লগইন করুন
কুরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম শাফা‘আত বা সুপারিশকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে:
এক.দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আত।
দুই. পরকালীন বিষয়ে শাফা‘আত।
দুনিয়াবী বিষয়ে পরস্পরের নিকট শাফা‘আত করা বৈধ হওয়ার শর্তসমূহ:
শাফা‘আত যদি পার্থিব কোনো বিষয়ে কোনো জীবিত মানুষের কাছে চাওয়া হয়, তবে নিম্নে বর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে তা চাওয়া ও করার বৈধতা রয়েছে:
প্রথম শর্ত: এ শাফা‘আতটি কোনো উপকারী বিষয়ে এবং কারো এমন কোনো অধিকারের ক্ষেত্রে হতে হবে যা নষ্ট হয়ে গেছে অথবা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় শর্ত: তা যেন কোনো অপরাধমূলক কাজে বা শরী‘আতের কোনো হদ (শাস্তি) রহিতকরণের ক্ষেত্রে না হয়।
তৃতীয় শর্ত:যার নিকট শাফা‘আত চাওয়া হবে তিনি স্বাভাবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শাফা‘আত করবেন এমন ধারণার ভিত্তিতে তার নিকট শাফা‘আত কামনা করতে হবে। কোনো প্রকার কারামত বা অলৌকিক পন্থা অবলম্বনের ধারণায় নয়।
কারো শাফা‘আত যদি উক্ত শর্তসমূহ পূর্ণ করে তা হলে তা যেমন একটি কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য কাজ হবে, তেমনি এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে পুণ্য পাওয়ারও আশা করা যাবে। অন্যথায় তা পাপের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। এ-জাতীয় শাফা‘আত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ مَّن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةً حَسَنَةٗ يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةٗ سَيِّئَةٗ يَكُن لَّهُۥ كِفۡلٞ مِّنۡهَاۗ ﴾ [النساء: ٨٥]
‘‘যে লোক সৎ কাজের জন্য কোনো শাফা‘আত করবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক কোনো মন্দ কাজের জন্য শাফা‘আত করবে, সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে’’।[1]
উল্লেখ্য যে, এ-জাতীয় শাফা‘আত কোনো জীবিত অনুপস্থিত অথবা মৃত মানুষের নিকট চাওয়া যায় না। কেননা, তা তাদের নিকট কামনা করা তাদেরকে গায়েবের জ্ঞানী বলে বিশ্বাস করার নামান্তর। আর কারো ব্যাপারে এমন ধারণা করা জ্ঞানগত শির্কের অন্তর্গত।
দুনিয়াবী বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত:
কোন জীবিত মানুষের নিকট যেয়ে দুনিয়াবী কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ বা শাফা‘আত করার জন্য তাকে বলা যেতে পারে। তিনিও দু’টি কথা বলে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তির জন্য শাফা‘আত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শাফা‘আতকারীর সবচেয়ে পরহেজগার হওয়া কোনো জরুরী ব্যাপার নয়। বরং অপেক্ষাকৃত কম পরহেজগার লোকের কাছেও এ-জাতীয় শাফা‘আত চাওয়া যেতে পারে। কেননা, আল্লাহর কাছে শাফা‘আতের ক্ষেত্রে মূল ওসীলা হচ্ছে ব্যক্তির মুখের দুটি কথা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, তার মর্যাদা ও সম্মান নয়। কোনো দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আত করার জন্য কোনো অনুপস্থিত বা মৃত মানুষের কাছে কোনো আবদার করা যায়না। কেননা, জীবিতরা কোনো গায়েবের আওয়াজ শুনতে পারেন না। আর মৃতদের কবরের পার্শ্বে যেয়ে তাদের কাছে সুপারিশের জন্য কোনো আবেদন করলে কুরআনের কথানুযায়ী তারা কারো কোনো আবেদন শুনতে পান না, পেলেও তারা কারো আবেদনে সাড়া দিতে পারেন না।[2]
