শির্ক কী ও কেন? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
আল্লাহর উপর কারো কোনো অধিকার নেই

এ হাদীসটি সঠিক না হওয়ার প্রমাণ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে নবী-রাসূল ও ওলিগণ নির্বিশেষে আল্লাহর উপর কারো কোনো অধিকার বলতে কিছুই নেই। যারা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর গুণে গুণান্বিত হবেন, তাদেরকে মহান আল্লাহ যে পুরস্কার ও মর্যাদা দানের কথা বলেছেন, তা তাদের ঈমান ও ‘আমলের কারণে এমনিতেই আল্লাহর উপর তাদের জন্যে ওয়াজিব হয়ে যায় নি। বরং তা তাদের প্রতি তাঁর একান্ত কৃপা বিশেষ। তিনি অনুগ্রহ করে তাদের জন্য কিছু অধিকারের স্বীকৃতি দান করেছেন। তবে তা এমন কোনো অধিকার নয় যে, তা আল্লাহর নিকট থেকে দাবী করে আদায় করে নেয়া হবে বা এর ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যাবে। এ-ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সাধারণ মানুষ বলে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহর উপর মানুষের কোনো অধিকারের অস্বীকৃতি জানিয়ে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন:

«...لَنْ يُدْخِلَ أَحَدُ الْجَنَّةَ عَمَلُهُ . فَقِيْلَ لَهُ : وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ فَقَالَ : وَ لاَ أَنَا ، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللهُ بِرَحْمَتِه»

‘‘...কস্মিনকালেও কাউকে তার সৎ কর্ম জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। তাঁকে বলা হলো: হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কি পারবেন না ? তিনি বলেন: আল্লাহর রহমত দ্বারা তিনি আমাকে বেষ্টন না করলে আমিও পারবো না’’।[1] আল্লাহর উপর যেখানে মানুষের কোনো অধিকারই স্বীকৃত নয়, সেখানে আবার কী করে আল্লাহর কাছে সে অধিকারের ওসীলায় কিছু চাওয়া যেতে পারে? এ-জন্যই ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেছেন:

[لا ينبغي لأحد أن يدعو الله إلا به، و الدعاء المأذون فيه المأمور به، ما استفيد من قوله تعالى: ولله الأسماء الحسنى فادعوه بها.]

‘‘ কারো পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে কেবল তাঁরই নামের ওসীলা ব্যতীত এবং ‘‘আল্লাহর রয়েছে উত্তম নামাবলী, অতএব তাঁকে সে নামের ওসীলায়ই আহ্বান কর’’ এ আয়াত থেকে যে-সব নামাবলীর ওসীলায় তাঁকে আহবানের অনুমতি ও নির্দেশ পাওয়া যায়, সে-সব নামাবলীর ওসীলা ব্যতীত অপর কারো নামের ওসীলায় আহ্বান করা উচিত নয়’’।[2] তিনি আরো বলেন:

(أكره أن يقول أحد في دعائه اللهم إني أسالك بحق خلقك)

‘‘হে আল্লাহ ! আমি তোমার সৃষ্টির অধিকারের ওসীলায় তোমার কাছে সাওয়াল করছি’ কেউ তার দো‘আর মধ্যে এমন কথা বলাকে আমি অপছন্দ তথা না জায়েয[3] মনে করি’’।[4]

আল্লামা ইবনু আবীল ‘ইয্য আল-হানাফী (রহ.) এ-জাতীয় ওসীলা করার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের উপর যে অধিকারের কথা স্বীকার করেছেন, তা ব্যতীত আল্লাহর উপর কারো কোনো অধিকার নেই। ... আল্লাহর উপর আমাদের যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রদানের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন মানুষের অধিকার অপর মানুষের উপর যে-ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, কোনো মানুষ সে-ভাবে আল্লাহর উপর নিজ থেকে কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না।’’[5]

