লগইন করুন
যে মুসলিম প্রকৃত সালাফিয়্যাহর অনুসারী হবে, অর্থাৎ সলফের মানহাজের সত্যিকার ও সত্যনিষ্ঠ অনুগামী হবে, তার সকল প্রকার কল্যাণ লাভ হবে। লাভ করবে বিশাল সওয়াব ও মহা পুরস্কার। যেহেতু সে আসলে অবলম্বন করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশিত পথ। নিমে এর কিছু মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বিবৃত হলঃ
১। সালাফিয়াত অবলম্বনকারী ইলাহী নির্দেশের অনুসারী। আর এ কাজে সে আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন করবে।
যেহেতু ইবাদত হল, প্রত্যেক সেই প্রকাশ্য ও গুপ্ত কথা ও কাজের ব্যাপক নাম, যা আল্লাহ ভালোবাসেন ও যাতে তিনি তুষ্ট হন।
এই ভিত্তিতে বলা যায়, সলফে সালেহর অনুসরণ করা ওয়াজেব। হওয়ার ব্যাপারে যে সকল নির্দেশিকা আমাদের চোখে (ইতিপুর্বে) পার হয়ে গেছে, তার অনুসরণ যে ব্যক্তি করবে, সে আসলে আল্লাহর নির্দেশের অনুসারী হবে। আর যে আল্লাহর নির্দেশের অনুসারী হবে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। যেহেতু সে তার শরীয়তের অনুবর্তী।
২। সালাফিয়াত অবলম্বনকারী হিদায়াত (সুপথ) পাবে এবং ভ্রষ্টতা ও বক্রতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে।
এ বিষয়টিও স্পষ্ট। জাবের ঐ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিদায়ী হজ্জে নবী (সা.) বলেছেন,
وَقَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ، كِتَابُ اللهِ
“অবশ্যই আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি; যদি তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করে থাকো, তবে কখনই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আল্লাহর কিতাব।”[১]
আমি বলি, আল্লাহর কিতাবে কী আছে? তাতে আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সলফে সালেহর অনুসরণের আদেশ। যেমন তার প্রমাণসমূহ পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। একই শ্রেণীর আরো প্রমাণ হল, আল্লাহর এই বাণী,
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (আহযাবঃ ২১)।
ইমাম ইবনে কাষীর এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কথা, কর্ম ও অবস্থাসমূহে তাঁকে নিজের আদর্শ মানার ব্যাপারে এই আয়াতটি বিশাল মৌলনীতি। এই জন্য মহান আল্লাহ মানুষকে আদেশ করেছেন, যাতে তারা খন্দক যুদ্ধের দিন নবী (সা.)-কে তার ধৈর্যধারণে, ধৈর্য ধারণের প্রতিযোগিতায়, (শত্রুর বিরুদ্ধে) সদা প্রস্তুত থাকাতে, তার জিহাদ ও সংগ্রামে এবং নিজ প্রতিপালকের নিকট থেকে বিপদমুক্তির অপেক্ষায় নিজেদের আদর্শ বানায় (এবং তার অনুসরণ করে)।[২]
৩। সালাফিয়াত অবলম্বনকারী নিন্দিত মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতায় পতিত হওয়া থেকে সুরক্ষিত।
যেহেতু দুই অহী (কুরআন ও হাদীস)এর বাণী---সুপ্রিয় পাঠক--- আমাদেরকে হকের উপর, হকের সাথে ও হকের জন্য ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (ধর্ম বা কুরআন)কে শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আলে ইমরান : ১০৩)
তিনি আরো বলেছেন,
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
“অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না; যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মত সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত। (রূমঃ ৩১-৩২)
পূর্বোক্ত ইরবায ইবনে সারিয়াহ (রাঃ) এর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
وإنه من يعش منكم فسيرى اختلاف كثير
“(স্মরণ রাখ) তোমাদের মধ্যে যে আমার পর জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ বা অনৈক্য দেখবে।”
এ কথা শুনে যেন তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল! বাচার পথ কী? পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তরে তিনি বললেন, (فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيينَ) “তোমরা আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের রীতিকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবুত করে ধরে থাকবে।---”
হাদীসটির কিয়দংশ এই বকতময় দাওয়াতের লক্ষণ ও চিহ্ন’ নিয়ে আলোচনা পর্বে বিইযনিল্লাহ উল্লিখিত হবে।
ইমাম বাগবী শারহুস সুন্নাহ’ (১/২০৬)তে উক্ত ইরবায (রাঃ)-এর হাদীসের টীকায় বলেছেন, 'এতে বিদআত ও খেয়ালখুশির বহিঃপ্রকাশ। ঘটার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। তাই তিনি তাঁর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবলম্বন করতে, ঐকান্তিকভাবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার সাথে তা আঁকড়ে ধরতে এবং তার পরীপন্থী নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
৪। শয়তানের পথরাজি থেকে নিষ্কৃতি।
ইমাম মুহাম্মাদ বিন নাত্র আল-মিরওয়াযী ‘সুন্নাহ’ গ্রন্থের (৯পৃঃ)তে বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ
“নিশ্চয়ই এটি আমার সরল পথ। সুতরাং এরই অনুসরণ কর এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন।” (আনআমঃ ১৫৩)
সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, তার পথ হল একক ও সরল। আরও পথ আছে অনেক। যে ব্যক্তি সে পথরাজির। অনুসরণ করবে, তা তাকে তার সরল পথ থেকে বাধাপ্রাপ্ত করবে। অতঃপর নবী (সা.) আমাদের জন্য তাঁর সুন্নাহ দিয়ে তা বিস্তৃত করেছেন।
এর পর তিনি সনদসহ আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ)-এর হাদীস উল্লেখ করেছেন। যা ইমাম আহমাদ প্রমুখের গ্রন্থেও আছে। আর তা সহীহ হাদীস। (আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন,)
خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا . ثُمَّ قَالَ : " هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ " ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ وَقَالَ : هَذِهِ سُبُلٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ، وَقَرَأَ : وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
রসূল (সা.) আমাদের জন্য স্বহস্তে একটি রেখা টানলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এটি আল্লাহর সরল পথ।” অতঃপর ঐ রেখার ডানে ও বামে কতকগুলি রেখা টেনে বললেন, “এগুলি বিভিন্ন পথ। এই পথগুলির প্রত্যেটির উপর একটি করে শয়তান আছে; যে ঐ পথের প্রতি মানুষকে আহ্বান করে।” অতঃপর তিনি আল্লাহ তাআলার এই বাণী পাঠ করলেন---যার অর্থ, “নিশ্চয় এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তার পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে।” (সুরা আনআম ১৫৩ আয়াত)।
অতঃপর তিনি উক্ত হাদীসের কতিপয় সূত্র উল্লেখ করেছেন। তারপর বলেছেন, সুতরাং আল্লাহ অতঃপর তার রসূল (সা.) আমাদেরকে নব রচিত কর্মাবলী এবং মনের খেয়ালখুশির অনুসরণ থেকে সতর্ক করেছেন, যা আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর নবীর তরীকা অনুসরণ করা থেকে বাধাপ্রাপ্ত করে।
উক্ত হাদীস থেকে স্পষ্টতঃ বোঝা যায় যে, যে ব্যক্তি নবুঅতের আদর্শের অনুবর্তী হবে, সে ব্যক্তি শয়তানের পথসমূহের এবং তার ভ্ৰষ্টকারী রাস্তাসমূহের ফাদে ফেঁসে যাওয়া হতে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি মু'মিনদের পথ এড়িয়ে চলবে, সে ব্যক্তি শয়তানের রশিতে আবদ্ধ হয়ে যাবে। নাউযু বিল্লাহি মিন যালিক।
ইমাম ইবনুল কাইয়ুম ‘আল-ফাওয়াইদ’ গ্রন্থে (৪৭পৃঃ)তে বলেছেন, 'যখন লোকেরা কিতাব ও সুন্নাহকে জীবন-সংবিধান বানানো হতে এবং উভয়ের কাছে বিচার-ফায়সালা নিতে বিমুখ হল, তা যথেষ্ট নয়---এই ধারণা করল এবং রায়, কিয়াস, ইস্তিহসান (ভালো মনে করে করা কর্ম) ও বুযুর্গদের উক্তির দিকে ফিরে গেল, তখন এর ফলে তাদের প্রকৃতিতে বিকৃতি, তাদের হৃদয়ে অন্ধকার, তাদের বুঝে আবিলতা এবং তাদের বিবেক-বুদ্ধিতে বিলুপ্তি প্রকাশ পেল। তাদের মাঝে এ সকল বিপত্তি ব্যাপক আকার ধারণ করল। তাদের ওপর এমন। আধিপত্য লাভ করল যে, তারই মাঝে ছােট বড় হল এবং বড় বুড়ো হল। যার ফলে তারা সেগুলিকে আপত্তিকর মনেই করল না।
অতঃপর তাদের ওপর এল অন্য এক সাম্রাজ্য। যাতে সুন্নাহর জায়গায় বিদআত বিবেক-বুদ্ধির জায়গায় মনমানি, বুদ্ধিমত্তার জায়গায় খেয়ালখুশি, হিদায়াতের জায়গায় ভ্রষ্টতা, সৎকর্মের জায়গায় অসৎকর্ম, জ্ঞানের জায়গায় অজ্ঞতা, ইখলাসের জায়গায় রিয়া (লোকপ্রদর্শন), হকের জায়গায় বাতিল, সত্যের জায়গায় মিথ্যা, উপদেশের জায়গায়। চাটুকারিতা এবং ন্যায়ের জায়গায় অন্যায় দখল গ্রহণ করল। অনিবার্যরূপে এ সকল বিষয়ের জন্য সাম্রাজ্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠালাভ করল এবং তার অধিবাসীরাই হল বিখ্যাত। অথচ ইতিপূর্বে উক্ত সকল বিষয় ছিল তার বিপরীতের জায়গায়। আর তার অধিবাসীরাই ছিল বিখ্যাত।
সুতরাং যখন তুমি দেখবে যে, উক্ত সকল বিষয়ের সাম্রাজ্য আগত হয়েছে, তার পতাকা স্থাপিত হয়েছে এবং তার সৈন্যদল সওয়ারী গ্রহণ করেছে, তখন (তোমার জন্য) আল্লাহর কসম---মাটির উপরের অংশের চাইতে ভিতরের অংশই শ্রেষ্ঠ (বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া ভালো), সমভূমি চাইতে পর্বত-চূড়াই শ্রেষ্ঠ এবং মানুষের সংসর্গে থাকার চাইতে হিংস্র প্রাণীদের সংসর্গে থাকাটাই বেশি। নিরাপদ।
৫। সালাফিয়াত অবলম্বকারীর জন্য রয়েছে তার অনুগামীরও সওয়াব।
যেহেতু ইমাম মুসলিম জারীর বিন আব্দুল্লাহ কর্তৃক হাদীস বর্ণিত করেছেন,
من سن في الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أجورهم شيء
“যে ব্যক্তি ইসলামে ভাল রীতি চালু করবে, সে তার নিজের এবং ঐ সমস্ত লোকের সওয়াব পাবে, যারা তার (মৃত্যুর পর তার উপর আমল করবে। তাদের সওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না।” (সহীহ মুসলিম ২৩১৮নং)
এই হাদীসের প্রকাশ্য অর্থ এ কথারই দলীল যে, সে ব্যক্তি বিশাল সওয়াবের অধিকারী হবে, যে ব্যক্তি নবী ৪জি ও তাঁর সাহাবাবঞ্জ -এর আদর্শ এবং উম্মতের সলফে সালেহর আদর্শকে জীবিত করবে। লোকেদের মাঝে তা প্রচার করবে এবং অন্যেরা তার অনুসরণ করবে। সে তার সওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করবে এবং তাদের সওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না।
হাফ্যে নাওয়াবী শারহু মুসলিম গ্রন্থে (৭/১০৪)এ বলেছেন, 'এই হাদীসে কল্যাণময় কর্ম শুরু করা এবং ভালো রীতি চালু করায় উৎসাহ প্রদান রয়েছে। আর অসার ও জঘন্য কর্ম উদ্ভাবন করার ব্যাপারে সতর্কীকরণ রয়েছে।
৬। সালাফিয়াত অবলম্বনকারী ইহ-পরকালে সুখী।
এই সুখের কারণ হল, সালাফী মহান আল্লাহ ও তাঁর রসূল ৫-এর নির্দেশ পালনকারী। পক্ষান্তরে নির্দেশ থেকে বিমুখ ব্যক্তি সুখী নয়। তার ব্যাপারে ধমক দিয়ে বলা হয়েছে,
وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ
“যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, অবশ্যই তার হবে সংকীর্ণতাময় জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।” (ত্বা-হাঃ ১২৪)।
তাহলে সালাফিয়াত অবলম্বনকারী বিমুখ অথবা অনুসারী? সালাফিয়াত অবলম্বনকারী অনুসারী, বিমুখ নয়। যেহেতু সে নিজ প্রতিপালককে স্মরণকারী, তার নবী ৪-কে অনুসরণকারী। সুতরাং সে হল স্থায়ী নিয়ামত ও ব্যাপক সওয়াবের জন্য প্রতিশ্রুত। মহান আল্লাহ বলেছেন,
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ ۚ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। আর যে আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হয়ে চলবে, আল্লাহ তাকে বেহেস্তে স্থান দান করবেন; যার নীচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এ মহা সাফল্য।” (নিসাঃ ১৩)
তিনি আরো বলেছেন,
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
“যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।” (নিসাঃ ৫৯) ।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) আর-রিসালাতুত তাবুকিয়্যাহ’ (পুস্তিকার ৭৫-৭৬পৃষ্ঠায়) উক্ত আয়াতের পাদটীকায় বলেছেন, 'এ বাণী এই কথার দলীল যে, আল্লাহর আনুগত্য, তার রসূল -এর আনুগত্য এবং আল্লাহ ও তার রসূলকে বিচারক মান্য করা হল বিলম্বে ও অবিলম্বের সুখ লাভের হেতু। যে ব্যক্তি বিশ্বসংসার ও তার মাঝে সংঘটিত মন্দসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে জানতে পারবে যে, প্রত্যেক মন্দের কারণ হল, রসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করা এবং তার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া। পক্ষান্তরে ইহকালের প্রত্যেক কল্যাণের কারণ হল, নবী (সা.)-এর আনুগত্য। অনুরূপ পরকালের অকল্যাণসমূহ, তার কষ্টরাজি ও শাস্তিসমূহের মৌলিক কারণ হল নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ।
বলা বাহুল্য, দুনিয়া ও আখেরাতের অকল্যাণের মূল উৎস হল নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ এবং তার সন্নিবিষ্ট পরিণতি।
সুতরাং মানুষ যদি রসূল (সা.)-এর যথাযথরূপে আনুগত্য করত, তাহলে পৃথিবীতে কোন মন্দ ও অকল্যাণই সংঘটিত হতো না। এটা যেরূপ সাধারণ অমঙ্গল ও পৃথিবীতে আপতিত বিপদাপদের ক্ষেত্রে সর্ববিদিত, অনুরূপই তা বান্দার নিজ দেহ-মনে যে অমঙ্গল, কষ্ট ও দুঃখ-দুশ্চিন্তা আপতিত হয়, তার ক্ষেত্রেও। এ সকল কিছুর কারণ হল রসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ। আর যেহেতু তার আনুগত্য সেই দুর্গ, যাতে প্রবেশকারী নিরাপত্তা লাভ করে এবং সেই গুহা, যাতে আশ্রয়প্রার্থী পরিত্রাণ লাভ করে, সেহেতু জানা গেল যে, দুনিয়া ও আখেরাতের অমঙ্গলের একমাত্র কারণ হল নবী (সা.)-এর আনীত বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞতা এবং সে বিষয় থেকে বাইরে অবস্থান করা। এ হল এ কথারই অকাট্য প্রমাণ যে, নবী -এর আনীত বিষয়কে ইলম হিসাবে জ্ঞান রাখা এবং আমল হিসাবে পরিণত করা ছাড়া বান্দার কোন পরিত্রাণ ও কোন সুখ নেই।
* একটি সতর্কতা
এ স্থলে সতর্ক মানুষকে একটি সতর্কবার্তা ও উপদেশ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আর উপদেশ মুমিনের জন্য উপকারী।
যারা নিজেদেরকে ‘সালাফী’ বলে দাবী করে, তাদের প্রত্যেকেই যে নিজের দাবীতে সত্যবাদী হবে, তা নয়। আর সুপ্রিয় পাঠক! এ কথা কঠিনীকরণের অন্তর্ভুক্ত নয়। কক্ষনো নয় আল্লাহর কসম! বরং উক্ত দাবীর সপক্ষে দলীল থাকা আবশ্যক। আমল থেকে প্রমাণ থাকা জরুরী, যা এই বিশাল মর্যাদাপূর্ণ (সালাফী) শব্দটি সার্থক বোঝা যায়। সরল রাজপথের একনিষ্ঠ পথিক হিসাবে প্রমাণ থাকা আবশ্যক। নচেৎ আমরা এমন অনেকের ব্যাপারে পড়ি ও শুনি, যারা এই সালাফিয়্যাহর সাথে মিথ্যার আশ্রয় ও ছদ্মবেশ নিয়ে নিজেদের সম্পর্ক জোড়ে, অথচ তারা তরীকা ও মানহাজে (পদ্ধতি ও আদর্শে) এবং মৌলিক ও গৌণ বিষয়ে তার বিপরীত! (এরা ‘চোরের নৌকায় সাধুর নিশান’ ব্যবহার করে।)
একটি অবাক কান্ড এই যে, কিছু রটনাকারী এই মর্যাদাপূর্ণ নামের সাথে কতিপয় বিভ্রান্তিকর বিকৃত নাম প্রয়োগ করে থাকে। যেমন : জিহাদী সালাফী, ইলমী সালাফী, দাওয়াত ও কিতালের সালাফী জামাআত ইত্যাদি। যার মাঝে রয়েছে খেয়ালখুশীর পূজারী ও বিদআতীদের পদচিহ্নের হুবহু অনুগমন।
ইমাম হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'হে আদম-সন্তান! তুমি তার কথায় ধোকা খেয়ো না, যে বলে, “মানুষ যাকে ভালোবাসে, (কিয়ামতে) সে তার সঙ্গী হবে।”[৩]
নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি যে জাতিকে ভালোবাসবে, সে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। তুমি কক্ষনোই পুণ্যবানদের সাথে মিলিত হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাদের আদর্শ গ্রহণ করবে, তাদের তরীকার অনুগামী হবে, তাদের আদর্শ অনু্যায়ী তোমার সকাল-সন্ধ্যা হবে, এই আগ্রহে যে, তুমি তাদের দলভুক্ত হবে। সুতরাং তুমি তাদের পথের পথিক হবে, তাদের তরীকা গ্রহণ করবে; যদিও আমলে তুমি পিছিয়ে থাকো। যেহেতু মূল বিষয়টি হল, সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা।
তুমি কি ইয়াহুদী-খ্রিস্টান ও সর্বনাশী খেয়ালখুশীর পূজারীদের অবস্থা লক্ষ্য করনি, যারা তাদের নবীদেরকে ভালোবাসে? ইয়াহুদী-খ্রিস্টান এবং অনুরূপ খেয়ালখুশীর পূজারীরা কি তাদের নবীদের ভালোবাসার দাবী করে না? অথচ তারা তাদের সাথী হতে পারবে না। যেহেতু তারা তাদের কথা ও কাজে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে। তারা তাদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চলে থাকে। সুতরাং তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। নাউযু বিল্লাহি মিন যালিক।[৪]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'যখন ভালোবাসার দাবীদার বেশি হতে লাগল, তখন দাবীর সত্যতার সপক্ষে প্রমাণ চাওয়া হল। নচেৎ লোকেদেরকে যদি নিজ নিজ দাবী অনুযায়ী প্রদান করা হয়, তাহলে তো নিশ্চিন্ত ব্যক্তি দুশ্চিন্তাগ্রস্তের অন্তর্জালা হওয়ার কথা দাবী করবে। বলা বাহুল্য, আপাতদৃষ্টিতে (ভালোবাসার) দাবীদার ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। তাই বলা হল, ‘প্রমাণ ছাড়া এ দাবী গ্রহণযোগ্য নয়।
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ
“বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ কর।” (আলে ইমরানঃ ৩১)
তখন সারা সৃষ্টি পিছিয়ে গেল! কেবল অবিচল থাকল কথা, কর্ম ও চরিত্রে প্রিয় হাবীব (সা.) এর অনুসারিগণ।[৫]
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বাওনুল মানত্বিকৃ’ (গ্রন্থের ১৫৮পৃষ্ঠায়) উল্লেখ করেছেন, ইমাম আবুল মুযাফফার সামআনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আমরা অনুসরণ করতে আদিষ্ট ও আহত হয়েছি এবং বিদআত হতে আমাদেরকে নিষেধ ও তিরস্কার করা হয়েছে। সুতরাং আহলুস সুন্নাহর প্রতীক হল, সলফে সালেহর অনুসরণ করা এবং প্রত্যেক নব উদ্ভূত ও বিদআতকে বর্জন করা।
সুতরাং যারা (নিজেদের পরিচিতির কোন) প্রতীক (বা নিশান) তুলে ধরে, তাদের প্রত্যেকেই যে সত্যবাদী, তা নয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আহলে হাদীস বলতে আমাদের উদ্দেশ্য তারা নন, যারা কেবল হাদীস শ্রবণ, লিখন ও বর্ণনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেন। বরং আমাদের উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক সেই ব্যক্তি, যিনি বেশি যত্নের সাথে হাদীস হিফ্য করবেন, চিনবেন, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিকভাবে বুঝবেন এবং বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিকভাবে অনুসরণ করবেন।”[৬]
* প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য (প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্ভবতঃ আপনারা জানেন, এই বৰ্কতময় শহর (মক্কা মুকারামা) শারাফাহাল্লাহতে ১৪০০ হিজরীর প্রারম্ভে কী ঘটেছিল? একটি বিদ্রোহী ফির্কা আল্লাহর ঘর পবিত্র মাসজিদুল কা’বার ‘হারাম’কে কয়েক দিনের জন্য হালাল করে নিয়েছিল! এই ফির্কাও মিথ্যা ও অসত্য দাবী করে নিজেদেরকে “সালাফী’ পরিচয় দিয়েছিল!!
