লগইন করুন
যুবকের হৃদয়-মনে আগত জটিল সমস্যাবলীর মধ্যে আল্লাহর লিখিত নিয়তি বা ভাগ্যের ব্যাপারে বিহুলতা ও বিমুঢ়তা অন্যতম। যেহেতু তকদীরের ভালো-মন্দের উপর ঈমান ঈমানের এক রুকন। যার উপর বিশ্বাস ব্যতীত কোন মু'মিনের ঈমান পূর্ণ হতে পারে না। (বরং তা অস্বীকার করলে কাফের হতে হয়।) (মিশকাত ১০৪নং দ্রঃ)
তকদীরে বিশ্বাস রাখার মানে এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, আল্লাহ তাআলা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু হবে তা জানেন এবং সে সবের তিনি নিয়ন্তা। যেমন তিনি বলেন, “তুমি কি জান না যে, আকাশ-পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে আল্লাহ তা অবগত আছেন? এ সবই এক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। এ আল্লাহর নিকট সহজ।” (সূরা হজ ৭০ আয়াত)
নবী করীম তকদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ করতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসুল (সা.) (বাড়ি হতে) বের হয়ে আমাদের নিকট এলেন। তখন আমরা তকদীর নিয়ে বিতর্ক করছিলাম। তা শুনে তিনি এমন রুষ্ট হলেন যে, তার মুখমণ্ডল বেদানার দানার মত লাল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “তোমরা কি এই করতে আদিষ্ট হয়েছ? কিংবা আমি কি এরই জন্য তোমাদের মাঝে প্রেরিত হয়েছি? তোমাদের পূর্ববর্তীগণ তখনই ধ্বংস হয়েছিল, যখন তারা এই বিষয়ে বিতর্ক করেছিল। আমি তোমাদের উপর কসম করছি যে, এ বিষয়ে তোমরা তর্ক করো না।” (তিরমিযী, মিশকাত ৯৮নং)
তকদীর বিষয়ে তর্কালোচনা করা, তার রহস্যের দ্বার উদঘাটন করার বৃথা চেষ্টা করা এবং তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার ফলে মানুষ এমন গোলকধাঁধায় পড়ে যায় যে, সেখান হতে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অবশ্য নিরাপদের পথ এই যে, তুমি সৎকার্যের অভিলাষী ও প্রয়াসী হবে এবং যে কাজ করতে তুমি আদিষ্ট হয়েছ, তা যথাসাধ্য পালন করতে সচেষ্ট হবে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা তোমাকে জ্ঞান ও বোধশক্তি দান করেছেন, তোমার পথ-প্রদর্শনের জন্য, আম্বিয়া প্রেরণ করেছেন এবং তাদের উপর তার পবিত্র গ্রন্থাবলী অবতীর্ণ করেছেন, “যাতে রসূল (আসার) পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা ১৬৫ আয়াত)
পক্ষান্তরে মহানবী (সা.) যখন সাহাবাকে এ কথা বর্ণনা করেন যে, “প্রত্যেক মানুষেরই বাসস্থান জান্নাত অথবা জাহান্নাম নির্ধারিত ও লিখিত হয়ে আছে।” তখন তারা বললেন, হে আল্লাহর রসূল! তাহলে আমরা আমাদের লিখিত (নিয়তির) উপর নির্ভর করে আমল ত্যাগ করব না কি? উত্তরে তিনি বললেন, “তোমরা আমল কর, যেহেতু প্রত্যেকেই যার জন্য সৃষ্ট হয়েছে তার প্রতি তাকে সহজ-পটু করা হবে।”
অতএব যে ব্যক্তি সৌভাগ্যবান হবে তার পক্ষে সৌভাগ্যবানদের আমল সহজ করা হবে এবং যে ব্যক্তি দুর্ভাগ্যবান হবে তার পক্ষে দুর্ভাগ্যবানদের আমল সহজ করে দেওয়া হবে। অতঃপর রসূল ম%ি এই আয়াত পাঠ করলেন, “সুতরাং যে দান করবে, পরহেযগার হবে এবং উত্তম (অর্থাৎ, কলেমা লা ইলাহা। ইল্লাল্লাহ’কে) সত্য জানবে, আমি তার জন্য সুখদ পরিণামের পথ সহজ করে দিব। আর যে ব্যয়কুণ্ঠ হবে, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করবে এবং উত্তম (অর্থাৎ, কলেমা)কে মিথ্যা জানবে, আমি তার জন্য কঠোর পরিণামের পথ সহজ করে দিব।” (সূরা লাইল ৫-১০ আয়াত) (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮নং)
সুতরাং মহানবী ও তাদেরকে আমল বা কর্ম করে যেতে আদেশ করলেন এবং ভাগ্যের লিখনের উপর নির্ভর ও ভরসা করাকে বৈধ করলেন না। যেহেতু জান্নাতী’ বলে লিখিত ব্যক্তি তখনই জান্নাতী হবে, যখন সে জান্নাতবাসীর আমল করবে এবং জাহান্নামী’ বলে লিখিত ব্যক্তি তখনই জাহান্নামী হবে, যখন সে জাহান্নামবাসীর আমল করবে। আর আমল মানুষের নিজস্ব সামর্থ্য ও ইচ্ছা অনুসারে হয়ে থাকে। যেহেতু সে নিজের ব্যাপারে জানে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমল করার এখতিয়ার ও শক্তি দিয়েছেন। যে দুয়ের দ্বারা সে যে কোন আমল করতে ইচ্ছা করলে করতে পারে, নচেৎ ত্যাগ করতে পারে।
যেমন মানুষ সফরের জন্য মনস্থ করে ও তারপর সফর করে। ঘরে থাকার সংকল্প করে ঘরে থাকে। কাছে আগুন দেখলে পলায়ন করে, কোন প্রিয় বস্তু দেখলে তার প্রতি অগ্রসর হয় ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আনুগত্য ও অবাধ্যাচরণ মানুষ নিজের এখতিয়ারেই করে এবং নিজের এখতিয়ারেই বর্জন করে; আল্লাহ তাকে কোন কাজেই বাধ্য করেন না। তকদীরের ব্যাপারে কিছু মানুষের মনে সাধারণতঃ দু’টি জটিলতা দেখা যায়ঃ১- মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে, সে যা করে তা নিজের এখতিয়ারে করে, যা করে না তা নিজের এখতিয়ারেই করে না এবং তাকে কোন কাজ করতে বা ছাড়তে মজবুর ও বাধ্য করা হয় না, তাহলে এই বিশ্বাস এবং ঈমানের ঐ বিশ্বাসের মাঝে মিল বা সামঞ্জস্য থাকে কি করে, যেখানে বলা ও মানা হয়েছে যে, প্রত্যেক বস্তুই আল্লাহর নির্ধারিত নিয়তি লিখা অনুপাতে ঘটে থাকে?
এর জবাবে বলা যায় যে, আমরা যদি বান্দার আমল ও আচরণের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারি যে, তা দুটি জিনিসের ফলে সম্পন্ন হয়ে থাকে; ইচ্ছা, অর্থাৎ কিছু করার এখতিয়ার এবং সামর্থ। যদি এই দুটি জিনিস না থাকত তাহলে কোন কর্মই সম্পন্ন হতো। আর ইচ্ছা ও সামর্থ্য উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি। যেহেতু ইচ্ছা হল এক ধীন্দ্রিয় শক্তি এবং সামর্থ্য হল এক দৈহিক শক্তি। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে মানুষের নিকট হতে ঐ ধীশক্তি বা বিবেক ছিনিয়ে নিতে পারেন; আর তখন মানুষের কোন ইচ্ছা বর্তমান থাকতে পারে না। অনুরূপ তিনি ইচ্ছা করলে তার সামর্থ্য ছিনিয়ে নিতে পারেন; আর তখন সে কোন কাজ করতে একেবারে অসমর্থ হয়ে পড়ে। অতএব মানুষ যখন কোন কাজের সংকল্প করার পর তা সম্পাদিত করে, তখন আমরা সুনিশ্চিতরূপে জানতে পারি যে, আল্লাহ তা চেয়েছেন এবং তার ভাগ্যে নির্ধারিত করেছেন। যদি তা না হতো তাহলে মানুষের সংকল্পকে সেই কাজ হতে ফিরিয়ে দিতেন অথবা এমন প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতেন, যা তার ও তার কর্ম-সামর্থ্যের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করত।
একজন বেদুইনকে জিজ্ঞাসা করা হল, 'তুমি আল্লাহকে চিনলে কিরূপে?’ বলল, উদ্যম ভেঙ্গে পড়ায় এবং সংকল্প ফিরে যাওয়ায়।
২- পাপ করলে মানুষকে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু যে পাপ তার ভাগ্যে লিখা ছিল, আর লিখনের বাইরে কিছু ঘটা সম্ভব নয়, তাহলে তাতে তাকে শাস্তি ভুগতে হবে কেন?