সকল মানুষই মরে যাওয়ার পর বরযখী জীবনে তারা নিজের বা পরের উপকারে আসতে পারে এমন কোনো কর্ম করতে পারেন না। তাদের রূহ স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে আমাদের জন্যে কোনো কল্যাণ কামনা করে দো‘আ করলেও আল্লাহর নিকট এর কোনো কার্যকারিতা নেই। কেননা, কবরের জীবন সে রকম কোনো ‘আমলের জীবন নয়। এ-জন্যই রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বা কোনো ওলির কবরে গিয়ে বা দূর থেকে তাঁদের কাছে নিজের জন্য কোনো দো‘আ করার আবেদন করা যায় না। সাহাবা ও তাবেঈগণের যুগে মুসলিমরা বহুবিধ সমস্যায় পতিত হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা কখনও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর মুবারকে যেয়ে তাঁর নিকট সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করার ব্যাপারে কোনো আবেদন করেছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আখেরাতে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত:
জীবিত থাকাবস্থায় কোনো দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আতের ক্ষেত্রে বিষয়টি যদি উপরে বর্ণিত শর্ত পূর্ণ করে, তা হলে এমন বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করার ব্যাপারে তাঁর আগাম অনুমতি রয়েছে। আমরা ইচ্ছা করলেই পরস্পরের জন্য এমন কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করতে পারি। কিন্তু আখেরাতে আল্লাহর কাছে শাফা‘আতের বিষয়টি দুনিয়াবী শাফা‘আত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেননা, এ দিনে শাফা‘আতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে আল্লাহ তা‘আলার হাতে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই তিনি বলেছেন:
﴿ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [الزمر: ٤٤]
‘‘আপনি বলে দিন- শাফা‘আতের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন’’।[3]এ দিনে কেউ তার নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দিক বিবেচনা করে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে তার নিজের বা পরের জন্য কোনো সুপারিশ করাতো দুরের কথা, এ দিনে কেউ তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো কথাই বলতে পারবে না। এ দিবসের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿ يَوۡمَ يَأۡتِ لَا تَكَلَّمُ نَفۡسٌ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [هود: ١٠٥]
‘‘যখন সেই দিন আসবে, তখন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না।’’[4] আল্লাহর ভাষায় :
﴿ لِكُلِّ ٱمۡرِيٕٖ مِّنۡهُمۡ يَوۡمَئِذٖ شَأۡنٞ يُغۡنِيهِ ٣٧ ﴾ [عبس: ٣٧]
‘‘সে দিন সকল মানুষেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে’’।[5] সে দিন কাফির ও মু’মিন নির্বিশেষে কারো জন্যে কারো শাফা‘আত থাকবে না। সে-জন্য সে দিনে কারো শাফা‘আতের আশায় না থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরক নির্দেশ করে বলেছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡمٞ لَّا بَيۡعٞ فِيهِ وَلَا خُلَّةٞ وَلَا شَفَٰعَةٞۗ ﴾ [البقرة: ٢٥٤]
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমাদেরকে আমি যে জীবিকা দান করেছি তাত্থেকে তোমরা ব্যয় কর সে-দিন আগমনের পূর্বে যেদিন থাকবে না কোনো (পুণ্যের)ক্রয়-বিক্রয়, কোনো বন্ধুত্ব ও শাফা‘আত’’।[6] সে-দিনটি এমন যে, সে-দিনে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত মানুষের জন্য কোনো বন্ধু ও শাফা‘আতকারী থাকবে না। যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٥١ ﴾ [الانعام: ٥١]
‘‘এ কুরআনের দ্বারা আপনি তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করুন যারা তাদের প্রতিপালকের কাছে এমন অবস্থায় একত্রিত হওয়াকে ভয় করে যখন তাদের কোনো বন্ধু ও শাফা‘আতকারী থাকবে না, হতে পারে এতে তারা ভীত হবে’’।[7]
