লগইন করুন
বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বুঝাতে মুসলিম সমাজে সাধারণত দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়: ‘ঈমান’ ও ‘আকীদা’। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে সর্বদা ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আকীদা’ বা অন্য কোনো শব্দ কুরআন, সুন্নাহ বা সাহাবীগণের যুগে ব্যবহৃত হয় নি। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে ‘ধর্ম-বিশ্বাস’ বুঝাতে আরো কিছু পরিভাষা এ বিষয়ে পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, ইসলামের ধর্ম-বিশ্বাস ও এ বিষয়ক মূলনীতিসমূহ অত্যন্ত সহজ, সরল, যৌক্তিক ও মানবীয় প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা জানি যে, ধর্ম-বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ‘গাইব’ বা অদৃশ্য বিষয়াদির উপর। স্রষ্টার অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলি, ফিরিশতা, সৃষ্টিজগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক, সৃষ্টিজগতের নিয়ন্ত্রণে ও বিচারে স্রষ্টার কর্ম, পরকালীন জীবন, ইত্যাদি সবই মূলত অদৃশ্য বিষয়। পঞ্চ-ইন্দ্রিয় বা মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক দিয়ে এগুলির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক এগুলির বাস্তবতা ও সাম্ভ্যবতা অনুভব ও স্বীকার করে। কিন্তু এগুলির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। মানুষ বিবেক, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করে, কিন্তু তাঁর সত্তার প্রকৃতি, পরিধি, গুণাবলির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ বিষয়ে যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে অনেক বিতর্ক করা সম্ভব, তবে কোনো সুনির্ধারিত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় না। এজন্যই মূলত বিশ্বাসের বিষয়ে ওহীর উপরে নির্ভর করতে হয়।
ইসলামের বিশ্বাস বিষয়ক নির্দেশাবলির ক্ষেত্রে সাহাবীগণের নীতি ছিল যে, কুরআন কারীমে বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখে এ বিষয়ে যা কিছু তাঁরা শুনেছেন বা জেনেছেন, সেগুলিকে বিনা বাক্যে ও নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছেন। এগুলির বিষয়ে অকারণ যুক্তিতর্কের আরোপ করেন নি।
ইসলামের প্রসারের সাথে সাথে পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য বিজিত দেশের অনেক মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আগমন করেন। এ সকল মানুষ নিজেদের পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাবে এবং তাদের সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের প্রভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে বিভিন্ন বিতর্কের সূত্রপাত করেন। এদের বিতর্কের বিষয়ে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী যুগের ইমামগণ। তাঁরা ধর্মবিশ্বাসের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্য ‘ঈমান’ ছাড়াও অন্যান্য কিছু পরিভাষা ব্যবহার করেন। এসকল পরিভাষার মধ্যে রয়েছে ‘আল-ফিকহুল আকবার’, ‘ইলমুত তাওহীদ’, ‘আস-সুন্নাহ’, ‘আশ-শরীয়াহ’, ‘আল-আকীদাহ’ ইত্যাদি।
এগুলির মধ্যে ‘আকীদাহ’ পরিভাষাটি সবচেয়ে পরে প্রচলিত হলেও সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, ৪র্থ হিজরী শতাব্দীর পূর্বে এ পরিভাষাটির তেমন কোনো প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় না। এমনকি ৪র্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত আরবী অভিধান গ্রন্থগুলিতেও ‘আকীদা’ (عَقِيدة) শব্দটি পাওয়া যায় না। পরবর্তী কালে আকীদা শব্দের ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে। নিম্নে আমরা ইসলামী বিশ্বাস বা ধর্ম-বিশ্বাস অর্থে ব্যবহৃত বিভিন্ন পরিভাষা আলোচনা করব: