লগইন করুন
আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্বপ্নে কেবল তারাই দেখতে পারেন যারা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর গুণে গুণান্বিত।[1] কিন্তু, যাদের অবস্থা উপরে বর্ণিত হয়েছে তারা কোনো দিন তাঁদেরকে জাগ্রত অবস্থায় দেখাতো দূরের কথা, কখনো স্বপ্নে দেখারও কথা নয়। তা ছাড়া আল্লাহ তা‘আলাকে জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে থাকাকালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও দেখেন নি। মে‘রাজের রাতে কোনো এক স্থানে আল্লাহর সাথে তাঁর একান্ত কথা-বার্তা হওয়ার সময় তিনি কি আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন? এ নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে স্বচক্ষে দেখেছেন। তবে অধিকাংশ মনীষীদের মতে স্বচক্ষে দেখেন নি। বরং অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখেছিলেন।[2] এবং পর্দার অন্তরাল থেকেই উভয়ের মাঝে কথা-বার্তা হয়েছিল। কুরআনুল কারীম দ্বারা এ কথারই সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ ۞وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللَّهُ إِلَّا وَحۡيًا أَوۡ مِن وَرَآيِٕ حِجَابٍ أَوۡ يُرۡسِلَ رَسُولٗا فَيُوحِيَ بِإِذۡنِهِۦ مَا يَشَآءُۚ ﴾ [الشورا: ٥١]
‘‘আর কোনো মানুষের পক্ষে এমনটি হওয়া সম্ভবপর নয় যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তবে তিনি মানুষের সাথে ইলহাম বা পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন। অথবা (সে জন্য) তিনি কোনো দূত প্রেরণ করেন, অতঃপর সে দূত আল্লাহ যা চান তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেন’’।[3]এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষের সাথে মোট তিনভাবে কথা বলেন:
এক, ওহী অর্থাৎ গোপন পন্থায় ইলহাম বা স্বপ্নের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নবী-রাসূল ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন।
দুই, পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন।
তিন, রাসূল তথা ফেরেশ্তা প্রেরণের মাধ্যমে কথা বলেন। মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী‘ও উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।[4]
আল্লাহ তা‘আলা যখন মানুষের সাথে উপর্যুক্ত এ তিন মাধ্যমে কথা বলে থাকেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ-কথা প্রমাণিত হয় যে, মে‘রাজের রজনীতে তিনি রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে পর্দার অন্তরাল থেকেই কথা বলেছিলেন। মূসাও আল্লাহ তা‘আলাকে সরাসরি দেখার জন্য আবেদন করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বলেছিলেন:
﴿ قَالَ لَن تَرَىٰنِي وَلَٰكِنِ ٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡجَبَلِ فَإِنِ ٱسۡتَقَرَّ مَكَانَهُۥ فَسَوۡفَ تَرَىٰنِيۚ فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُۥ لِلۡجَبَلِ جَعَلَهُۥ دَكّٗا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقٗاۚ ﴾ [الاعراف: ١٤٣]
‘‘তুমি আমাকে কস্মিনকালেও (সরাসরি) দেখতে পারবে না, তবে তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও সেটি যদি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তাঁর প্রভু পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, তখন তিনি সেটাকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন’’।[5] এ আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, এ দুনিয়াতে থাকাবস্থায় বা আখেরাতের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলাকে চর্মচক্ষে দেখা কোনো নবী-রাসূল ও ওলিদের পক্ষেও সম্ভবপর নয়।
যুক্তির দিক থেকে দুনিয়ায় আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখার সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে যখন মূসা এবং আমাদের রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে সরাসরি দেখা সম্ভব হয়নি, তখন অন্য কারো পক্ষে যে তা আদৌ সম্ভবপর হবে না, তা বলা-ই বাহুল্য। এর পরেও কেউ যদি এ দুনিয়ায় আল্লাহকে সরাসরি স্বচক্ষে দেখেছে বলে দাবী করে, তবে সে যে একজন মস্তবড় মিথ্যুক হবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ব্যতীত অপর কারো জন্যে এ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বচক্ষে দেখার কথাকে বিশ্বাস করে এদেরকে ইমাম কাওয়াশী অমুসলিম বলে আখ্যায়িত করেছেন।[6]
