লগইন করুন
ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা নূহ ‘আলাইহিস সালামের কিসসা স্মরণ করতে পারি যাতে তার ছেলে কিন‘আনের বে-ঈমানীর কথা উল্লেখ আছে। নবীর ছেলে হয়েও ঈমান না আনার কারণে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পায়নি। নূহ ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর শিক্ষা নিতে পারি।
প্রত্যেকটি মানুষকে নিজের কার্যকলাপ ও ‘আমলের জন্য নিজেই আল্লাহ তা‘আলার দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং পিতার বুযুর্গী ও উচ্চ মর্যাদা দ্বারা পুত্রের পাপের প্রতিকার হতে পারে না এবং পুত্রের নেক ‘আমল ও পারলৌকিক সৌভাগ্য পিতার অবাধ্যচারণের বিনিময় বা বদলাও হতে পারে না। নূহ ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়াত ও পয়গম্বরী তাঁর পুত্র কিন‘আনের কুফুরের শাস্তি ঠেকাতে পারে নি এবং ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের পয়গম্বরী ও উচ্চমর্যাদা ও উচ্চমর্যাদা পিতা আযরের শির্কের জন্য মুক্তির কারণ হতে পারে নি।[1] এ বিষয়ে আল্লাহর বাণী,
﴿قُلۡ كُلّٞ يَعۡمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِۦ﴾ [الاسراء: ٨٤] ‘
‘বলুন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করে থাকে।’’ [সূরা আল ইসরা, আয়াত: ৮৭]
অসৎ সঙ্গ হলো বিষের চেয়েও অধিক মারাত্মক। এর প্রতিফল ও পরিণতি অপমান, লাঞ্ছনা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়, মানুষের জন্য নেক ‘আমল যেমন জরুরী তদপেক্ষা অধিক জরুরী নেককারদের সংসর্গ। পক্ষান্তরে মন্দকার্য হতে আত্মরক্ষা করা মানুষের জীবনের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য[2] তদপেক্ষা অধিক প্রয়োজনীয় অসৎ সঙ্গ হতে বাঁচিয়ে রাখা। কবি বলেছেন:
‘‘নূহের পুত্র পাপাচারীদের সাথে উঠাবসা করেছে, ফলে সে নবী বংশের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। (নবীর বংশে জন্মলাভ করা তার কোনই কাজে আসে নি। আসহাবে কাহাফের কুকুর কিছু দিন নেককারদের সংসর্গ লাভ করে মানব (এর ন্যায় মর্যাদাশালী) হয়ে গেছে। নেককারের সংসর্গ তোমাকে নেককার বানিয়ে দেয়। বদকারের সংসর্গ বদকার করে দেয়।’’
আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ নির্ভর ও ভরসা রাখার সাথে বাহ্যিক উপকরণের ব্যবহার তাওয়াক্কুল-এর পরিপন্থী নয়; বরং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের জন্য সঠিক কর্মপন্থা। সে কারণেই তো নূহ ‘আলাইহিস সালামের প্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকার প্রয়োজন হয়েছিল।[3]
আল্লাহ তা‘আলার পয়গম্বর এবং নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও মানবীয় স্বভাবসূলভ কারণে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালমের পদঙ্খলন বা ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘটিত হতে পারে, কিন্তু তারা সে ত্রুটি বিচ্যুতির ওপর স্থায়ী থাকেন না, বরং আল্লাহ তা‘আলার তরফ হতে তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং সে ত্রুটি থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। আদম ‘আলাইহিস সালাম এবং নূহ ‘আলাইহিস সালামের ঘটনাগুলো এর সঠিক সাক্ষ্য, এতদ্ভিন্ন তারা গায়েব সম্বন্ধীয় জ্ঞানেরও অধিকারী নন। যেমন, এ ঘটনায় নূহকে আল্লাহ বলেছেন “আমার নিকট এমন বিষয়ের সুপারিশ করো না, যা সম্বন্ধে তুমি অবহিত নও।’’ এতেই পরিষ্কারভাবে উপরোক্ত কথাটি বুঝা যায়।[4]
কর্মফল সম্বন্ধীয় আল্লাহ তা‘আলার কানূন যদিও প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু এটি জরুরী নয় যে, প্রত্যেক অপরাধের শাস্তির কিংবা প্রত্যেক নেককাজের বিনিময় দুনিয়াতেই পাওয়া যাবে। কেননা এ বিশ্বজগৎ কর্মক্ষেত্র। আর কর্মফলের জন্য পরলোককে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তথাপি যুলুম এবং অহংকার এ দুটি মন্দ কার্যের শাস্তি কোনো না কোনো প্রকারে এখানে দুনিয়াতেও পাওয়া যাবে।
ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. বলতেন, যালিম ও অহংকারী লোকেরা মৃত্যুর পূর্বেই নিজেদের যুলুম ও অহংকারের শাস্তি কিছু না কিছু প্রাপ্ত হয় এবং অপমান ও বিফলতার সম্মুখীন হয়। যেমন, আল্লাহর সত্য পয়গম্বরগণকে কষ্ট প্রদানকারী সম্প্রদায়সমূহের এবং ইতিহাসে উল্লিখিত যালিম ও অহংকারীদের অপদেশমূলক ধ্বংস-লীলার ঘটনাসমূহ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।[5]
[2] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়া আল-নিহায়া, (মিশর: দার আল ফিকর আল আরাবী, তা. বি), খ. ১, পৃ. ৬১।
[3] ইবন কাসীর, আল বিদায় ওয়া আল নিহারা, (মিশর: দার আল ফিকর আল আরাবী, তা. বি), খ. ১, পৃ. ১১৫।
[4] আল-ছা‘আলাবী, কাসাসুল আম্বিয়া (তুরস্ক: ১২২৬ হি.); প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।
[5] কাজী জয়নুল আবেদীন সাজ্জাদ মিরাঠী, কাসাসুল কুরআন, ১ম সংস্করণ (আসাম: মারকায আল মা‘আরিফ, ১৯৯৪ খৃ.), পৃ. ২৭।