এ ব্যপারে আমাদের শায়খ আল্লামা মুহাম্মাদ আমান (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আল-জামিআতুল ইসলামিয়্যাহ’ পত্রিকায় [৭] অনেক কিছু লিখেছিলেন। তখন তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন, উক্ত ঘটনার পর প্রথম আযানকে ফিতনার সমাপ্তি ঘোষণা গণ্য করা হল, যা ছিল বিষাদ, দুশ্চিন্তা ও দুঃখে পরিপূর্ণ। এ সবের পরিবর্তে জায়গা নিল খুশি ও আনন্দ। আল্লাহর নিয়ামত লাভের খুশি। নির্বোধ জুহাইমানীদের দুষ্কর্মের ফলে আপতিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র মসজিদকে পবিত্র করার সক্ষমতার নিয়ামত।
* এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য উক্ত শিশু প্রকৃতির নির্বোধেরা নিজেদেরকে “সালাফী’ বলে পরিচয় দিয়েছিল---যেমনটি আমার কাছে খবর পৌঁছেছিল। তাদের মুখনিঃসৃত বাক্য কি সাংঘাতিক! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে।
পক্ষান্তরে এই (সালাফী) নামে নিজেদেরকে পরিচয় দেওয়ার কারণ দুটির মধ্যে একটি হতে পারেঃ
১। হয় তারা সালাফিয়্যাহর সঠিক অর্থ জানে না। সে ক্ষেত্রে তাদের এ নাম ব্যবহার করা অজ্ঞতার কারণে হবে। সে অজ্ঞতা জেনেও না জানার ভান করে হতে পারে।
২। না হয় তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রতারণা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচার। সতরাং তাদের এই ব্যবহার ছিল উক্ত প্রিয় নামকে বিকৃত করার নিকষ্ট ইচ্ছার ফলস্বরূপ। যে নামের অর্থই হল এই উম্মতের প্রথম অগ্রগামী দল এবং যারা তাদের পথের পথিক।
সম্মানিত পাঠকের জেনে রাখা দরকার যে, জুহাইমানীরা ‘সালাফী নয়। তারা দাওয়াতের উপযুক্তও নয়। আসলে তারা নকল সালাফী, সালাফিয়্যাতের দাবীদার এবং ইসলামের দাওয়াত দেয় এমন ধারণাকারী। অথচ তারা নিজেরাই মূল ইসলাম থেকেই বহু দূরে, তার দিকে দাওয়াত দেওয়া তো দূরের কথা।
[২]. তফসীর ইবনে কাসীর ৩/৪৭৫
[৩]. এটি বুখারী-মুসলিমের হাদীসের একটি অংশ। কিন্তু কিছু লোক এটিকে তাদের দলীল ধারণা করে। অথচ সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথা, কর্ম, বরং খোজ নিয়ে দেখলে---তাঁর আকীদারও বিরোধী। আর এটাই হল ইমাম হাসান (রাহিমাহুল্লাহ)র উদ্দেশ্য।
[৪]. শারহু মুসনাদি সুলামিয়াতিল ইমাম আহমাদ ১/৬১৭
[৫]. মাদারিজুস সালিকীন ৩/৮
[৬]. মাজমুউ ফাতাওয়া ৪/৯৫, আরো দ্রঃ লাওয়ামিউল আনওয়ার, সাফারীনী ১/৬৪
[৭]. সংখ্যা ৪৫, বছর ১২/১৪০০হিঃ