লগইন করুন
মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে আমরা এমন অনেকেই আছি যারা শুধু মনে করি নামায পড়া ভালো কাজ। কিন্তু আমরা জানি না ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নামাযের গুরুত্ব ও মর্যাদা কতটুকু? এটাও জানি না যে, নামায পরিত্যাগের মধ্যে একজন বনী আদমের জন্য কত ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আবার কেউ কেউ শুধু এতটুকু জানি যে, বে-নামাযীর গুনাহটা হবে শুধু পরকালে। অতএব, অন্তত: এখনতো ভালোই আছি। কেউ আবার ভাবি, বয়সতো তেমন হয়নি।সময় হোক...। অর্থাৎ নামায যেন বুড়াকালের আমল।
আবার কেউ কেউ বলি, নামায শুরু করবো। তবে কাল থেকে...। শয়তানের প্ররোচনায় সময় হারিয়ে এভাবে যারা দিন পার করে দিচ্ছে তারা আগামীকালের খোঁজ আর পায় না। বরফের মতো সময় তাদের গলে যাচ্ছে। এমনই অবস্থায় হঠাৎ করে মৃত্যু এসে একদিন তাকে ঘেরাও করে ফেলে। অতঃপর তার পরিণতি কী হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত কত করুণ, এ বিষয়ে এখানে ক্ষুদ্র আলোচনা। শুরুতেই আল্লাহ তাআলার বাণী, এরপর রাসূলুল্লাহ (স)-এর কথা এবং সর্বশেষে উলামায়ে কিয়ামের ফাতাওয়া:
ক. প্রথমত:
১. আল কুরআনে বলা হয়েছে,
“অতঃপর এমন এক সময় আসল যখন লোকেরা নামায ছেড়ে দিল, আর লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে গেল।ফলে তারা শীঘ্রই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়ে যাবে। তবে কিছু লোক এ থেকে রেহাই পাবে, যারা তাওবা করবে, ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে।” (সূরা ১৯; মারইয়াম ৫৯-৬০)।
২. আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে,
“(পরকালে জান্নাতবাসীরা ঠাট্টার ভাষায় দোযখবাসীদের জিজ্ঞেস করবে) কী অপরাধ তোমাদেরকে আজ আগুনে ঢুকিয়েছে? উত্তরে তারা বলবে-আমরা নামায পড়তাম না, আর মিসকীনকে খাবার দিতাম না।” (সূরা ৭৪; মুদ্দাসছির ৪২-৪৪)
৩. আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
“তারা ঈমান আনেনি, নামাযও পড়েনি। বরং উল্টো তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং (ঈমান থেকে) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।অহংকারের সাথে বাড়ি ফিরে গিয়েছে, পরিবারপরিজনের কাছে।(অতএব, হে বেঈমান, হে বে-নামাযী!) তোমার জন্য দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ!
আবারও বলছি, তোমার জন্য দুর্ভোগ আর দুর্ভোগ! মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, কোন প্রকার হিসাব-নিকাশ ছাড়া) এমনিই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা ৭৫; কিয়ামাহ ৩১-৩৬)
৪. আল্লাহ তাআলা বলেন,
“(কিয়ামতের) দিন হাঁটুর নিম্নাংশ উন্মুক্ত করা হবে, আর (বেনামাযীদেরকে ডাকা হবে তাদের রবকে সিজদা করার জন্য। কিন্তু সেদিন তারা তা (শত চেষ্টা করলেও) পারবে না। তাদের দৃষ্টি থাকবে ভীত বিহ্বল এবং অবস্থা হবে অত্যন্ত অপমানজনক। (দুনিয়ার জীবনে যখন) তাদেরকে (নামাযের) সিজদার জন্য ডাকা হতো (তখন তা তারা করেনি)। অথচ তারা তখন ছিল সুস্থ (ও সক্ষম)। (সূরা ৬৮; কলম ৪২-৪৩) উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ে ইমাম বুখারী (র) একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তা হলো, আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, মহানবী (স) বলেছেন, আমাদের রব তাঁর পায়ের গোছা উন্মুক্ত করবেন। তখন প্রত্যেক মুমিন নর-নারী তাকে সিজদা করবে।(কিন্তু বেনামাযীরা সেদিন তা পারবে না।)