আক্বীদা বিষয়ক কবিতায় জনৈক কবি বলেন:
و من قال في الدنيا يراه بعينه ** فذاك زنديق طغا و تمردا
و خالف كتاب الله و الرسل كلها ** و زاغ عن الشرع الشريف و أبعدا
‘‘যে বলে আল্লাহকে দুনিয়ায় স্বচক্ষে দেখা যায়, সে হলো যিন্দীক, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। আল্লাহর কিতাব এবং সকল রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আর শরী‘আত থেকে বিপথগামী হয়ে বহু দূরে চলে গেছে’’।[7]
অপর দিকে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর তাঁকেও তাঁর সাহাবীগণ কখনও জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পায়নি। এমতাস্থায় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার কথা বলে তারা আসলে শয়তানকেই দেখে। ‘‘রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা স্বপ্নে দেখে তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখতে পাবে’’[8] এ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়ে থাকলেও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখ নিঃসৃত মূল বাণীটি কী, এ নিয়ে এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মুসলিম এর বর্ণনায় বর্ণনাকারীগণ সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন:‘‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে, অথবা সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখলো’’।[9] রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল বাণী যদি ‘‘সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখলো’’ এমনটি হয়, তা হলে এ হাদীস নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। তা না হয়ে যদি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মূল বাণী ‘‘সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে’’ হয়ে থাকে, তা হলে এ হাদীসের সঠিক অর্থ কী হবে, এ নিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা বলেছেন:
যদি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মূল বাণী হয় ‘‘সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে’’- তা হলে এ বাক্যটি তাঁদের মতে একটি জটিল বাক্য। এর সমাধানে তারা মোট ছয়টি মতামত ব্যক্ত করেছেন। যা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে বর্ণিত হলো:
এক, এটি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- একটি উপমা স্বরূপ বলেছেন। অর্থাৎ -যে তাঁকে স্বপ্নে দেখবে, তার এ দেখাটি তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার মতই হবে।
দুই. যে এমনটি দেখবে সে জাগ্রত হয়ে তার এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা যথাযথভাবে দেখতে পাবে।
তিন. এ হাদীসটি তাঁর সমসাময়িক লোকদের সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ-তাঁর সময়কার যে ব্যক্তি তাঁকে না দেখে ইসলাম গ্রহণ করার পর এমন স্বপ্ন দেখবে, সে তাঁকে তাঁর জীবদ্দশায় কিছু দিন পরে হলেও দেখতে পারে।
চার. যে এমন স্বপ্ন দেখবে সে রাসূলের আয়নাতে তাঁকে দেখতে পাবে। যেমনটি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখেছিলেন।
পাঁচ. যে এমনটি দেখবে, সে কেয়ামতের দিন তাঁকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে দেখতে পাবে। ছয়. যে এমনটি দেখবে, সে বাস্তবে তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে। তবে এ অর্থ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু সমস্যা রয়েছে যা তা গ্রহণের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে থাকে।[10] হাদীসবিদ ইবনে হাজার ‘আসক্বালানী উক্ত বাহ্যিক অর্থকে একটি জটিল ও অবিশ্বাস্য অর্থ বলে মন্তব্য করেছেন।[11]
>ثم ذكر أنه عام في أهل التوفيق وأما غيرهم فعلى الاحتمال فان خرق العادة قد يقع للزنديق بطريق الإملاء والإغواء كما يقع للصديق تحصل التفرقة بينهما باتباع الكتاب والسنة انتهى.
