনুসরণ করে, তখনই মতবিরোধের সৃষ্টি হয় এবং মানুষ বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়।
এ জন্য মহান স্রষ্টা করুণাময় আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে সৃষ্টির সেরা রূপে সৃষ্টি করার পরেও তার পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি, সমাজ ও জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কিছু মহান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে তাঁর বাণী বা ওহী প্রেরণ করেছেন। মানুষ যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক, গবেষণা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যে সকল বিষয় সঠিক ও চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয় না সে সকল বিষয় তিনি ওহী বা প্রত্যাদেশের (devine revelation/ inspiration) মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন।
কিভাবে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে, কিভাবে নবী রসুলদের উপর ঈমান আনতে হবে, কিভাবে আল্লাহকে ডাকতে হবে বা তাঁর ইবাদত-আরাধনা করতে হবে, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক কিরূপ হবে, মৃত্যুর পরে মানুষের কি অবস্থা হবে ইত্যাদি বিষয় বিশেষভাবে ওহীর মাধ্যমে বিস্তারিত শিক্ষা দান করেছেন। এ বিষয়গুলিই ঈমান বা ধর্ম-বিশ্বাসের ভিত্তি।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান বা ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ক জ্ঞানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস ওহী (revelation)। এজন্য কুরআন ও হাদীসে একদিকে যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞানের উপর ঈমান বা বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে তেমনি লোকাচার, কুসংস্কার, সামাজিক প্রচলন, ধর্মগুরু বা পূর্বপুরুষদের শিক্ষা, অস্পষ্ট ভাসা ভাসা ধারণা বা নিজের ব্যক্তিগত যুক্তি ও পছন্দের উপর বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করতে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহীর জ্ঞান ছাড়া নিজের ধারণা, মতামত, সমাজের প্রচলন ইত্যাদির উপর নির্ভরতা মানুষের বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ বলে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে। একস্থানে মহান আল্লাহ বলেন,
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ
‘‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া অন্য অভিভাবককে অনুসরণ করো না।’’[1]
ওহীর বিপরীতে ওহীকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে যুগে যুগে মানুষদের যুক্তি ও প্রমাণ ছিল সামাজিক প্রচলন, পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস বা নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দ। এই প্রবণতাকে বিভিন্ন মানব সমাজের বিভ্রান্তির মূল কারণ হিসেবে কুরআন কারীমে চিত্রিত করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আমরা দেখতে পাই যে, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে যখন আল্লাহর নবী-রাসূলগণ সঠিক বিশ্বাস বা ইসলাম প্রচার করেন, তখন সেই জাতির অবিশ্বাসীরা নবী-রাসুলদের আহবান এই যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, তাদের প্রচারিত বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসের পরিপন্থী, তারা যুগ যুগ ধরে যা জেনে আসছেন মেনে আসছেন তার বিরোধী। নূহ (আঃ) সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে যে, তিনি যখন তার উম্মতকে ইসলামের পথে আহবান করলেন তখন তারা তার আহবান প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে:
مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي آَبَائِنَا الأَوَّلِينَ
‘‘আমরা তো আমাদের পুর্বপুরুষদের মধ্যে এ কথা শুনিনি।’’[2]
মূসা (আঃ) যখন ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর পথে আহবান করেন তখন তারাও একই যুক্তিতে তার উপর ঈমান আনতে অস্বীকার করে বলে:
وَمَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي آَبَائِنَا الْأَوَّلِينَ
