লগইন করুন
উত্তর : কুরআনুল কারীম এবং সুন্নাতুন নাবী ছল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভিত্তিতে ইমাম যদি তার পদে অধিষ্ঠিত হয় তাহলে তার নিকট বাই‘য়াত গ্রহণ করা ওয়াজিব।[1]
আলিম এবং শাসকবর্গের মধ্য থেকে আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ যারা তারা বাই‘আত প্রদান করবেন। বাকী প্রজাগণ তাদের অনুগামী হবেন। আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের বাই‘আত প্রদানের দ্বারা সকল প্রজার জন্য উক্ত ইমামের আনুগত্য করা ওয়াজিব। সুতরাং সকল প্রজার নিকট থেকে বাই‘য়াত তলব করা হবে না। কেননা মুসলিম জাতি এক অভিন্ন জামাতের অনুসারী এবং আলিম নেতাগণ তাদের সকলের প্রতিনিধি।[2]
এই হলো এই উম্মাতের সালাফে সালেহীনের অবস্থা। খলীফাতুল মুসলিমীন আবু বকর (রা.) এর এবং অন্যান্য মুসলিম শাসকগণের বাই‘আত এমনই ছিল। ইসলামের বাই‘আতের পদ্ধতি কাফির রাষ্টসমূহে এবং তাদের অনুচর আরব রাষ্ট্রসমূহে সংঘটিত কথিত নির্বাচনের পদ্ধতি নয়। তাদের নির্বাচনের ভিত্তিই হলো পরস্পরে দরকষাকষি, মিথ্যারোপ-গালিগালাজ এবং আত্মবিশুদ্ধতার প্রচারের উপর স্থাপিত। আর ইসলামী বাই‘আত সংঘটিত হয় ঐক্য এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে। আর ইসলামী বাই‘আতের দ্বারা দরকষাকষি, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জনদুর্ভোগ এবং রক্তপাত ছাড়াই শান্তি-নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়।
[1]. ইমাম শাওকানী (রহ.) বলেন, ইমামগণকে তাদের পদে অধিষ্ঠিত করা এবং তাদের নিকট বাই‘আত গ্রহণ করা বিষয়ে সবচেয়ে বড় দলীল হলো ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু খুযাইমাহ এবং ইবনু হিববান (রহ.) প্রমুখ বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ ছাহাবী হারিছ আল-আশ আরী (রা.) এর নিকট থেকে যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছটি হলো ‘‘যদি কোন ব্যক্তি জামাতের ইমাম না থাকা অবস্থায় মারা যায় তাহলে তার মৃত্যু জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু বলে গণ্য হবে। ছাহাবীগণ মারা গেলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নেতৃত্ব এবং নেতার আনুগত্য করার বিষয়টিকে সকল বিষয়ের উপর প্রধান্য দিতেন। এমনকি ছাহাবীগণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরোধানের পর তার দাফন-কাফনের পূর্বে খলীফা নির্বাচন করাকে প্রাধান্য দেন। (ইমাম শাওকানী, আস সাইলুন জাররার খ. ০৪ পৃ. ৫০৪)
[2]. ইমাম শাওকানী (রহ.) বলেন, বাই‘আতে পদ্ধতি হলো আহলুল ওয়াল আকদ একত্রিত হয়ে বাই‘আত নির্বাচনের ভিত্তিতেই ইমাম নির্বাচন চূড়ান্ত হবে। সকল প্রজার জন্য উক্ত ইমামের অনুগত্য করা ওয়াজিব বলে গণ্য হবে। কারো জন্য হক বিষয়ে তার, বিরোধিতা করা জায়েয হবে না।
ইমামাত বা নেতৃত্ব সাব্যস্ত হওয়ার জন্য বাই‘আত প্রদানে সক্ষমতা সম্পন্ন সকল ব্যক্তির জন্য বাই‘আতে অংশগ্রহণ করা শর্ত নয়। এমনিভাবে নেতৃত্ব সাব্যস্ত হওয়ার জন্য সকলকে বাই‘আতকারীর আনুগত্য করাও শর্তের অন্তর্ভুক্ত নয়। মুসলিমদের ইজমা‘র ভিত্তিতে এ দু’টি শর্তের কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই। (আস-সাইলুল জাররার খ. ০৪ পৃ. ৫১১-১৩)
কারো কারো মুখ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বলতে শোনা যায় যে, খুলাফায়ে রাশিদার যুগে যে রকম ভাবে সকল মুসলিমের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাই‘আত অনুষ্ঠিত হতো সে রকম বাই‘আত ব্যতিরেকে মুসলিমদের জাতীয় নেতা নির্বাচিত হতে পারে না।
