লগইন করুন
ইমাম মুহাম্মাদ বিন ওয়াদাহ আল কুরতুবী রহ. নিজ সনদে আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদের শায়খ ও ফকীহগণের কাউকে শাবানের ১৫তম রাতের প্রতি গুরুত্বের সাথে দৃষ্টিপাত করতে এবং এ প্রসংগে মাকহুল বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করতে দেখিনি। তারা অন্যান্য রাতের উপর এ রাতকে প্রাধান্য দিতেন না।
ইমাম আবু বকর আত তুরতুশী রহ. বলেন, আমাকে আবু মুহাম্মাদ আল-মাকদেসী রহ. অবহিত করেছেন যে, আমাদের সময় বাইতুল মুকাদ্দাসে কখনও সালাতুর রাগায়েব পড়া হয়নি, যা বর্তমানে রজব ও শাবান মাসে পড়া হয়।
প্রথম এ বিদআত চালু হয় ৪৪৮ হিজরীতে। সে সময় নাবলুস এর অধিবাসী এক ব্যক্তি বাইতুল মুকাদ্দাসে আগমন করল। সে ইবনে আবি হামরা নামে পরিচিত ছিল। তার কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই সুন্দর, সে শাবানের ১৫তম রাতে বাইতুল মুকাদ্দাসে সালাত শুরু করল। তার পিছনে অপর একজন এসে যোগ দিল, অতঃপর আরো তিন চার জন যোগ দিল। এভাবে সালাত শেষে দেখা গেল বিরাট এক জামাত হয়ে গেছে। পরবর্তী বছর আরো অনেকে এসে সালাত আদায় করল। এর পরবর্তী বছর আরো বহু সংখ্যক লোক সালাতে একত্রিত হল। এভাবে সমস্ত মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে শবে বরাতের সালাত বা শাবানের ১৫তম রাতের সালাতের ফযিলত প্রচলিত হয়। পরবর্তীতে মানুষের ঘরে ঘরে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় তা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায়।[1]
ইমাম ইবনে ওয়াদাহ রহ. স্বীয় সনদের মাধ্যমে বর্ণনা করেন, ইবনে আবি মুলাইকা রহ. কে বলা হল, যিয়াদ আন নুমায়রি মনে করেন, শাবানের ১৫তম রাতের ফযিলত লাইলাতুল কদরের ফযিলতের মতো। তখন ইবনে আবি মুলাইকা রহ. বলেন, যদি তার থেকে আমি শুনতাম আর আমার হাতে লাঠি থাকত তাহলে আমি তা দ্বারা তাকে প্রহার করতাম। তখন যিয়াদ কাজী ছিলেন।[2]
ইমাম আবু শামা শাফেয়ী রহ. বলেন, শাবানের ১৫তম রাতের সালাতকে আলফিয়াহ বলা হয়। কারণ এ রাতে ১০০ রাকাত নফল সালাতে ১০০০ (এক হাজার) বার সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করা হয়। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহা ১ বার ও সূরা ইখলাস ১০ বার তিলাওয়াত করা হয়। এটা খুব লম্বা ও কষ্টকর সালাত; যার সমর্থনে কোন হাদীস কিংবা আছার (বর্ণনা) পাওয়া যায় না। তাই এটা সাধারণ মানুষের জন্য বড় ফেৎনার কারণ।
এ রাতে বিভিন্ন মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়, গুরুত্বের সাথে যেখানে সারা রাত জাগ্রত থেকে সালাত আদায় করা হয়। পাশাপাশি অনেক গুনাহের কাজও সংঘটিত হয়। যথা, নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এ রাতের প্রশংসায় গান বাজনা পরিবেশন ইত্যাদি। অনেক সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এগুলো ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর শয়তান তাদের এ সকল কর্মকান্ডকে আরো চাকচিক্যময় করে দিয়েছে এবং এটাকে মুসলমানদের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে।[3]
হাফেয ইবনে রজব রহ. একটি মূল্যবান কথার পর বলেন, শাবানের ১৫তম রাতকে শাম দেশের তাবেয়ীগণ যথা খালেদ ইবনে মি‘দান রহ., মাকহুল রহ., লোকমান বিন আমের রহ. এবং অন্যান্যরা খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন এবং এ রাতে ইবাদত করতেন। তাদের দেখেই লোকেরা এ রাতের সম্মান করতে থাকে।
অবশ্য বলা হয় যে, এ মতটি তাদের নিকট ইসরাইলী রেওয়ায়াত থেকে পৌঁছেছে। অতঃপর যখন এ মতাদর্শ বিভিন্ন দেশে প্রসিদ্ধি লাভ করে তখন এ রাতের মর্যাদার ব্যাপারে মতানৈক্য শুরু হয়।
কেউ কেউ তাদের সাথে একমত হয়ে এ রাতে ইবাদত করতে থাকেন। এরা হচ্ছেন, বসরা ও অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসী।