সে দিন এমন যে, জান্নাতীদের জান্নাতে চলে যাওয়ার পর যখন তারা তাদের জাহান্নামবাসী আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের জন্য শাফা‘আত করার অনুমতি পাবেন, তখন তারা তাদের স্বজনদের অপরাধের খবর না জেনে কোনো দেবতা, প্রতিমা, কবর ও কবর পূজারী আত্নীয়ের জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করলে তাদের সে শাফা‘আত আল্লাহ তা‘আলার নিকট গৃহীত হবে না। যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ فَمَا تَنفَعُهُمۡ شَفَٰعَةُ ٱلشَّٰفِعِينَ ٤٨ ﴾ [المدثر: ٤٨]
‘‘অতএব (মুশরিকদের জন্য) কোনো সুপারিশকারীদের সুপারিশ কাজে আসবে না’’।[8] মুশরিকরা আজ যাদেরকে আল্লাহর শরীক করে নিয়েছে এবং যাদেরকে আজ তাদের মর্যাদার ওসীলায় তাদের দুনিয়াবী উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আতকারী বলে ভাবছে, কাল আখেরাতের ভয়াবহ দিনে তারা তাদের কথা স্মরণ করলেও তারা তাদেরকে শাফা‘আতকারী হিসেবে পাবে না। বরং সে দিন সবকিছু তাদের ধারণার বাইরে দেখে মুশরিকরা তাদের শরীকদের অস্বীকার করবে। আত্মরক্ষার জন্য তারা বলবে:আমরা তাদেরকে আল্লাহর সাথে কখনও শরীক করিনি। যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ وَيَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشۡرَكُوٓاْ أَيۡنَ شُرَكَآؤُكُمُ ٱلَّذِينَ كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٢٢ ثُمَّ لَمۡ تَكُن فِتۡنَتُهُمۡ إِلَّآ أَن قَالُواْ وَٱللَّهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشۡرِكِينَ ٢٣ ٱنظُرۡ كَيۡفَ كَذَبُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡۚ وَضَلَّ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٤ ﴾ [الانعام: ٢٢، ٢٤]
‘‘আর যেদিন আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করব, অতঃপর যারা শির্ক করেছিল, তাদেরকে বলব: যাদেরকে তোমরা অংশীদার বলে ধারণা করতে, তারা (এখন) কোথায়? অতঃপর তাদের শির্কের পরিণাম এ-কথা ব্যতীত আর কিছুই হবে না যে, তারা বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক ! আল্লাহর শপথ, আমরা মুশরিক ছিলাম না। লক্ষ্য করে দেখ, কিভাবে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলবে। আর তারা তাদের দেবতাদের শাফা‘আতের ব্যাপারে যে মিথ্যা কথা রচনা করেছিল, তা (এখন) তাদের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে’’।[9] অর্থাৎ তা মিথ্যায় প্রতিফলিত হলো।
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:
﴿ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ يُبۡلِسُ ٱلۡمُجۡرِمُونَ ١٢ وَلَمۡ يَكُن لَّهُم مِّن شُرَكَآئِهِمۡ شُفَعَٰٓؤُاْ وَكَانُواْ بِشُرَكَآئِهِمۡ كَٰفِرِينَ ١٣ ﴾ [الروم: ١٢، ١٣]
‘‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে। তারা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করে নিয়েছিল তাদের মধ্যকার কেউ তাদের সুপারিশকারী হবে না, (অবস্থা বেগতিক দেখে) তারা তাদের শরীকদের অস্বীকার করবে’’।[10] অর্থাৎ তখন তারা মিছেমিছি বলবে: আমরা তাদেরকে আল্লাহর সাথে কখনও শরীক করিনি।
যারা ওলিদেরকে আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী মনে ক’রে তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে, আখেরাতে ওলিগণ সে-সব লোকদের শত্রুতে পরিণত হবেন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
﴿ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ ﴾ [الاحقاف: ٥]
‘‘সে ব্যক্তির চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে যে আল্লাহকে ব্যতীত এমন কাউকে আহ্বান করে যে কেয়ামত পর্যন্ত তার আহবানে সাড়া দেবে না? তাঁরা তো তাদের আহ্বান সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর। যখন মানুষদেরকে হাশরের দিন একত্রিত করা হবে, তখন তাঁরা তাদের শত্রু হবে এবং তাঁরা তাদের উপাসনাকে অস্বীকার করবে’’।[11]