‘‘আমাদের পূর্ব পুরুষদের কালে কখনো আমরা এরূপ কথা শুনি নি।’’[3]
সকল যুগে অবিশ্বাসীরা এ যুক্তিতেই ওহী প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহ বলেন:
وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آَبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آَثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ
‘‘এবং এভাবে আপনার পূর্বে কোনো জনপদে যখনই কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই সে জনপদের সমৃদ্ধশালী (নেতৃপর্যায়ের) লোকেরা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের উপর এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে চলেছি’।’’[4]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মক্কায় ইসলাম প্রচার করেন, তখন মক্কার অবিশ্বাসীরা এই একই যুক্তিতে তাঁর আহবান প্রত্যাখ্যান করেন। কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে বারংবার তাদের এই যুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[5]
বস্ত্তত, তারা যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রচারিত বিশ্বাস ও কর্ম ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তারা দাবি করতেন যে, ইবরাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও অন্যান্য নবী ও নেককার মানুষদের থেকে পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে পাওয়া তাদের বিশ্বাসই সঠিক। তাদের মতের বিরুদ্ধে ওহীর মতকে গ্রহণ করতে তারা রাজি ছিলেন না। আবার তাদের বিশ্বাসকে কোনো ওহীর সূত্র দ্বারা প্রমাণ করতেও রাজি ছিলেন না। বরং তাদের বিশ্বাস বা কর্ম ‘পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে নবী-রাসূল বা নেককার মানুষদের থেকে প্রাপ্ত’ একথাটিই ছিল তাদের চূড়ান্ত দলিল ও যুক্তি। এ বিষয়ে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। একস্থানে মহান আল্লাহ বলেন:
وَجَعَلُوا الْمَلائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ مَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا يَخْرُصُونَ أَمْ آَتَيْنَاهُمْ كِتَابًا مِنْ قَبْلِهِ فَهُمْ بِهِ مُسْتَمْسِكُونَ بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آَبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آَثَارِهِمْ مُهْتَدُونَ
‘‘তারা দয়াময় আল্লাহর বান্দা ফিশিতাগণকে নারী বলে গণ্য করেছে; তাদের সৃষ্টি কি তারা প্রত্যক্ষ করেছিল? তাদের উক্তি লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা বলে, ‘দয়াময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের পূজা-উপাসনা করতাম না।’ এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই; তারা তো কেবল আন্দায-অনুমান করে মিথ্যা বলছে। আমি কি তাদেরকে কুরআনের পূর্বে কোনো কিতাব দান করেছি যা তারা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে? বরং তারা বলে, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই সুপথপ্রাপ্ত হব।’’[6]
এখানে মক্কার মানুষদের দুটি বিশ্বাসের পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রথমত ফিরিশতাগণকে নারী বলে বিশ্বাস করা এবং দ্বিতীয়ত তাকদীরের বিশ্বাস বা আল্লাহর ক্ষমতার বিশ্বাস বিকৃত করে নিজেদের কর্মকে আল্লাহর পছন্দনীয় বলে দাবি করা। অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তো কিছুই হয় না; কাজেই আল্লাহর ইচ্ছা না হলে তো আমরা ফিরিশতাদের পূজা করতাম না। অথবা আল্লাহর পবিত্র নগরীতে পবিত্র ঘরের মধ্যে আমরা ফিরিশতাদের উপাসনা করে থাকি। এ কর্ম যদি আল্লাহর পছন্দনীয় না হতো তবে তিনি অবশ্যই আমাদের শাস্তি প্রদান করতেন। তিনি যেহেতু আমাদেরকে শাস্তি দেন নি, সেহেতু আমরা বুঝতে পারি যে, এ কর্মে তিনি সন্তুষ্ট রয়েছেন।