তিনি আরো বলেন:‘‘কারো অধিকারের ওসীলায় দো‘আ করা আর দো‘আকারী ব্যক্তির দো‘আ কবুল করার মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। যে এরকম দো‘আ করে সে যেন প্রকারান্তরে এমন কথা বলে: হে আল্লাহ! অমুক আপনার সৎ বান্দাদের মধ্যে হওয়ার কারণে আমার দো‘আ কবুল কর। (আপনার অমুক সৎ বান্দা আর আমার দো‘আ কবুল কর) এ দু’টি কথার মধ্যে কী সম্পর্ক ও বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে ? বরং এ-জাতীয় কথা দো‘আর মধ্যে বলা এক ধরনের সীমালঙ্ঘন বৈ আর কিছুই নয়’’।[6]

ইমাম আবু ইউছুফ (রহ.) বলেন: ‘‘কেউ তার দো‘আর মধ্যে ‘হে আল্লাহ ! আমি অমুকের অধিকার অথবা তোমার নবী ও রাসূলদের অধিকারের ওসীলায় তোমার নিকট চাচ্ছি’ এমনটি বলাকে আমি অপছন্দ করি’’।[7]

উক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বা অপর কারো অধিকারের ওসীলায় দো‘আ করা আমাদের হানাফী মাযহাবে বৈধ নয়।

ষষ্ঠ দলীল:

ওসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণের জন্য তারা লোকমুখে বহুল প্রচলিত একটি হাদীস দ্বারা দলীল দিয়ে থাকেন। হাদীসটি নিম্নরূপ:আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

«لَوْلاَكَ لَمَا خَلَقْتُ الأَفْلاَكَ»

‘‘হে মুহাম্মদ! তুমি না হলে অমি জগত সৃষ্টি করতাম না’’।

তাদের মতে আল্লাহ তা‘আলা যদি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায় এ-জগত সৃষ্টি করে থাকেন। তা হলে আমাদের পক্ষে তাঁর ওসীলা গ্রহণ করা অবৈধ হতে পারে না।

এ দলীলের খণ্ডন:

এ হাদীসটি লোকমুখে বহুল প্রচলিত হয়ে থাকলেও মূলত এটি কোনো হাদীস নয়। ইমাম সাগানী এটিকে মাওদু‘ হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন।[8] এ হাদীসের অর্থ [لَوْلاَكَ لَمَا خَلَقْتُ الدُّنْيَا] ‘‘তুমি না হলে আমি এ-দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না’’-এ মর্মে বর্ণিত হাদীস দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করলেও ইমাম ইবনুল জাওযী ও ইমাম সুয়ূতী এ হাদীসকেও মাওদু‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[9]

এ দু’টি হাদীস সহীহ হলেও এর দ্বারা আমাদের পক্ষে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামের ওসীলা গ্রহণ করে দো‘আ করা বৈধ হবে না। কেননা, আল্লাহর জন্য কোনো কাজ বৈধ হয়ে থাকলেও আমাদের জন্য তা বৈধ হতে হলে তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ ব্যতীত তা আপনা আপনি বৈধ হয়ে যায় না। তিনি তাঁর উত্তম নামাবলীর ওসীলা গ্রহণ করে আমাদেরকে দো‘আ করতে আদেশ করার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁর নাম ব্যতীত অপর কারো নামের ওসীলায় তাঁর কাছে দো‘আ করা বৈধ নয়।
সপ্তম দলীল:

উমাইয়্যাঃ ইবন ‘আব্দুল্লাহ নামক তাবেঈ থেকে একটি মুরসাল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-অভাবী মুহাজিরদের ওসীলায় যুদ্ধে জয় কামনা করতেন’’।[10] এ হাদীসেও মুহাজিরদের দো‘আর কথা বর্ণিত হয় নি। যার ফলে রাসূল ও নেক মানুষদের নাম, জাতসত্তা ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করা বৈধ বলে দাবীদারগণ এ হাদীস দ্বারাও দলীল দিয়ে থাকেন।

এ দলীলের খণ্ডন:

এ হাদীসটি মুরসাল হয়ে থাকলেও সনদের দিক থেকে সর্ব সম্মতভাবে তা সহীহ। কিন্তু এর দ্বারাও কারো নাম, জাতসত্তা, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণ করা যায় না। কেননা; এ হাদীস দ্বারা মূলত নিঃস্ব মুহাজিরদের জাত ও নামের ওসীলায় দো‘আ করার কথা উদ্দেশ্য করা হয় নি। বরং তাতে তাঁদের দো‘আর ওসীলায় দো‘আ করার কথাই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। বিশিষ্ট মনীষীদের বক্তব্যের দ্বারা এ সত্যই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন শেখ মানাবী জামি‘উস সগীর গ্রন্থে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:

‘‘মুসলিমদের মধ্যকার ফকীরদের দ্বারা বরকত অর্জন করে তাঁদের দো‘আর ওসীলায় রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বিজয় কামনা করেছিলেন। তাঁদের মানসিক বিপর্যয় সাধিত হওয়ার কারণে তাঁদের দো‘আ অধিক গৃহীত হওয়ার আশায় তাঁদের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেছিলেন। মুল্লা ‘আলী আল-ক্কারী আল-হানাফী (রহ.) বলেন: ‘‘সম্ভবত মুহাজিরদেরকে নির্দিষ্ট করার কারণ হচ্ছে-তাঁরা ছিলেন গরীব, মজলূম, নিপীড়িত ও মুজাহিদ;ফলে তাঁদের দো‘আর প্রভাব অন্যান্য সাধারণ মু’মিন ও ধনীদের দো‘আর চেয়ে অধিক হতে পারে ভেবে তাঁদের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেছিলেন’’।[11]

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদা, হক ও জাতের ওসীলা গ্রহণ করা বৈধ বলে যারা দাবী করেন তারা উক্ত দলীলসমূহ ছাড়াও আরো কিছু অপ্রচলিত হাদীস বা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ দ্বারাও তা বৈধ বলে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। যেমন একটি ঘটনার বর্ণনায় রয়েছে: একদা উম্মে আয়মান রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশ্রাব পান করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তাঁকে বলেছিলেন:

‘‘আজকের পরে তোমার কখনও পেটের পীড়া হবেনা’’।[12]

অনুরূপভাবে অপর এক ঘটনায় রয়েছে যে, মালিক ইবনে সিনান রাদিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত পান করেছিলেন। এতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন:

‘‘আমার রক্ত যার রক্তকে স্পর্শ করেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না’’।[13]

উম্মে আয়মান এর ঘটনাটির বর্ণনা কোনো হাদীস গ্রন্থে নেই। ইবনে কাছীর স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে ইমাম আবু ইয়া‘লা এর মুসনাদের বরাত দিয়ে এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেও তিনি তা সহীহ না দুর্বল-এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেন নি। যদি এটিকে একটি বিশুদ্ধ বর্ণনা হিসেবেও ধরে নেয়া হয়, তবুও এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামের ওসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণ করা যাবে না। কেননা, ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, তিনি পিপাসার তাড়নায় এমনটি করেছিলেন। এর দ্বারা বরকত গ্রহণ করে বিভিন্ন অসুখের হাত থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে তা পান করেন নি।

তিনি যদি এ কারণে পেটের পীড়া থেকে রক্ষা পেয়েও থাকেন, তবে তা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দো‘আর বরকতে হয়ে থাকবে, তাঁর প্রশ্রাব পান করার কারণে নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশ্রাব পান করা যদি জায়েয হতো, এর দ্বারা যদি বরকত গ্রহণ করা জায়েয হতো, তা হলে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ তাঁর অযুর অবশিষ্ট পানি, শরীরের ঘাম ও থুথু দ্বারা যেমন বরকত গ্রহণ করতেন, তেমনি তাঁর প্রশ্রাব দ্বারাও বরকত গ্রহণ করতেন। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ নেই। কাজেই প্রমাণিত হয় যে, এ ঘটনার দ্বারা রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নাম ও জাতের ওসীলা গ্রহণ করার বৈধতা প্রমাণ করা যায় না।

আর মালিক ইবনে সিনান রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনাটি ইবনে কাছীর ইবনে হেশাম থেকে বর্ণনা করলেও এ বর্ণনাটি বিশুদ্ধ কি না, তিনি তা উল্লেখ করেন নি। তিনি বরং এর পাশাপাশি অপর একটি ‘মুরসাল’ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদেম সালিম রাদিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত পান করেছিলেন।[14]