সাধারণ মুশরিক ও মুসলিম মুশরিকরা আখেরাতে যে অবস্থায় হাজির হবে
সেদিন ইসলাম পূর্ব যুগের মুশরিক এবং ইসলাম পরবর্তী যুগের মুসলিম মুশরিক সকলেই আল্লাহর সমীপে তাদের সুপারিশকারীগণ ছাড়াই একাকী হাজির হবে, তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাদের এ অবস্থা দৃশ্যে মহান আল্লাহ্ বলবেন:
﴿ وَلَقَدۡ جِئۡتُمُونَا فُرَٰدَىٰ كَمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ أَوَّلَ مَرَّةٖ وَتَرَكۡتُم مَّا خَوَّلۡنَٰكُمۡ وَرَآءَ ظُهُورِكُمۡۖ وَمَا نَرَىٰ مَعَكُمۡ شُفَعَآءَكُمُ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُمۡ أَنَّهُمۡ فِيكُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْۚ لَقَد تَّقَطَّعَ بَيۡنَكُمۡ وَضَلَّ عَنكُم مَّا كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٩٤ ﴾ [الانعام: ٩٤]
‘‘তোমরা আমার কাছে এমনভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ যেমনভাবে আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা তোমরা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদেরকে দেখছি না, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে (আমার) অংশীদার। বাস্তবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে’’।[12]
সে দিন এমন যে, তাতে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্যে অন্য কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না।
যেমন আল্লাহ বলেন:
﴿ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ ﴾ [السجدة: ٤]
‘‘তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী নেই’’।[13]
এ-সব আয়াতসমূহ দ্বারা যে-সব বিষয়াদি প্রমাণিত হয় তা হলো নিম্নরূপ:
১. আখেরাতে শাফা‘আতের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাপার। সে দিন কেবল তিনি ব্যতীত মানুষের জন্য স্বেচ্ছা প্রনোদিত অপর কোনো বন্ধু বা সুপারিশকারী থাকবে না।
২. সে দিন একমাত্র রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ব্যতীত অন্যান্য সকল নবী ও ওলিগণ সাধারণ মানুষের ন্যায় নিজের পরিণতি নিয়েই উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করবেন। তাঁরা আল্লাহর শাস্তির ভয়ে আতঙ্কিত থাকবেন। আখেরাতে সৎমানুষ বা অলিগণের জন্য আল্লাহর অভয়বাণী থাকলেও তাদের জন্য জান্নাতের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তারা এ উৎকন্ঠার মধ্যেই সময় অতিবাহিত করবেন। সে-জন্য এ সময়ে তাঁদের পক্ষে অন্যের মুক্তির ব্যাপারে চিন্তা করারও কোনো অবকাশ থাকবে না।
২. সেদিন মুশরিক ও মু’মিন নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য তাদের ঈমান ও ‘আমল ব্যতীত অপর কোনো সাহায্যকারী, শাফা‘আতকারী ও বন্ধু থাকবে না।
৩. সে দিন কেউই আল্লাহর কাছে তার নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দিক বিবেচনা করে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তার নিজের বা অপর কারো কোনো বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না।
৪. সেদিন প্রত্যেক মানুষ নিজের কর্মের হিসেব প্রদানের জন্য আল্লাহর সম্মুখে একাকী হাজির হবে। কারো সাথে কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না।