এর উত্তরে বলা যায় যে, যদি তাই বল, তাহলে এ কথাও বল যে, পুণ্যকাজ করলে মানুষকে তার সুফল দান করা হবে। কিন্তু যে পুণ্যকাজ তার ভাগ্যে লিখা ছিল, আর লিখনের বাইরে কিছু হওয়া বা ঘটা সম্ভব নয়, তাহলে তাকে সুফল দেওয়া হবে কেন? ন্যায় ও সুবিচার এই নয় যে, তকদীরের লিখনকে পাপের ক্ষেত্রে দলীল মনে করবে এবং পুণ্যের ক্ষেত্রে ধরবে না। দ্বিতীয়তঃ মহান আল্লাহ এই অভিযোগ ও দলীলকে কুরআন মাজীদে নাকচ করেছেন এবং না জেনে বলা’র শামিল করেছেন। তিনি বলেছেন, “যারা মুশরিক তারা বলবে, আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষগণ শির্ক করতাম না এবং কোন কিছুই হারাম করতাম না। এভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণও প্রত্যাখ্যান করেছিল, অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বল, তোমাদের নিকট কোন জ্ঞান (বা যুক্তি) আছে কি? থাকলে আমার নিকট তা পেশ কর। তোমরা শুধু কল্পনারই অনুসরণ কর এবং শুধু মিথ্যাই বলে থাক।” (সূরা আনআম ১৪৮ আয়াত)।
সুতরাং মহান আল্লাহ এ কথাই বর্ণনা করেন যে, যারা নিজেদের পাপ শির্কের সমর্থনে তকদীরকে দলীল ও প্রমাণ মনে করেছিল, তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের অনুরূপ ছিল। যারা তাদের মতই সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং মিথ্যাজ্ঞান করেছিল। আর আল্লাহর শাস্তি ভোগ করা পর্যন্ত তারা তাতেই অবিচল ছিল। অতএব তাদের ঐ যুক্তি ও প্রমাণ যদি সঠিক হত, তাহলে আল্লাহর শাস্তি তাদেরকে ভোগ করতে হত না। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর নবী # কে সঠিক যুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ করতে আদেশ করে বলেন যে, তাদের ঐ কথায় কোন দলীল বা যুক্তি নেই। তারা যা মনে করে, তা কেবল ধারণা ও অলীক মাত্র।
তৃতীয়তঃ তকদীর আল্লাহর এক গুপ্ত রহস্য। সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছাড়া আর অন্য কেউ তার তত্ত্ব জানতে পারে না। সুতরাং পাপী কিরূপে জানতে পারে যে, তার তকদীরে পাপ লিখা আছে এবং সেই ভিত্তিতে সে পাপে অগ্রসর হয়? এটা কি সম্ভব নয় যে, তার ভাগ্যে আনুগত্য লিখা আছে? অতঃপর পাপের পরিবর্তে আনুগত্যের পথে অগ্রসর হয়ে কেন বলে না যে, আল্লাহ আমার ভাগ্যে পুণ্য লিখেছিলেন? চতুর্থতঃ বলা যায় যে, (আল্লাহ তাআলা পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ উভয়ই সৃষ্টি করেছেন এবং) তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিবেক ও ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি দান করে সকল জীবজগতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন।
তার উপর দ্বীনের পথ-নির্দেশিকা গ্রন্থাবলী অবতীর্ণ করেছেন এবং সুপথের দিশারী স্বরূপ রসূল ও আম্বিয়া প্রেরণ করেছেন তাদের প্রতি তাদের। মাধ্যমে মানুষকে উপকারী ও অপকারী বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মানুষকে এমন ইচ্ছাশক্তি ও সামর্থ্য দান করেছেন, যদ্বারা ভালো অথবা মন্দ বেছে নিয়ে সে যে কোন পথে চলতে পারে। সুতরাং কেন এই পাপী ভালো পথ ত্যাগ করে মন্দ পথকে বেছে নেয়? অথচ এই যুবক সফরে গেলে যদি দু’টি রাস্তা পায়; যার একটি সহজ ও নিরাপদ এবং অপরটি কঠিন ও বিপদসঙ্কুল, তাহলে তো সে সুনিশ্চিতভাবে প্রথম রাস্তাটিকেই গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয়টিকে অবশ্যই বর্জন করে। আর তখন বলে না যে, আল্লাহ আমার ভাগ্যে এই পথে চলা লিখেছেন। বরং এই যুক্তিতে যদি সে বিপজ্জনক পথে চলে, তাহলে লোকে তাকে পাগল ও বেওকুফ বলবে।
তদনুরূপই ধর্ম ও অধর্মের পথ। তাই মানুষের উচিত, ধর্ম ও কল্যাণের পথ বেছে নিয়ে তাতে চলা। আল্লাহ ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন’- এই যুক্তিতে অধর্ম ও মন্দের পথ ধরে নিজেকে ধোকা দেওয়া উচিত নয়। তাই তো আমরা দেখি যে, প্রত্যেক সক্ষম উপার্জনশীল মানুষ রুযী-রুটীর সন্ধানে তার প্রত্যেক রাস্তায় পদক্ষেপ করে থাকে এবং রোজগার ত্যাগ। করে এই কথার দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকে না যে, তকদীরে থাকলে পয়সা হবে।
অতএব পার্থিব ও সাংসারিক প্রচেষ্টা ও আল্লাহর আনুগত্যের জন্য প্রচেষ্টার মাঝে পার্থক্য কি? কেন আনুগত্য ত্যাগ করার সমর্থনে তকদীরকে তোমার জন্য দলীল মনে করছ, অথচ পার্থিব কোন কাজ ত্যাগ করার সমর্থনে তা দলীল মনে কর না? যথাস্থানে ব্যাপারটি খুবই স্পষ্ট। কিন্তু কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্ধ ও বধির করে তোলে। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ২৯৩৪পৃঃ দ্রঃ)