তাদের এ বিশ্বাসের বিষয়ে কুরআনের বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বিশ্বাসের বিষয়টি ‘গাইব’ বা অদৃশ্য জগতের সাথে সম্পৃক্ত। দেখে, প্রত্যক্ষ করে বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞাত হয়ে এ বিষয়ে কিছু বলা যায় না। একমাত্র ওহী ছাড়া এ বিষয়ে কিছুই বলা সম্ভব নয়। ওহীর বাইরে যা কিছু বলা হয় তা আন্দায, মিথ্যা বা ওহীর বিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়। আর মক্কার মানুষদের এই বিশ্বাস দুটি প্রমাণের জন্য তারা পূর্বের কোনো আসমানী কিতাব বা ওহীর প্রমাণ দিতে অক্ষম ছিল। কারণ তাদের নিকট এরূপ কোনো গ্রন্থ ছিল না। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল দ্বিবিধ: প্রথমত, ওহীর জ্ঞানের ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা। দ্বিতীয়ত, পূর্বপুরুষদের দোহাই দেওয়া।
প্রথম বিষয়টি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন যে, তারা স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন কোনো ওহীর বাণী এক্ষেত্রে পেশ করতে পারে না; বরং আন্দাযে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলে।
দ্বিতীয় বিষয়টি কুরআনে বিভিন্ন ভাবে খন্ডন করা হয়েছে। প্রথমত, পূর্ব পুরুষদের অনেকেই সত্যিই নেককার ছিলেন বা নবী-রাসূল ছিলেন। তবে তাদের নামে যা প্রচলিত তা সঠিক কিনা তা যাচাই করা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের দোহাই না দিয়ে সুস্পষ্ট ওহীর নির্দেশনা মত চলতে হবে। এ বিষয়ে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে ইবরাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ), ইসহাক (আঃ), ইয়াকূব (আঃ) ও অন্যান্য নবী-রাসূলের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে:
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘সে সকল মানুষ অতীত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের। তোমরা যা অর্জন করা তা তোমাদের। তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।’’[7]
অন্যান্য স্থানে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, পরবর্তী পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত ছিলেন। কাজেই ওহীর বিপরীতে এদের দোহাই দেওয়া বিভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। আল্লাহ বলেছেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلا يَهْتَدُونَ
‘‘যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, ‘না, না, বরং আমরা আমাদের পিতা- পিতামহাদেরকে যে কর্ম ও বিশ্বাসের উপরে পেয়েছি তারই অনুসরণ করে চলব। এমনকি তাদের পিতা-পিতামহগণ যদিও কিছুই বুঝত না এবং তার সৎপথেও পরিচালিত ছিল না, তথাপিও?’’[8]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন যে, পূর্বপুরুষগণ কেমন ছিলেন সে কথা নিয়ে বিতর্ক না করে মূল বিশ্বাস বা কর্ম নিয়ে চিন্তা কর। যদি নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ওহীর জ্ঞান প্রচলিত বিশ্বাস বা কর্মের চেয়ে উত্তম হয় তবে পিতৃপুরুষদের দোহায় দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করো না। মহান আল্লাহ বলেন:
قَالَ أَوَلَوْ جِئْتُكُمْ بِأَهْدَى مِمَّا وَجَدْتُمْ عَلَيْهِ آَبَاءَكُمْ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ
‘‘(সে নবী) বলেন, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের যে পথে পেয়েছ আমি যদি তোমাদের জন্য তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথ-নির্দেশ আনয়ন করি, তবুও কি তোমরা তাদের পদাংক অনুসরণ করবে?’ তারা বলে, ‘তোমরা যা সহ প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি’।’’[9]
ওহীর বিপরীতে অবিশ্বাসীদের এরূপ বিশ্বাসকে ‘ধারণা’ ‘কল্পনা’ বা ‘আন্দায’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلا آَبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلا تَخْرُصُونَ
‘‘যারা শিরক করেছে তারা বলবে, ‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তবে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শিরক করতাম না এবং কোনো কিছুই নিষিদ্ধ করতাম না।’ এভাবে তাদের পূর্ববর্তিগণও অবিশ্বাস করেছিল, অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বলুন, তোমাদের নিকট কোনো ‘ইলম’ (জ্ঞান) আছে কি? থাকলে আমাদের নিকট তা পেশ কর। তোমরা শুধু ধারণারই অনুসরণ কর এবং তোমরা শুধু অনুমান নির্ভর মিথ্যা কথাই বল।’’[10]