এ বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, মালিক ইবনে সিনান এর রক্ত পান সংক্রান্ত বর্ণনাটি সঠিক নয়। ঘটনা যদি সঠিকও হয়, তবুও এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম, জাতসত্তা, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলা গ্রহণের বৈধতা প্রমাণ করা যাবে না। কেননা, মালিক ইবন সেনান রাদিয়াল্লাহু আনহু তো রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বারা ওসীলা গ্রহণের জন্য তাঁর রক্ত পান করেন নি। বরং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা এবং তাঁর রক্তের দ্বারা বরকত গ্রহণের উদ্দেশ্যেই তিনি তা পান করেছিলেন। আর এ-কারণেই রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তাঁর জন্য এ দো‘আ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর তিরোধানের পর তাঁর শরীরের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু দিয়ে বরকত গ্রহণ বৈধ হওয়া আর তাঁর নাম ও মর্যাদা বা অধিকার দিয়ে ওসীলা করা কোনভাবেই এক জিনিস নয়। যারা এটিকে এক ভাবেন তারা যে ভুলের মধ্যেই রয়েছেন-তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ-ছাড়াও তারা আরো কিছু মিথ্যা হাদীস দ্বারা তা প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। বর্ণনা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার কারণে তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।

সারকথা:এ দীর্ঘ আলোচনার দ্বারা এ-কথা প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ এ জগতের কোনো নবী বা ওলিকে তাঁর ও তাঁর বান্দাদের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য নির্ধারণ করেননি। এটি সাধারণ মানুষের মাঝে শয়তানের দেয়া একটি ভ্রান্ত ধারণা বৈ আর কিছুই নয়। শয়তান এ ভ্রান্ত চিন্তাধারাটিকে যেমন জাহেলী যুগের মুশরিকদের মধ্যে চালিয়ে দিয়েছিল, তেমনি তা ইসলাম পরবর্তী যুগের বহু মুসলিমদের মধ্যেও চালিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। মহান আল্লাহ অতীব দয়াবান। তিনি তাঁর বান্দাদের অপরাধ মার্জনা করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা তাদের যাবতীয় সমস্যার কথা তাঁর সমীপে নিজেরাই সরাসরি উপস্থাপন করতে পারে।

এ জন্য মৃত বা জীবিত কোনো নবী বা ওলিদের মধ্যস্থা গ্রহণের কোনই বাধ্যবাধকতা নেই। কেননা, সৎ ও অসৎ নির্বিশেষে সকলের জন্যেই তাঁর রহমতের দরজা সমানভাবে উন্মুক্ত। তারা তাদের মনের কথা তাঁর নিকট কোনো ওসীলা ছাড়াই বলতে পারে। তবে যেহেতু আল্লাহর নিকট কিছু চাওয়ার পূর্বে কোনো সৎ কর্মের ওসীলায় চাওয়া তাঁর নিকট কিছু চাওয়ার আদাবের অন্তর্গত, সে-জন্যে তাঁরা তাঁর (আল্লাহর) নামের ওসীলায় বা ওসীলার অন্যান্য যে-সব বৈধ পন্থা রয়েছে, সে-সবের ওসীলায় তা চাইতে পারে।

জীবিত সৎ মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ বৈধ ওসীলার একটি প্রকার হয়ে থাকলেও মৃত সৎ মানুষের নাম ও মর্যাদার ওসীলা গ্রহণ করার কোনই বৈধতা নেই। কেননা, এটি কোনো সৎকর্ম নয়। বরং এটি আল্লাহর নামের ওসীলা গ্রহণের পরিবর্তে তাঁর সৃষ্টির নামের ওসীলা গ্রহণের শামিল। এ জাতীয় ওসীলাকারীর মনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা শির্কের মত জঘন্য অপরাধে পরিণত হতে পারে। সর্বোপরি এ জাতীয় ওসীলার চিন্তাধারা শয়তান কর্তৃক মুসলিম সমাজে প্রচলিত হওয়ায় এমন ওসীলা গ্রহণ করা থেকে আখেরাতে মুক্তি পাগল মুসলিমদের সতর্ক থাকা আবশ্যক।