৫. মুশরিকরা যে-সব মৃত সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের দেব-দেবী এবং জিনদেরকে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী ব’লে মনে করে তাদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো, আখেরাতে তারা তাঁদেরকে সুপারিশকারী হিসেবে পাবে না। এমনকি সে দিন তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো সম্পর্কও থাকবে না। অনুরূপভাবে ইসলাম পরবর্তী যুগে তথাকথিত অলি, গউছ ও কুতুব নামের যাদেরকে ইহকাল ও আখেরাতে সাধারণ মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশাকরী বলে মনে করে তাঁদেরকে সুপারিশের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে, আখেরাতে তাঁদেরকেও সুপারিশকারী হিসেবে পাওয়া যাবে না। বরং যারা তাঁদেরকে উক্ত ধারণার ভিত্তিতে সাহায্য ও সুপারিশের জন্য আহ্বান করছে, আখেরাতে তারা তাঁদের সুপারিশ পাওয়া তো দুরের কথা, তখন তাঁরা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবেন।
৬. যারা জান্নাতে যাওয়ার পর অন্যের জন্য সুপারিশের অনুমতি পাবেন, তাঁরা না জেনে কোনো মুশরিকদের জন্য সুপারিশ করলে তাদের সে সুপারিশ কারো কোনো উপকারে আসবে না।
কারা আখেরাতে শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন:
আখেরাতে কেবল তারাই শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা শাফা‘আতের অনুমতি প্রদান করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
﴿ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُ﴾ [سبا: ٢٣]
‘‘তাঁর কাছে কেবল তাদের সুপারিশই উপকারী হবে, যাদেরকে তিনি সুপারিশ করার জন্য অনুমতি দেবেন’’।[14] অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:
﴿ يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩ ﴾ [طه: ١٠٩]
‘‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, কেবল সে ব্যতীত সে দিন কারো সুপারিশ সেদিন কারো উপকারে আসবে না’’।[15]
আখেরাতে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন কুরআন ও হাদীসের বর্ণনানুযায়ী তাঁরা হলেন: রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-, মু’মিন, মু’মিনদের মৃত নাবালক শিশু, কুরআন, রোযা, জান্নাত, জাহান্নাম ও শহীদগণ। তবে সকলের শাফা‘আতের সময় এক নয়। বরং তাদের শাফা‘আত দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত।
শাফা‘আতের প্রথম পর্যায়: হাশরের ময়দানে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন:যারা হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ চলা কালীন সময়ে শাফা‘আত করবেন, বিভিন্ন হাদীসের বর্ণানানুযায়ী তারা হলেন নিম্নরূপ:
>[2].এ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:
﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ
بِشِرۡكِكُمۡۚ﴾ [فاطر: ١٤]
মৃত মানুষেরা উপকার করতে পারে এ ধারণার ভিত্তিতে তাদের নামে নির্মিত মূর্তিকে লক্ষ্য করে ‘‘তোমরা যদি তাদেরকে উপকারের জন্য আহবান কর, তা হলে তারা তোমাদের আহবান শ্র্রবণ করবে না, শুনলেও তারা তোমাদের আহবানে সাড়া দেবে না। (তাদেরকে আহবানজনিত কারণে তোমরা যে শির্ক করেছ) কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের সে শির্ককে অস্বীকার করবে’’। অর্থাৎ বলবে: আমরা তোমাদেরকে আমাদেরকে আহবানের কথা শিক্ষা দেই নি। এটি তোমাদের মনগড়া কাজ বৈ আর কিছুই নয়। আল-কুরআন, সূরা ফাত্বির :১৪।
[3]. আল-কুরআন, সূরা দুখান: ৩৯।
[4]. আল-কুরআন, সূরা হুদ: ১০৫।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আবাসা: ৩৭।
[6]. আল-কুরআন, সূরা বাকারা: ২৫৪।
[7]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম: ৫১।
[8] .আল-কুরআন, সূরা মুদ্দাসি্সর: ৪৮।
[9]. আল-কুরআন, সুরা আন’আম: ২২-২৫।
[10]. আল-কুরআন, সূরা রুম :১২।
[11]. আল-কুরআন, সূরা আহক্বাফ: ৫-৬।
[12]. আল-কুরআন, সূরা আনআম: ৯৪।
[13] . আল-কুরআন, সূরা সেজদা: ৪।
[14]. আল-কুরআন, সূরা সাবা: ২৩।
[15]. আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ১০৯।