ইনশা আল্লাহ আমরা আল্লাহর তাওফীক্বে তাদের এই সন্দেহ খণ্ডন করে বলতে পারি: ছাহাবায়ে কিরামের ও তারিয়ীগনের যুগের মত একক ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যদি কেউ আনুগত্য বর্জন করে নতুন দল গঠন করার অপচেষ্টা চালায় তাহলে তাকে উক্ত কাজ থেকে তাওবাহ করতে বলা হবে যদি তাওবাহ না করে তাহলে তাকে হত্যা করা হবে।
যখন ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল, ইসলামী ভূমি সম্প্রসারিত হলো, ইসলামী রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব বৃদ্ধি পেল। তখন দেখা গেল যে বিভিন্ন প্রান্তে স্বতন্ত্র নেতৃত্ব গড়ে উঠল যাদের একজনের পক্ষে অপর প্রান্তে একই সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং এরকম ক্ষেত্রে ইমাম বা নেতার সংখ্যাধিক্য হওয়াতে কোন সমস্যা নই। প্রত্যেক অঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের এলাকার শাসকের আনুগত্য করবে। এবং স্ব স্ব ইমামের আনুগত্য বর্জন করলে শারঈ সেই দ-বিধি কায়িম হবে। পক্ষান্তরে এক ইমামের অঞ্চলের অধিবাসী যদি অন্য ইমামের আনুগত্য না করে তাহলে তার উপর শাস্তি আরোপিত হবে না।
আপনি এ মাসআলা ভালো ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করুন। কেননা শার’ঙ্গ’ মূলনীতি এবং দলীল প্রমাণাদির দাবি এমনটিই। এর বিপরীতে যা কিছু বলা হয় তা পরিহার করুন। কেননা ইসলামের প্রাথমিক যুগের নেতৃত্ব এবং বর্তমান কালের নেতৃত্বের মাঝের পার্থক্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। যে ব্যক্তি এই পার্থক্যকে অস্বীকার করে সে হতভম্ভ। তার যেহেতু সে দলীল প্রমাণাদি বোঝে না সুতরাং সে তার সাথে দলীল প্রমাণাদির দ্বারা কথা বলার হুকদার নয়। (আস-সাইলুল জাররার ৪/৫১২)।
আরেকটা সন্দেহ দেখা যায় যে ‘‘জনগনের ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি ছাড়া কোন নেতৃত্ব হতে পারে না।’’ শুধু দুই শ্রেণির লোক ছাড়া অন্যকেউ এরকম কথা বলতে পারে না।
ক) সুন্নাহ সম্পর্কে জহিল বা মুর্খ:
ব্যক্তির নিকট বিশুদ্ধ বিষয় বর্ণনা করতে হবে এবং আল্লাহর নিকট দু’আ করতে হবে যেন তিনি তার অন্তরকে প্রসারিত করে দেন।
খ) প্রবৃত্তিবাদী: হক সম্পর্কে জানার পরেও অবাধ্যচরণ করে:
এই ব্যক্তিকে সম্বোধন করে কিছু বলার কোন পদ্ধতি নাই।
আল্লাহর সাহায্যে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ লোকজনের জ্ঞাতার্থে এই সন্দেহ-সংশয় খণ্ডনে বলতে পারি যে, খিলাফত কিছু বিষয় নিয়ে গঠিত হয়। যথা;
ক) সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিকে নির্বাচন করার মাধ্যমে যেমনটি প্রথম খালীফা আবু বাকার (রা.) এর ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
খ) প্রথম নেতা পরবর্তী নেতা হিসেবে কাউকে নির্ধারণ করার জন্য অঙ্গীকার গ্রহণ করা। যেমনটি উমর (রা.) এর ক্ষেত্রে ঘটেছিল আবু বাকার (রা) উমর (রা) এর ব্যাপারে, অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন।
গ) নেতার পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির ব্যাপারে অঙ্গীকার গ্রহণ করা। যেন তাদের মধ্য থেকে কোন একজনকে ইমাম নির্বাচন করেন। যেমনটি উমর (রা.) আসহাবুশ শুরার ক্ষেত্রে করেছিলেন। অতঃপর উছমান (রা.) শহীদ হলে তারা আলী (রা.) এর হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেন।
