ইসলামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এম এল এম) এর বিধান মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম)-এর শরয়ী বিধান ও বিবরণ ইসলামহাউজ.কম
(গ) হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা (الغرر)

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং অবৈধ হওয়ার আরো একটি কারণ হলো তাতে হাদীসে নিষিদ্ধ الغرر (হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা) রয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ بَيْعِ الْحَصَاةِ وَعَنْ بَيْعِ الْغَرَرِ»
রাসূলুল্লাহ স. নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করা এবং বাইয়ুল গারার (অনিশ্চিত ক্রয়-বিক্রয় করা) থেকে বারণ করেছেন। [সহীহ মুসলিম : ৩৮৮১]
বাইয়ুল গারারের সংজ্ঞা : ইসলামি পণ্ডিতগণ বাইয়ুল গারার -এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো :
(ক) আল্লামা কাসানী রাহ. বলেন, ‘‘গারার হচ্ছে এমন একটি অনিশ্চয়তা, যাতে হওয়া এবং না-হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।’’ [বাদায়ে‘উস সানায়ে‘উ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৬৬]
(খ) আল্লামা ইবনুল আসীর জাযারী রাহ. বলেন, ‘‘যার এমন একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়; কিন্তু এমন অদৃশ্য কারণ রয়েছে যে কারণে তা অস্পষ্ট। এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে। আর এর ভিতরের রূপ অজানা’’ [জামেউল উসূল, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২৭]
(গ) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, ‘‘বাইয়ুল গারার ঐ কারবারকে বলা হয় যাতে পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে কিনা তা অনিশ্চিত অথবা চুক্তিভুক্ত ব্যক্তি নিজে তা যোগান দিতে অক্ষম অথবা যারা পরিণাম অজানা’’ [যাদুল মা‘আদ, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৭২৫]।
(ঘ) কারো কারো মতে, বাইয়ুল গারার হলো, ‘‘যে কোনো কারবারের চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা।’’ যেমন, পুকুরে বা নদীতে মাছ কেনা-বেচা, আকাশে উড়ন্ত পাখি বেচা-কেনা ইত্যাদি।
মোটকথা, যাতে হাসিল হওয়া বা না-হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে আল-গারার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ ও নাজায়িয। আল্লামা ইবন কুদামাহ তার ‘আশ-শারহুল কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবরাহীম হারবীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোনো লোক যদি এ শর্তে মোরগ ভাড়া নিতে চায় যে, এ মোরগ তাকে সালাতের সময় ঘুম থেকে জাগাবে তবে এ ধরনের কারবার জায়িয হবে কি না? তিনি উত্তর দিলেন, না। কারণ এটি অনিশ্চিত কারবার। হতে পারে কখনো কখনো মোরগ ডাকবে না, আবার কখনো সালাতের সময়ের আগে ডাকবে বা পরে ডাকবে, আবার কখনো হয়তো তার মুখ থেকে ডাক বের করার জন্য প্রহারের প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। সুতরাং নানাবিদ অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকায় এ ধরনের চুক্তি জায়িয নেই। [খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩১৯]

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির পদ্ধতির দিকে তাকালে অনুমেয় হয় যে, সেখানে বহু পদ্ধতিতে গারারের উপস্থিতি রয়েছে। একজন ডিস্ট্রিবিউটর যে চুক্তিতে কোম্পানির সাথে যুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, লোকটি তার ডাউনলাইন থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার নিজের বানানো দু’জন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনিশ্চিত এবং অন্যের কাজের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তার নিম্নের নেটগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অগ্রসর না করলে লোকটি কমিশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে; যে কমিশনকে কেন্দ্র করেই সে মূলত এ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে।
কোনো কোনো মাল্টি লেভেল কোম্পানিতে ‘ট্রি প্লান্টেশন’ নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। বছরখানেক আগে এ প্রতারণা নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ৮০০০ (আট হাজার) টাকা নিয়ে ১২ বছর পর ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) টাকা অথবা সমপরিমাণ অর্থের গাছ প্রদানের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করা হয়। গাছ লাগানোর জন্য আদৌ কোনো জায়গা ক্রয়া করা হয়েছে কি না বা কতজন গাছ লাগানোর জন্য টাকা দিয়েছে— এসব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। এ সকল অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে ইসলামি শরী‘আত এ লেনদেনকে বৈধ সাব্যস্ত করে না।