লগইন করুন
একটি কবর বা একটি স্থানের ব্যাপারে যদি জনমনে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এখানে গেলে বরকত বা ফয়েয হাসিল হয় এবং সেখানে গেলে লোকজনের বিভিন্ন রকমের মনস্কামনা পূর্ণ হয় এবং লোকজন সুযোগমত সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে বরকত ও ফয়েয হাসিল এবং মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য প্রতি দিন, সপ্তাহে, মাসে, ছয়মাসে বা বছরের নির্দিষ্ট কোন দিনে সমবেত হয় এবং সে কবর বা স্থানের উদ্দেশ্যে টাকা-পয়সা মানত করে, গরু, ছাগল ও মুরগী ইত্যাদি নিয়ে এসে সেখানে উৎসর্গ করে, তা হলে এতে সে কবর বা সে স্থান মেলার স্থান ও প্রতিমায় পরিণত হবে কেননা; এ জাতীয় কর্মসমূহ জাহেলী যুগের মানুষেরা বিভিন্ন অলিদের নামে নির্মিত দেবতা ও প্রতিমাদের উদ্দেশ্যেকৃত কর্মেরই ধারাবাহিকতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরকে যাতে কেউ এ রকম মেলার স্থান ও প্রতিমায় পরিণত না করে সে জন্য তিনি আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। যা আমরা একটু আগেই অবগত হয়েছি।
ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (৬৬১-৭২৮হিঃ) ঈদ(عيد) শব্দের অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘ঈদ হলো সে সব সাধারণ সমাবেশের নাম যা প্রথা ও রেওয়াযানুযায়ী বছর, সপ্তাহ বা মাস ইত্যাদি ঘুরে আসলে ঘুরে আসে। ঈদ কয়েকটি বিষয়ের সমষ্টির নাম :
এক. তা এমন এক দিনে হয় যা ঘুরে আসে। যেমন- ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও জুমু‘আর দিন।
দুই. সে দিনে সমবেত হওয়া।
তিন. সে দিনে সমবেত হয়ে উপাসনা ও প্রথাগত কিছু কর্ম করা।
ঈদ কখনও নির্দিষ্ট কোনো স্থানে হয়, কখনও তা অনির্দিষ্ট থাকে। উপরে বর্ণিত এ তিনটি বিষয়ের প্রতিটি বিষয়কেও ঈদ নামকরণ করা যেতে পারে। সে অনুযায়ী একটি সময়কেও ঈদ বলা যেতে পারে। যেমন- জুমু‘আর দিনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«إِنَّ هٰذَا يَوْمٌ قَدْ جَعَلَهُ اللهُ لِلْمُسْلِمِيْنَ عِيْداً»
‘‘জুমু‘আর দিনটি এমন একটি দিন যাকে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।’’[1]
অনুরূপভাবে কোন স্থানকেও ঈদ বলা যেতে পারে। যেমন- রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেছেন :
«لاَ تجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْداً»
‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদগাহে পরিণত করোনা।’’[2]
কখনও একটি দিন এবং সে দিনে যে অনুষ্ঠান করা হয়, এ দু’য়ের সমষ্টির নামও ঈদ হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঈদ শব্দ দ্বারা এটাই বুঝানোর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। যেমন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে ঈদের দিনে ঢোল বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করা প্রসঙ্গে বলেন:
«إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْداً وَهَذَا عِيْدُنَا»
‘‘হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্য ঈদ রয়েছে, আর এটি হলো আমাদের ঈদ।’’[3]
মেলা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনু কাইয়্যিম (৬৯১-৭৫১হি:) বলেন : ‘‘যা প্রথাগতভাবে ঘুরে আসে এবং যে সময় আগমনের অপেক্ষা করা হয় এবং যে স্থানে গমনের ইচছা করা হয়, তাকে ঈদ বলা হয়। ঈদ (عيد) শব্দটিকে معاودة ফিরে আসা ও (اعتياد) ‘প্রথা স্বরূপ গ্রহণ করা’ শব্দমূল থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ঈদ যখন কোনো স্থান কেন্দ্রিক হবে তখন এর দ্বারা সে স্থানই বুঝতে হবে যে স্থানকে সমবেত হওয়া ও উপাসনার জন্য উদ্দেশ্য করা হয়। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা মসজিদুল হারাম (কা‘বা শরীফ), মিনা, মুযদালিফাঃ, আরাফাঃ ও নিদর্শনের স্থানসমূহকে তাওহীদপন্থীদের জন্য ঈদ ও পুণ্যার্জনের স্থান হিসেবে গণ্য করেছেন। অতীতে মুশরিকদের সময় ও স্থান কেন্দ্রিক অনেক ঈদ ছিল। ইসলাম আগমন করে তাদের সময় কেন্দ্রিক ঈদসমূহ বাতিল ঘোষণা করে এর পরিবর্তে মুসলিমদের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এবং মিনা এর দিনসমূহকে ঈদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনুরূপভাবে মুশরিকদের ঈদের স্থানসমূহের পরিবর্তে কা‘বা শরীফ, মিনা, মুযদালিফা, আরাফা ও নিদর্শনের স্থানসমূহকে ঈদ পালনের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছে।’’[4]