হেজাজের অনেক ওলামা এটাকে অস্বীকার ও অপছন্দ করেছেন। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন আতা বিন আবি রাবাহ রহ. ও ইবনে আবি মুলাইকা রহ. প্রমুখ। আবদুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম রহ. মদীনার ফকীহগণ থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম মালেকের রহ. সাথীগণসহ অন্যান্য ওলামাগণেরও একই অভিমত। আর তা হচ্ছে এ সবই বিদআত।
এ রাতে (শাবানের ১৫তম রাতে) জাগ্রত থেকে ইবাদত করার ফযিলত নিয়ে সিরিয়ার আলেমগণের দু‘টি উক্তি রয়েছে।
এক : এ রাতে জাগ্রত থেকে দলবদ্ধভাবে মসজিদে ইবাদত করা মুস্তাহাব। খালেদ ইবনে মি‘দান রহ., লুকমান বিন আমের রহ. সহ অন্যান্য ওলামাগণ এ রাতে উত্তম কাপড় পরিধান করতেন, আগর বাতি জ্বালিয়ে মসজিদ সুগন্ধময় করতেন, চোখে সুরমা লাগাতেন এবং সারা রাত সালাত ও অন্যান্য ইবাদতে দন্ডায়মান থাকতেন।
ইসহাক বিন রাহ্ওয়াই রহ. তাদের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি আরো বলেন, এ রাতে মসজিদে ইবাদতের জন্য দন্ডায়মান হওয়া বিদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। হরবুল কারমানী এ মাসআলায় তাকে অনুসরণ করেছেন।
দুই : এ রাতে মসজিদে সমবেত হয়ে (শবে বরাতের) সালাত আদায়, বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা ও দুআ করা মাকরুহ। অবশ্য একা একা সালাত আদায় করাতে কোন দোষ নেই। এটা ইমাম আওযাঈ রহ., সিরিয়ার তৎকালীন প্রসিদ্ধ ইমাম, ফকীহ এবং ওলামায়ে কেরামের অভিমত। আল্লাহ্ চাহেতো এটাই তুলনামূলক বিশুদ্ধ।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. থেকে শাবানের ১৫তারিখ রাত সম্পর্কে কোন উক্তি নেই। তবে রাত জেগে ইবাদত করা সম্পর্কে তার দু‘টি বর্ণনা রয়েছে। একটি হচ্ছে ঈদের রাতে ইবাদত করা। তবে কোন রেওয়ায়াতে এ রাতে সম্মিলিতভাবে ইবাদতকে মুস্তাহাব বলা হয়নি। কেননা এ সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন উক্তি পাওয়া যায়নি। অন্য এক বর্ণনাতে ঈদের রাতের ইবাদতকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে, এটা আবদুর রহমান বিন ইয়াজিদ বিন আসওয়াদ এর আমল অনুযায়ী। আর তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী। এমনই হল শাবান মাসের ১৫তারিখ রাতের অবস্থা। এ ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কিছুই বর্ণিত হয়নি। তবে শাবানের ১৫তারিখ রাতের ইবাদত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কতিপয় তাবেয়ী এবং সিরিয়ার ফকীহগণের মাধ্যমে।[4]
আল্লামা আবদুল আযীয বিন বায রহ. বলেন, আল্লামা আওযায়ী রহ. ও ইবনে রজব রহ. কর্তৃক এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদতকে মুস্তাহাব বলাটাও অত্যন্ত দুর্বল উক্তি। কেননা এ প্রসংঙ্গে শরীয়তের কোন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর প্রমাণ ব্যতীত কোন আমল শরীয়তসিদ্ধ নয়। কেননা তা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিদআত। চাই তা ব্যক্তিগত ইবাদত হোক কিংবা সম্মিলিত ইবাদত হোক। প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য হোক।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ.(مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি এমন কিছু আমল করে যে ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।[5]
এমনি আরো অনেক হাদীসে বিদআত সম্পর্কে সর্তক করা হয়েছে। উল্লিখিত ইমাম ইবনে ওয়াদাহ রহ., ইমাম তারতুশি রহ., ইমাম আবু শামা রহ., আবদুর রহমান বিন ইসমাঈল রহ., হাফেজ ইবনে রজব রহ. এবং ঈমাম আব্দুল আযীয বিন বায রহ. প্রমূখের মতামত দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, শবে বরাতের ইবাদত, সালাত কিংবা অন্য কোন আমল যা শরীয়তসিদ্ধ নয় তা বিদআত। কুরআন ও হাদীসে এর কোন ভিত্তি নেই এবং কোন সাহাবায়ে কেরাম এ আমল করেননি।
[2] কিতাবুল হাওয়াদেস ওয়াল বিদআ-তুরতুশী : ২৬৩ পৃ
[3] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস- ইমাম আবু শামা : ১২৪ পৃ:
[4] লাতায়েফুল মাআরেফ-ইবনে রজব: ২৬৩ পৃ
[5] মুসলিম :১৭১৮