নবী-রাসূলগণের ঘটনায় রয়েছে শিক্ষা ৩. ইবরাহীম ও ইসমাঈলের ‘আলাইহিস সালাম ঘটনা থেকে শিক্ষা ড. মোঃ আবদুল কাদের
ইবরাহীম ও ইসমাঈলের ‘আলাইহিস সালাম ঘটনা থেকে শিক্ষা

ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে আমরা আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং বিপদে একত্ববাদের প্রতি দৃঢ়তা, ব্যক্তিজীবনে মুশরিক মা-বাবার সাথে আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যেমন,

মানুষ যখন জ্ঞান ও বিশ্বাসের আলোকে কোনো আকীদা কায়িম করে নেয় এবং তা তার অন্তরে বসে তার আত্মার সাথে মিশে এবং তার সীনার মধ্যে প্রস্তরাঙ্কনের ন্যায় দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হয়ে যায়, তখন তার চিন্তা ও কল্পনা, তার ভাবনা ও বিচার এবং তার ইহাতে ডুবে থাকা এমন স্তরের শক্তিশালী ও দৃঢ় হয়ে যায় যে, বিশ্বের কোনো আকস্মিক ঘটনা কোনো কঠিন বিপদও তাকে তার স্থান হতে নড়াতে পারে না। সে তার জন্য নিশ্চিন্ত মনে আগুনে লাফিয়ে পড়ে, বিনাদ্বিধায় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্ভয়ে শুলিকাষ্ঠে চড়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের দৃঢ় সংকল্প ও দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত তার জন্য একটি জীবন্ত ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।[1]

সত্যকে রক্ষা করার জন্য এমন প্রমাণ পেশ করা উচিৎ যা শত্রু এবং মিথ্যা পূজারীর অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছে যায় এবং সে মুখে যদিও সত্যকে স্বীকার করে না কিন্তু তার অন্তর সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, বরং কোনো কোনো সময় মুখও ইচ্ছার বিরুদ্ধে সত্য ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকতে পারে না।[2] যেমন, কুরআন মাজীদের এ আয়াতটি[3]

﴿وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ﴾ [النحل: ١٢٥]

“বিতর্ক কর উত্তমরূপে’’ [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫] এ তথ্যেরই ঘোষণা করছে।
পয়গাম্বর ও রাসূলগণের পন্থা হলো, তারা ঝগড়া ও তর্ক বির্তকের পথে চলে না। তাদের দলীল ও প্রমাণসমূহের ভিত্তি অনুভবনীয় বস্তু এবং চাক্ষুষ দর্শনের উপর হয়ে থাকে। কিন্তু তা সহজবোধ্য ও যুক্তির উপর। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের কাওমের সাধারণের সাথে মূর্তিপূজা ও নক্ষত্র পূজা সম্বন্ধীয় বির্তক এবং নমরূদের সাথে বির্তক এর স্পষ্ট ও উজ্জ্বল প্রমাণ।[4]

কোনো সত্য বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য দলীলের মধ্যে বিরোধী পক্ষের বাতিল আকিদাকে কাল্পনিকভাবে মেনে নেওয়া, মিথ্যা বা সে বাতিল আকিদা স্বীকার করা নয়; বরং শত্রু পক্ষকে পরাভূত করার জন্য সাময়িকভাবে বাতিলকে মেনে নেওয়া কিংবা মাআরীয বা পরোক্ষ ইঙ্গিত বলা হয়। এ পদ্ধতির প্রমাণ আনয়ন বিপক্ষকে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করে দেয়। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম জনসাধারণের সাথে বিতর্কের মধ্যে প্রমাণের এ দিকটাই অবলম্বন করেছিলেন যা মূর্তিপুজকদেরকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল যে, মূর্তি কোনো অবস্থাতেই শোনেও না জবাবও দিতে পারে না।[5]

যদি কোনো মুসলিমের পিতা-মাতা উভয়ই মুশরিক হয় এবং কোনোক্রমেই শির্ক থেকে বিরত না হয় তবে তাদের মুশরিকী জীবন থেকে অসন্তুস্ট এবং পৃথক থেকেও তাদের সাথে দুনিয়াবী কাজ কারবারে ও আচরণেও এবং আখিরাতের উপদেশ ও নসীহতের সম্মান ও ইজ্জতের সাথে ব্যবহার করা উচিৎ। কঠোর ও কর্কশ ব্যবহার করা অনুচিত। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ব্যবহার আযরের সাথে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপদ্ধতি আবূ তালিবের সাথে এ বিষয়ে অকাট্য ও সুনিশ্চিত প্রমাণ।[6]

যদি মুমিনের অন্তর বিশুদ্ধ আকিদার ওপর নিশ্চিন্তে মুখ ও অন্তরের ঐক্যের সাথে ঈমান রাখে, কিন্তু চাক্ষুষ দর্শন অনুভব করার জন্য কিম্বা যথার্থ বিশ্বাসের স্তর পর্যন্ত লাভ করার উদ্দেশ্যে কোনো ঈমান বা বিশ্বাসের মাস’আলায়ও প্রশ্ন এবং অন্বেষণের পথ অবলম্বন করে এবং অন্তরের তৃপ্তি প্রার্থী হয়, তবে এ অন্বেষণ সন্দেহ এবং কুফুর নয়, বরং প্রকৃত ঈমান। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের জবাব

﴿وَلَٰكِن لِّيَطۡمَئِنَّ قَلۡبِيۖ ٢٦٠﴾ [البقرة: ٢٦٠]

বাক্যটি দ্বারা এ গূঢ়তত্ত্ব পরিস্কার হয়ে যায়।

আল্লাহ তা‘আলা যে সমস্ত মহাপুরুষকে নিজের সত্য প্রচারের জন্য নির্বাচন করে থাকেন তাদের সম্মুখে আল্লাহর মহব্বত এবং সততা ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু বাকীই থাকে না। এ কারণে প্রথম থেকেই তাদের মধ্যে এ যোগ্যতা প্রদান করা হয় যে, তারা শৈশবকাল হতেই নিজেদের সমসাময়িকদের মধ্যে বিশিষ্ট্য ও উজ্জ্বলরূপে পরিদৃষ্ট হন এবং আল্লাহর রাস্তায় পরীক্ষাসমূহকে আনন্দের সাথে সহ্য করে ধৈর্য্য ও সন্তুষ্টির উত্তম আদর্শ পেশ করতে থাকেন। ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের ঘটনাটি এর প্রমাণের জন্য উপযুক্ত সাক্ষী এবং হাজার হাজার উপদেশমূলক দৃষ্টান্ত।[7]

[1] আল-ছা‘আলাবী, কাসাসুল আম্বিয়া (তুরস্ক, ১২২৬ হি.) পৃ. ৮৮।

[2] আব্দুল ওয়াহাব আল-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮।

[3] মাওলানা হিফযুর রহমান, অনু: মাওলানা নূরুর রহমান, কাসাসুল কুরআন, ৫ম সংস্করণ (ঢাকা: ইমদাদিয়া লাইব্রেরি, ২০০১ খৃ.), খ. ১, পৃ. ২৭২।

[4] প্রাগুক্ত।

[5] প্রাগুক্ত।

[6] ইবন কাছীর, তারীখ আল-কামিল, ১ম সংস্করণ, (বৈরুত: দার আল কুতুব আল- ইলমিয়্যা, ১৪০৭/১৯৮৭), খ. ১. পৃ.৭৪।

[7] আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী, তাফসীর কাবীর (বৈরুত: তা.বি), খ. ২৬. পৃ. ১৫৩।