এখানেও তাকদীরের বিশ্বাস বা আল্লাহর ক্ষমতার বিশ্বাসকে বিকৃত করে তারা যা বলেছে তাকে ‘আন্দায’, ‘ধারণা’ বা ‘কল্পনা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে তাদের নিকট তাদের বিশ্বাসের ও দাবির স্বপক্ষে ‘ইলম’ বা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ওহীর বক্তব্য দাবি করা হয়েছে।
অন্য স্থানে বলা হয়েছে:
وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلا يَخْرُصُونَ
‘‘যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ কর তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করবে; তারা কেবলমাত্র ধারণার অনুসরণ করে চলে এবং তার শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে।’’[11]
অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلا ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
‘‘অধিকাংশ মানুষই কেবলমাত্র ধারণা-কল্পনার অনুসরণ করে চলে। বস্ত্তত সত্যকে জানার ক্ষেত্রে ধারণা কোনো কাজেই আসে না। ’’[12]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالآَخِرَةِ لَيُسَمُّونَ الْمَلائِكَةَ تَسْمِيَةَ الأُنْثَى وَمَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَإِنَّ الظَّنَّ لا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
‘‘যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারা ফিরিশতাদেরকে নারীবাচক নাম দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান (ইলম) নেই; তারা কেবল ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করে; আর সত্যের মুকাবিলায় ধারণা-অনুমানের কোনো মূল্য নেই।’’[13]
এছাড়া এরূপ বিশ্বাসকে ‘প্রবৃত্তির অনুসরণ’ বা নিজের মন-মর্জি বা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের অনুসরণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আমার কাছে পছন্দ কাজেই আমি এই মত গ্রহণ করলাম এবং আমার কাছে পছন্দ নয় কাজেই আমি এই মত গ্রহণ করলাম না। আমার পছন্দ বা অপছন্দ আমি ‘ওহী’ দ্বারা প্রমাণ করতে বাধ্য নই।
নিঃসন্দেহে, গাইব বা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ওহীর বাইরে যা কিছু বলা হয় সবই ধারণা, অনুমান, আন্দায বা কল্পনা হতে বাধ্য। আর সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বিবেক ও যুক্তিগ্রাহ্য ওহীকে প্রত্যাখ্যান করে এরূপ আন্দায বা ধারণাকে বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা বা পুর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে ওহী অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করা নিজের মর্জি বা ‘প্রবৃত্তির’ অনুসরণ বৈ কিছুই নয়। এ বিষয়ে কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে:
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত পথনির্দেশনা ছাড়া নিজের ইচ্ছা বা মতামতের অনুসরণ করে তার চেয়ে বিভ্রান্ত আর কেউ নয়। নিশ্চয় আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’’[14]
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الأَنْفُسُ
‘‘তারা তো শুধুমাত্র অনুমান ও নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে।’’[15]
কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।[16]
[2] সুরা (২৩) মুমিনুন: ২৪ আয়াত।
[3] সুরা (২৮) কাসাস: ৩৬ আয়াত।
[4] সুরা (৪৩) যুখরুফ: ২৩ আয়াত।
[5] দেখুন, সূরা (৩১) লুকমান: ২১; সূরা (২৩) মুমিনূন: ৬৮; সূরা (৪৩) যুখরূফ: ২২ আয়াত।
[6] সূরা (৪৩) যুখরুফ: ১৯-২২ আয়াত।
[7] সূরা (২) বাকারা: ১৩৪ ও ১৪১ আয়াত।
[8] সূরা (২) বাকারা: ১৭০ আয়াত।
[9] সূরা (৪৩) যুখরুফ: ২৪ আয়াত।
[10] সূরা (৬) আন‘আম: ১৪৮ আয়াত।
[11] সূরা (৬) আনআম : ১১৬ আয়াত।
[12] সূরা (১০) ইউনুস: ৬৬ আয়াত।
[13] সূরা (৫৩) নাজম: ২৭-২৮ আয়াত।
[14] সূরা (২৮) কাসাস: ৫০ আয়াত।
[15] সুরা (৫৩) নাজম: ২৩ আয়াত।
[16] সূরা (৩০) রূম ২৯; সূরা আ’রাফ ১৭৬; সূরা কাহাফ ২৮; সূরা তাহা ৪৭ আয়াত।