>
[1]. সহীহুল বুখারী; কিতাবুর রিক্বাক, বাব: [ باب القصد و المداومة على العلمসর্বদা জ্ঞানার্জনে লেগে থাকা), ৪/৩/১৭৭।

[2]. শেখ নাসিরুদ্দীন আল-বাণী, আত্তাওয়াস সুলু আনওয়াউহু ওয়া আহকামুহু; পৃ.৫১। শেখ আলবানী একথাটি ‘দুররুল মুকতার’ গ্রন্থের (২/৬৩০) এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন।

[3]. সালাফে সালেহীন অপছন্দ বলে নাজায়েয বুঝাতেন। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ই‘লামুল মুওয়াক্কে‘য়ীন, নামক গ্রন্থে বিস্তারিত দলীল প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন। [সম্পাদক]

[4]. তদেব।

[5]. তিনি বলেন:

" ... وليس لأحد على الله حق إلا ما أحقه على نفسه، كقوله تعالى: (وكان حقا علينا نصر المؤمنين) سورة الروم: 47،... فهذا حق وجب بكلماته التامة ووعده الصادق، لا أن العبد نفسه مستحق على الله شيئا كما يكون للمخلوق على المخلوق ..."

দেখুন: ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৬১।

[6]. তিনি বলেন:

" قوله بحق فلان (فإن فلانا و إن كان له حق على الله بوعده الصادق) فلا مناسبة بين ذلك و بين إجابة دعاء هذا السائل ، فكأنه يقول : لكون فلان من عبادك الصالحين أجب دعائي، و أي مناسبة في هذا و أي ملازمة ؟ و إنما هذا من الاعتداء في الدعاء."

দেখুন: তদেব; পৃ. ২৬২।

[7]. তিনি বলেন,

(إني أكره أن يقول أحد في دعائه : اللهم إني أسألك بحق فلان أو بحق أنبيائك و رسلك)

নাসিরুদ্দীন আলবানী, আত্তাওয়াস সুলু আনওয়াউহু ওয়া আহকামুহু; পৃ.৫১।। ইমাম কারখী হানাফী কর্তৃক লিখিত ‘ক্বুদূরী’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা এর ‘কারাহাত’ অধ্যায় থেকে একথাটি তিনি বর্ণনা করেছেন।

[8]. আস-সুয়ূতী, আল-লাআলী উল মাসনূ‘আতু ফীল আহাদীসিল মাওদু‘আঃ; ১/২৭২; শায়খ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আল-বানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিদ দয়ীফাতি ওয়াল মাওদু‘আঃ; পৃ.১/২৯৯।

[9]. আস্সুয়ূতী, প্রাগুক্ত; ১/২৭২; শায়খ মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আল-বানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিদ দয়ীফাতি ওয়াল মাওদু‘আঃ;১/২৯৯।

[10] . তাতে এসেছে,

عن أمية بن عبد الله بن خالد بن أسيد قال ثم كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يستفتح بصعاليك المهاجرين

আত-ত্ববরানী, সুলায়মান ইবন আহমদ, আল-মু‘জামুল কবীর; (মুসেল:মাকতাবাতুল উলূম ওয়াল হিকাম, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), ১/২৯২।

[11] .قال المناوي في شرح الجامع الصغير قوله يستنصر بصعاليك المسلمين أي يطلب النصر بدعاء فقرائهم تيمنا بهم ولأنهم لانكسار خواطرهم دعاءهم أقرب إجابة ورواه في شرح السنة بلفظ كان يستفتح بصعاليك المهاجرين قال القاري أي بفقرائهم وببركة دعائهم ... ولعل وجه التقييد بالمهاجرين لأنهم فقراء غرباء مظلومون مجتهدون مجاهدون فيرجى تأثير دعائهم أكثر من عوام المؤمنين وأغنيائهم. انتهى দেখুন: আব্দুররহমান আল-মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; ৫/ ২৯১।

[12]. ইবনে কাছীর, আলবেদায়াতু ওয়ান নেহায়াঃ; ২/২/২৭৩।

[13]. ইবনে হেশাম, প্রাগুক্ত;১/৮০।

[14]. ইবনে কাছীর, আলবেদায়াতু ওয়ান নেহায়াঃ ২/৪/২৪।