ঘ) সংখ্যাধিক্য ও শক্তি সামর্থ্যের দ্বারা যেমনটি বানী উমাইয়্যাহ ও অন্যান্য যুগে ঘটেছিল। বাগদাদে আববাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকাবস্থায় স্পেনে উমাইয়্যাহ খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম উম্মাহর মাঝে হুমাইদ আত-ত্ববিল, শু’বা, ছাওরী, হাম্মদ ইবনে সালামাহ, ইসমাইল ইবনে ঈয়াশ, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক, ইবনু ‘উয়াইনাহ, ইয়াহইয়া আল কত্তান, এবং লাইছ ইবনে সা’দ প্রমুখ আলিম বিদ্যমান ছিলেন। অথচ উল্লেখিত বিদ্বানগণের কেউই স্পেনের খিলাফত অথবা সেখানের খলীফার হাতে বাই‘আত গ্রহণ করাকে বাতিল বলেননি।
আমরা ভুলে যাব না ‘‘সকল জনগণের সন্তুষ্টি ছাড়া ইমাম নিযুক্ত করা বৈধ নয়’’ এই শর্তের দ্বারা আলী (রা.) এবং তার মৃত্যুর পরে নিযুক্ত খলীফা হাসান ইবনে আলী (রা.) এর খিলাফতকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। কেননা তাদের বাই‘আতে পুরো উম্মাহ একত্রিত হয়নি। সুতরাং আপনি এ বিষয়টি ভেবে চিমেত্ম দেখুন (এ শর্তটি কতইনা মারাত্মক খারাপ)
আহুলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) বলেন, আমাদের নিকট সুন্নাহর মূলনীতি হলো: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছাহাবীগণ যে মানহাজের উপর অটল ছিল তা আঁকড়ে ধরা, তাদের অনুসরণ অনুকরণ করা, ইমামগণ সৎ বা পাপাচারী যাই হোক না কেন তাদের নির্দেশ শ্রবণ করা ও মান্য করা। যদি কেউ খলীফা পদে অধিষ্ঠিত হয় জনগণ একত্রিত হয়ে তাকে মেনে নেবে এবং তাকে খলীফা হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকবে কেউ যদি সশন্ত্র আক্রমণে পরাজিত করে খিলাফতের পদে অধিষ্ঠিত হয় তাহলে সে তার পদে অটল থাকবে। কোন ব্যক্তির জন্য তাদের নিন্দা করা অথবা তাদের সাথে ঝগড়া দ্বন্দ্ব করার অবকাশ নাই। যদি কোন খলীফার বৈধতার ব্যাপারে জন স্বীকৃতি ও সন্তুষ্টি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে উক্ত খলীফার বিরুদ্ধাচরণ করে কেউ যদি আনুগত্য থেকে বের যায় এবং যুদ্ধ বিগ্রহই করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি যেন সকল মুসলিমের ঐক্যে ফাটল ধরালো এবং রসলুূল্লাহ সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের বিরোধিতা করলো। সে যদি ঐ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহিলিয়্যাতের উপর মৃত্যু হয়েছে বলে গণ্য হবে। (লালকাঈ, উসূলু ই’ তিক্বাদিস সুন্নাহ) খ. ০১ পৃ.
শায়খুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব (রহ.) বলেন, সকল মাযহাবের ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন শহর বা দেশের উপর বিজয়ী হয় তাহলে যেখানে সর্ব বিষয়ে তার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। যদি এমনটি না হতো তাহলে পৃথিবী অটল থাকতো না। কেননা লোকজন ইমাম আহমাদ (রহ.) এর অনেক আগের কাল থেকে আজ অবধি কোন ইমামের ব্যাপারে ঐক্যমতে উপনীত হয়নি। তারা আলিমগণের কারো নিকট থেকেই একথা শোনেননি যে, এই বিধান কেবল ইমামে আ‘যম তথা মহান শাসকের জন্য খাস। (আদ-দুরারুস সানিইয়াহ ৭/২৩৯)।
ইমাম আব্দুল আযীয ইবনে বায (রহ.) তা আলা বলেন, আমরা সকলকেই ইমামের নির্দেশ শ্রবণ করা, আনুগত্য করার প্রতি নাছিহাহ প্রদান করি। একই ভাবে শাসকদের কোন পাপাচারের কারণে বাই‘আত পরিত্যাগ করা বৈধ হবে না। কেননা এটা খরিজীদের কাজ এবং এটা ভুল পদ্ধতি বাস্তবতায় এটা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যে ফাটল ধরানো। আনুগত্য পরিত্যাগ করা জায়েয নয়। যে ব্যক্তি এ কাজের প্রতি আহবান করবে তার ক্ষেত্রে শারী‘আতের বিধান হলো তাকে হত্যা করতে হবে। শাসকগণ যদি কারো ব্যাপারে এহেন কাজে লিপ্ত থাকার বিষয় নিশ্চিত ভাবে জানতে পারেন তাহলে মুসলিম সমাজে ফিতনা ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তাদেরকে কাঠোর হসেত্ম দমন করা ওয়াজিব। (আল-ফাতওয়া আল-মুহিম্মাহ ফি তাবছীরিল উম্মাহ)।