লগইন করুন
মোটকথা কুরআনের কতক আয়াত আরবদের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটিকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে, কিন্তু আয়াতগুলোর হুকুম ব্যাপক। শব্দগত ও অর্থগত উভয় দিক থেকেই যে কোনো শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকবে, তাদের উপর আয়াতগুলো প্রয়োগ করা হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত জিন-ইনসান সকলের জন্যই। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই তার দাওয়াত। সুতরাং কেউ যেন এটি মনে না করে যে, ইসলামের কোনো হুকুম শুধু আরবদের জন্যই খাস। বরং কুরআনে মুসলিম, কাফের, মুমিন, মুনাফেক, নেককার, বদকার, সৎকর্মশীল, যালেম এবং কুরআন-হাদীছে উল্লেখিত অন্যান্য বিভিন্ন নামের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা হুকুম উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছে শরী‘আতের কোনো হুকুমই আরবদের জন্য খাস করে নাযিল হয়নি। তাতে কেবল আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রিয় আমল ও তার নিকট অপ্রিয় আমলের উপর আলাদা আলাদাভাবে হুকুম প্রয়োগ করা হয়েছে। তিনি যা ভালোবাসেন সাধ্যানুসারে তা করার হুকুম করেছেন। তিনি যা ঘৃণা করেন, তা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সেটা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। আরবদের জন্য খাস করে শরী‘আতের কোনো হুকুমই প্রদান করা হয়নি। কেননা তার দাওয়াত ছিল সমস্ত সৃষ্টির জন্য। তবে আরবদের ভাষায় এবং কুরাইশদের ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। যাতে করে তিনি আরবদের জন্য এর তাবলীগ করতে পারেন। তাই তিনি প্রথমে আরবদের মাঝে তাবলীগ করেছেন। অতঃপর আরবদের মাধ্যমে সমস্ত জাতির কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে সর্বপ্রথম তাবলীগ করার আদেশ দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে পার্শ্ববর্তী লোকদের নিকট তাবলীগ করার আদেশ করেছেন। ইসলামের জন্য জিহাদ করার ক্ষেত্রেও তিনি প্রথমে পার্শ্ববর্তী কাফেরদেরকে অতঃপর অন্যান্য কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আদেশ করেছেন।
তিনি যেমন প্রেরিত হয়েছিলেন মানব জাতির প্রতি তেমনি প্রেরিত হয়েছেন জিন জাতির প্রতি। জিনেরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন তেলাওয়াত শুনেছিল। অতঃপর তারা সতর্ককারী হয়ে নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়েছিল। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে সংবাদ দিয়েছেন। মুসলিমদের ঐক্যমতে এটি সুসাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে জিন-ইনসানকে উল্লেখ করে যে সম্বোধন করেছেন, তা এই মূলনীতিকে সুস্পষ্ট করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا﴾
‘‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনাতো এবং এ দিনটির সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সর্তক করতো?’’ (সূরা আনআম: ১৩০)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا﴾ ‘‘আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে নেককার আর কিছু লোক আছে তার চেয়ে নীচু পর্যায়ের। এভাবে আমরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত ছিলাম’’। (সূরা জিন: ১১) অর্থাৎ বিভিন্ন মাযহাবে বিভক্ত ছিলাম। মুসলিম, কাফের, আহলে সুন্নাত, আহলে বিদআত ইত্যাদি বিভিন্ন তরীকায় বিভক্ত ছিলাম। তারা আরো বলেছিল,
﴿وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَٰئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا﴾
‘‘আর আমাদের মধ্যে আছে মুসলিম আর যালেম। তবে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা নিঃসন্দেহে সত্য পথ বেছে নিয়েছে’’। (সূরা জিন: ১৪) القاسط অর্থ হলো সত্য পথ থেকে বিচ্যুত। যখন কেউ যুলুম করে, তখন বলা হয়, قسط। আর যখন ন্যায়নীতি অবলম্বন করে, তখন বলা হয় أقسط।