[2]. এ প্রসঙ্গে মুল্লা আলী ক্বারী হানাফী বলেন:
" إن أهل السنة و الجماعة و إن أجازوا رؤية الله في الدنيا عقلا ، وواقعة و ثابتة في العقبى سمعا ونقلا ، لكنهم اختلفوا في جوازاها في الدنيا شرعا . والذين أثبتوها في الدنيا خصوا وقوعها له صلى الله عليه وسلم في ليلة الإسراء، على خلاف في ذلك بين السلف والخلف من العلماء و الأولياء... ثم قال و الصحيح أنه صلى الله عليه وسلم إنما رأى ربه بفؤاده ، لا بعينه"
--:দেখুন: ইবনু আবিল ইয্য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত;পৃ. ১৮৪।
[3]. মাওলানা মুহাম্মদ শফী‘;প্রাগুক্ত; পৃ.১২২৬।
[4]. তদেব; পৃ.১২২২।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৪৩।
[6].ইমাম কাওয়াশী সূরা নাজম এর তাফসীরে বলেন:
" ومعتقد رؤية الله تعالى هنا بالعين لغير محمد صلى الله علية وسلم غير مسلم".
:দেখুন:ইবনু আবিল ইয্য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত;১৮৪।
[7]. তদেব; পৃ.১৮৬।
[8]. " مَنْ رَأَنِيْ فِيْ المَنَامِ فَسَيَرَانِيْ فِي الْيَقْظَةِ وَ لاَ يَتَمَثَّلُ بِيْ الشَّيْطَانُ."বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুর রু’য়া, বাব নং ১০, হাদীস নং ৬৫৯২), ৬/২৫৬৭; ইবনে হাজার ‘আসক্বালানী, ফতহুলবারী; ১২/৩৮৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুর রু’য়া, হাদীস নং ২২৬৬), ৪/১৭৭৫।
[9].ইমাম মুসলিম এর বর্ণনায় সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়েছে (فسيراني في اليقظة أو لكأنما رأني في اليقظة) ‘‘আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে অথবা সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থার মতই দেখলো’’এ কথা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইসমাঈলী উক্ত কথার বদলে বলেছেন: (فقد رأني في اليقظة) ‘‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো সে যেন আমাকে জাগ্রত অবস্থায়ই দেখলো’’। দেখুন:মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/১৭৭৫।
[10].তিনি বলেন:
الحاصل من الأجوبة ستة أحدها أنه على التشبيه والتمثيل ودل عليه قوله في الرواية الأخرى فكأنما رأني في اليقظة، ثانيها: أن معناها سيرى في اليقظة، ثالثها:أنه خاص بأهل آلاف ممن آمن به قبل أن يراه، رابعها:أنه يراه في المرآة التي كانت له إن أمكنه ذلك ، وهذا من أبعد المحامل، خامسها: أنه يراه يوم القيامة يمزيد الخصوصية لا مطلق من يراه حينئذ ممن لم يره في المنام، سادسها: أنه يراه في الدنيا حقيقة و يخاطبه ، و فيه ما تقدم من الإشكال
দেখুন: ইবনে হাজার, ফাতহুলবারী, ১২/৩৮৫।
[11]. এক দল সালেহীন থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখার পর পুনরায় তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায়ও দেখেছেন। কিছু বিষয় সম্পর্কে তারা তাঁকে জিজ্ঞাসাও করেছেন। এবং জিজ্ঞাসার ফলাফলও সঠিকমত পেয়েছেন। ইবনে হাজার এ-কথা উল্লেখ করে বলেন: তাদের এ দাবী যদি সত্যি হয়, তা হলে তা একটি জটিল বিষয় হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, এতে তারা সাহাবী হওয়ার মর্যাদা পাবেন, এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা এভাবে রাসূলকে দেখেছে বলে দাবী করবে, তারাও সাহাবী হওয়ার মর্যাদা পাবে। অপর পক্ষে এমনও কিছু মনীষী রয়েছেন, যাঁরা রাসূলকে স্বপ্নে দেখেছেন বলে বর্ণানা করেছেন, কিন্তু তারা তাঁকে জাগ্রত অবস্থায় দেখার কথা বলেন নি। সে-জন্য যারা রাসূলকে জাগ্রত দেখার কথা বলেন তাদের কথাকে বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করলে তা একটি জটিল অর্থ বলেই প্রতীয়মান হয়। দেখুন: তদেব।