উপর্যুক্ত এ আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল যে, ইসলাম সাধারণ মুসলিমদের জন্য সময় কেন্দ্রিক যে সব ঈদ নির্ধারণ করেছে তা হলো: জুমু‘আর দিন, ঈদুলফিতর ও ঈদুলআযহা এবং আইয়্যামে তাশরীকের চার দিন। এ-দিনসমূহ ব্যতীত সপ্তাহান্তে ও বছরান্তে সমবেত হওয়ার জন্য মুসলিমদের সময় কেন্দ্রিক আর কোনো ঈদ নেই। এ সব দিনসমূহ হচ্ছে তাদের জন্য ঈদ পালনের দ্বীন নির্দেশিত দিবস। এ সকল দিবস ব্যতীত অপর কোনো দিবসকে কারো জন্ম দিবস হিসেবে আনন্দ প্রকাশের জন্য বা কারো মৃত্যু দিবস হিসেবে দুঃখ প্রকাশের জন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঈদ নামকরণ করা যাবে না এবং এটাকে কোনো ধর্মীয় কাজ মনে করে তাতে সমবেত হওয়াও যাবে না।
যদিও সে দিবসটি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম দিবসও হয়ে থাকতে পারে।অনুরূপভাবে আমরা আরো অবগত হলাম যে, মুসলিমদের জন্য কা‘বা শরীফ, মিনা, মুযদালিফাঃ ও এর আশেপাশের নিদর্শনের (مشاعر) স্থানসমূহ ও ঈদের মাঠ ব্যতীত দ্বীন নির্দেশিত স্থান কেন্দ্রিক অপর কোনো ঈদ পালনের স্থান নেই। এ সকল স্থানের মধ্যে কা‘বা শরীফে আমরা সকলেই সব সময় পুণ্যার্জনের জন্য সমবেত হতে পারবো। অবশিষ্ট স্থানসমূহে হাজীগণ কেবল হজ্জের সময়ে পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে দূর ও নিকট থেকে সমবেত হতে পারবেন। কা‘বা শরীফের পাদদেশে আমরা বছরের প্রত্যেক দিনে এবং হাজীগণ আরাফার ময়দানে জিলহজ্জ মাসের নবম দিনে, মুযদালিফায় জিলহজ্জ মাসের নবম দিনের দিবাগত রাতে, মিনায় জিলহজ্জ মাসের অষ্টম, দশম, এগারো, বারো ও তেরো তারিখসমূহে এবংমাশায়ের (مشاعر) অর্থাৎ যে সকল নিদর্শনের স্থানসমূহে হাজীগণ হজ্জের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালনার্থে অবস্থান গ্রহণ করেন, সেখানেও হজ্জের সময় তারা ধর্মীয় কাজ হিসেবে পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে সমবেত হতে পারবেন।
হজ্জের সময় ব্যতীত একমাত্র কা‘বা শরীফ ছাড়া উপর্যুক্ত এ সব স্থানসমূহে পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে আগমনের ধর্মীয় কোনো গুরুত্ব নেই। অবশ্য আমরা ইতোপূর্বে বর্ণনা করে এসেছি যে, কা‘বা শরীফসহ মসজিদে নববী এবং বায়তুল মাকদিস এ তিনটি মসজিদে পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে আগমন করার ব্যাপারে শরী‘আতের অনুমোদন রয়েছে। সুতরাং এ তিন মসজিদেই কেবল আমরা দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যার্জনের উদ্দেশ্যে সফর করে এসে সমবেত হতে পারবো। অন্য কোনো মসজিদ বা স্থানে নয়। এবার যদি আমরা উপর্যুক্ত সময় ও স্থানসমূহের সাথে অপর কোনো সময় ও স্থানকে সংযোজন করি, তবে তা যেমন দ্বীনীভাবে কোনো ছাড়পত্র পাবে না, তেমনি তা কোন পুণ্যার্জনের কাজ বলেও বিবেচ্য হবে না। বরং দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে তা একেকটি বেদ‘আতী কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কেননা; উপর্যুক্ত সময় ও স্থান ব্যতীত মুসলিমদের জন্য দ্বীন নির্দেশিত অপর কোনো ঈদ পালন ও সফর করার স্থান নেই।
কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অপর কোনো অলি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মাযারে তাঁদের জন্ম বা মৃত্যু দিবসে সমবেত হয়ে সেখানে আনন্দ প্রকাশ করে, বা ওরস পালন করে, তা হলে এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও তাঁদের জন্ম দিবসকে ঈদের দিন এবং তাঁর ও তাঁদের কবরকে ঈদ পালনের স্থানে পরিণত করার শামিল হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁদের জন্ম দিবস আমাদের জন্য আনন্দের দিবস হয়ে থাকলেও তাঁদের জন্ম দিনকে ঈদের দিন বলে নামকরণ করে সেদিনে তাঁদের কবরে বা অন্যত্র কোথাও ঈদ পালন করার কোনো বৈধতা শরী‘আতে স্বীকৃত নয় কেননা; এমনটি করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে জাহেলী যুগের মুশরিকদের সে সব ঈদ পালনেরই ধারাবাহিকতা যা তারা তাদের দেব-দেবীদেরকে কেন্দ্র করে পালন করতো।
>[2].টীকা নং ১৬৪ দ্রষ্টাব্য।
[3]. ইবন মাজাহ, প্রাগুক্ত; কিতাবুন নিকাহ, বাব : আল-গেনা-ই ওয়াদ দফফি; ১/৬১২; ইবন তাইমিয়্যাহ, আহমদ, একতিদাউস সিরাতিল মুস্তাক্বীম, তাহকীক : হামিদ আল-ফকী, (বৈরুত : দারুল মা‘রিফাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ১৮৯-১৯০।
[4]. শেখ আব্দুর রহমান ইবন হাসান আ-লুশ শায়খ, ফাতহুল মাজীদ বি শারহি কিতাবিত তাওহীদ; (লাহুর : আনসারুস সুন্নাতিল মুহাম্মদিয়্যাঃ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ২৫৭।