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মানুষের উপর জানা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত জিন-ইনসানের জন্য রসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন এবং তাদের উপর তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার আনুগত্য করা আবশ্যক করেছেন। সুতরাং তার উম্মতের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন ও তার রসূল যা হালাল করেছেন তা হালাল মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল যা ভালোবাসেন, তার প্রতি ভালোবাসা রাখা এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল যা অপছন্দ করেন, তার প্রতি ঘৃণাবোধ রাখা আবশ্যক। জিন-ইনসানের মধ্য থেকে যাদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের প্রমাণাদি আসার পর তারা যদি তার প্রতি ঈমান না আনয়ন করে, তাহলে তারা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির হকদার হবে। অনুরূপ যেসব কাফেরের নিকট রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনয়ন করেনি, তারাও আযাবের হকদার হবে। এটি সাহাবী, তাবেঈ, উত্তমভাবে তাদের অনুসারী, মুসলিমদের ইমাম এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সমস্ত ফির্কার ঐক্যমত দ্বারা সুসাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট হোন।
(৪) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তার উপর এমন কুরআন নাযিল হয়েছে, যার মুজিযার সামনে জিন-ইনসান নতি স্বীকার করেছে, যার মোকাবেলা করতে জিন-ইনসানের সমস্ত পক্ষই বিরত হয়েছে এবং সমস্ত ধর্মের ভাষাবিদগণ সেটার সর্বাধিক ছোট সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে আনয়ন করতে অপারগতা স্বীকার করেছে। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত বিবরণ অতিক্রান্ত হয়েছে।
(৫) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত মিরাজের ঘটনা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট। এখানেই শেষ নয়; সেখান থেকে আরো উপরে উঠে এমন স্থানে পৌঁছে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কলমের লেখার (খসখস) শব্দ শুনতে পেলেন। অতঃপর তাদের মাঝে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের কিংবা তার চেয়ে কিছু কম ব্যবধান রাইলো।
আর উম্মতের অন্যান্য লোকের উপর তার ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে শরী‘আতের ফরয, হারাম হালাল সম্পর্কিত এমন কিছু বিশেষ হুকুম প্রদান করেছেন, যাতে উম্মতের কেউ শরীক নয়। এগুলো আল্লাহ তা‘আলা তাকে দান করেছেন এবং এগুলো তার খাস মর্যাদা। তার উপর এমন কিছু জিনিস ফরয করা হয়েছে, যা অন্যদের উপর ফরয করা হয়নি এবং তার উপর এমন কিছু জিনিস হারাম করা হয়েছে, যা অন্যদের উপর হারাম করা হয়নি। তার জন্য এমন কিছু জিনিস হালাল করা হয়েছে, যা অন্যদের জন্য হালাল করা হয়নি। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু বিষয় আলেমদের ঐক্যমতে তার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে আবার কিছু কিছু বিষয়ে আলেমদের মতবিরোধ রয়েছে। অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খাস বৈশিষ্টগুলো উল্লেখ করেছেন।
তার মধ্য থেকে (১) রাতের বেলায় তার জন্য তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা ফরয ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মৃত্যু পর্যন্ত তাহাজ্জুদ সালাত পড়া ফরয ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا﴾ ‘‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী রাতের বেলা নামাযে রত থাকো। তবে কিছু সময় ছাড়া’’। (সূরা মুযাম্মেল: ১-২) কুরআনের বক্তব্য দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, তাহাজ্জুদ সালাত তার উপর ওয়াজিব ছিল। অতঃপর তা রহিত হয়ে গেছে।
(২) তিনি যখন কোনো আমল করতেন, তা সর্বদা চালু রাখতেন।
(৩) তার উপর এবং তার পরিবারের জন্য মানুষের যাকাত গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।
(৩) তার জন্য সেহরী না খেয়ে কিংবা একটানা দু’দিন পর্যন্ত রাতের বেলা কিছু না খেয়ে সিয়াম পালন/রোযা রাখা বৈধ ছিল।
(৪) তার জন্য চারের অধিক বিবাহ করা বৈধ করা হয়েছে।
(৫) মক্কাতে তার জন্য যুদ্ধ করার অনুমতি ছিল।
(৬) তার সম্পদের কোনো ওয়ারিছ হবে না।
(৭) তার স্ত্রীগণ তার মৃত্যুর পরও স্ত্রী হিসাবেই থাকবেন। তিনি যখন তার কোনো স্ত্রীকে তালাক দিতেন, তখন সে স্ত্রীকে বিবাহ করা অন্য কারো জন্য বৈধ ছিল না। এ ছাড়াও তার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এখানে আমরা আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্য থেকে তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশা-আল্লাহ।
(১) ইসরা ও মিরাজ,
(২) সর্বকালের সমগ্র জিন-ইনসানের জন্য তার রিসালাত এবং
(৩) তার মাধ্যমে নবুওয়াত খতম-শেষ করা হয়েছে।