৫. আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন তাদের বলা হতো রুকু কর (অর্থাৎ নামায পড়) তখন তারা রুকু করত না (অর্থাৎ নামায পড়তো না) সত্যকে যারা মিথ্যা বলতো ঐসব লোকদের জন্য ধ্বংস।” (সূরা ৭৭; মুরসালাত ৪৮)। যারা এ যিকির (সালাত আদায় করবে না তাদের জীবন হবে সংকুচিত (কঠিন) এবং কিয়ামতের দিন হাশরে উঠবে তারা অন্ধ অবস্থায়।
“(হ্যা,) যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তার জন্যে (জীবনে) বাঁচার সামগ্রী সংকুচিত হয়ে যাবে, (সর্বোপরি) তাকে আমি কিয়ামতের দিন অন্ধ বানিয়ে হাজির করবো।” (সূরা ২০; ত্বা-হা ১২৪)
খ. দ্বিতীয়ত: বে-নামাযীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স)-এর হুঁশিয়ারী:
তাদের ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:
৬. রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “একজন মুসলমান ও শির্ক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামায পরিত্যাগ করা। (অর্থাৎ নামায যে কেউ ছেড়ে দেয়, সে লোক আর কাফের মুশরিকের মধ্যে আর কোন পার্থক্য থাকে না) (মুসলিম)
৭. অপর এক হাদীসে তিনি আরো বলেছেন, “আমাদের ও তাদের মধ্যে চুক্তি হলো নামায নিয়ে। যে ব্যক্তি এ নামায ছেড়ে দিল সে কুফরী করল (বা কাফের হয়ে গেল)।” (আহমাদ ও আবু দাউদ)
৮. “যে ব্যক্তি তার সালাত হেফাযত করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্য থাকবে নূর, প্রমাণ ও নাজাত। আর যে ব্যক্তি তার সালাতের হেফাযত করবে না তার জন্য কোন নূর নেই, নাজাত নেই, মুক্তির জন্য তার পক্ষে কোন দলীল থাকবে না এবং কিয়ামতের দিন কারূন, ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফ (এসব কাফির মুশরিকদের) সাথে তার হাশর হবে।” (মুসনাদে আহমাদ ও সহীহ ইবনে হিব্বান) অর্থাৎ, হাশরের মাঠে মুসলমানদের কাতারে সে দাঁড়াতে পারবে না। নাউযুবিল্লাহ!
গ. তৃতীয়ত: সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীনদের উক্তি
৯. দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নামায পরিত্যাগ করল ইসলামে তার জন্য আর কোন কিছুই রইল না।”
১০. তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনে শাকীক বলেন, “নবী (স)-এর সাহাবাগণ একমাত্র নামায তরক করা ছাড়া অন্য কোন আমল পরিত্যাগ করাকে কুফরী বলে উল্লেখ করেননি।” (তিরমিযী) অর্থাৎ নামাযই একমাত্র ইবাদত যা পরিত্যাগ করাকে তারা কুফরী বলে বর্ণনা করেছেন।
ঘ. চতুর্থত: মাযহাবের ইমাম ও বিজ্ঞ ফকীহগণের মতামত
সার্বক্ষণিকভাবে নামায তরক করে চলছে এমন সব বেনামাযীদের সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নায় আরো যেসব হুঁশিয়ারি এসেছে এসবের আলোকে বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের ফাতাওয়া আরবী ও বাংলা গ্রন্থাবলিতে রয়েছে। এর মধ্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাতাওয়া নিম্নে তুলে ধরা হলো, যদিও এ মাসআলাগুলোতে ইমাম ও ফকীহগণের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু মতবিরোধ রয়েছে, এগুলো হলো:
১১. বেনামাযীর শেষ নিঃশ্বাস: বেনামাযীর মৃত্যুকালে ফেরেশতারা তার মুখমণ্ডল ও নিতম্বে প্রহার করতে থাকবে (সূরা ৮; আনফাল ৫০-৫১)। এজন্য বেনামাযীদের কারো কারো চেহারা কালোবর্ণ ধারণ করে থাকে।
১২. জানাযা: বেনামাযীর জানাযা পড়াও জায়েয নেই। যেহেতু নামায না পড়া কুফরী কাজ। আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। অপর একদল আলেমের মতে, তার জানাযা পড়া যেতে পারে। কারণ, সে মুসলিম পরিবারের সন্তান। তবে আলেমরা তার জানাযা পড়বে না। পড়বে সাধারণ কিছু লোক।
১৩. কবর দেওয়া: মুসলমানের কবরস্থানে তাকে দাফন করা যাবে না। তার কবর হবে দূরদূরান্তে আলাদা কোন জায়গায়। যেহেতু বেনামাযীর জন্য বিভীষিকাময় শাস্তির হুঁশিয়ারি রয়েছে সেহেতু এ আযাব যেন কোন মুসলমানের কবরের পাশে না হয়। সেজন্য তার কবর হবে ভিন্ন জায়গায়। কবরের আযাবের ভয়ে বেনামাযী ও পাপিষ্ঠ লোকদের লাশ দাফনের আগেই চিৎকার করতে থাকে। এত বিকট আওয়াজে এ লাশ চিৎকার করে যে, পশুপক্ষী ও প্রাণীকূলের সকলেই এ আওয়াজ শুনতে পায়। শুধু শুনে না মানুষ ও জ্বিন জাতি। যদি তাদের মধ্যে কেউ লাশের কান্নার এ বিকট আওয়াজ শুনতে পেত তাহলে ভয়ে ভীতবিহ্বল হয়ে জীবিত লোকেরাও হুঁশ হারিয়ে ফেলত।
১৪. কবরের অবস্থা: তার জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে দেওয়া হবে। লোহার লম্বা হাতলবিশিষ্ট ভারী হাতুড়ি নিয়ে একজন ফেরেশতা প্রস্তুত থাকবে। এ ফেরেশতা তাকে এমন জোরে আঘাত করতে থাকবে যার ফলে তার দেহটা মাটিতে মিশে যাবে।
১৫. হাশর পরকাল: কারূন, ফেরাউন ও হামানের সাথে তার হাশর হবে। চেষ্টা করেও মুসলমানদের কাতারে এসে বেনামাযীরা দাঁড়াতে পারবে না। দোযখের আগুন হবে তাদের। চিরস্থায়ী আবাস।
১৬. বিবাহ বন্ধন: কোন কোন ফকীহর মতে স্ত্রী নামাযী হলে বেনামাযী স্বামীর সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।(তবে যদি বিপরীতে স্ত্রী বেনামাযী হয় আর স্বামী নামাযী হয় সেক্ষেত্রে বিবাহ চলতে পারে ।)।
১৭. সম্পদ প্রাপ্তি: কোন বেনামাযী তার রক্ত সম্পর্কের লোকদের কাছ থেকে ওয়ারিশসূত্রে কোন সম্পদ পাবে না। আর যদি মৃত ব্যক্তিটি বেনামাযী হয় তাহলে তার সম্পদও তার নিকটাত্মীয়রা পাবে না। উক্ত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
১৮. সাহচর্য কোন বেনামাযীরই সঙ্গী সাথী হওয়া জায়েয নেই। তার কাছ থেকে দূরে থাকা ও তাকে পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। তবে দাওয়াতী কাজের জন্য, তাকে সদুপদেশ ও পরামর্শ প্রদানের জন্য তার সঙ্গী হওয়াতে কোন বাধা নেই।
১৯. পশু জবাই: তার জবাইকৃত পশুর মাংস খাওয়া জায়েয নেই।
২০. মক্কায় প্রবেশ: মক্কা ও হারামের সীমানার মধ্যে বেনামাযীর প্রবেশ নিষিদ্ধ।
২১. জাগতিক অবস্থা: তার জীবন হবে কষ্টদায়ক, সংকীর্ণ ও যন্ত্রণাদায়ক। অতএব, আপনি যদি নামাযী হয়ে থাকেন তাহলে সত্যিই আপনি বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান। আর তা না হলে নিজেই ভেবে দেখুন আপনি মুসলমান আছেন কিনা?
(তথ্যসূত্র: সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান / শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহ), সৌদি আরব]