লগইন করুন
জানাযা (কাঁধে) বহন করা এবং দাফনের জন্য তার সঙ্গে যাওয়া ওয়াজেব (ফর্যে কিফায়াহ)। তা মুসলমানের একটি হক বা অধিকার; যা আদায় করা। জরুরী। পিয়ারা নবী (ﷺ) বলেন, “মুলিমের উপর মুসলিমের অধিকার (অন্য এক বর্ণনায়, মুসলিমের জন্য মুলিমের পক্ষে ওয়াজেব) হল ৫টি; সালামের জওয়াব দেওয়া, রোগীকে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করা, জানাযার অনুগমন করা, দাওয়াত গ্রহণ করা এবং হাঁচির (পর ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে ‘য়্যারহামুকাল্লাহ’ বলে তার) জওয়াব দেওয়া।” (বুখারী ১১৬৪ক, মুসলিম ৪০২২ক, ৪০২৩ক, আহমাদ ৮৪৯০ক প্রমুখ।)
তিনি আরো বলেন, “তোমরা রোগীকে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ কর এবং জানাযার অনুসরণ কর (দাফন কার্যের জন্য যাও); তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেবে।” জানাযার সাথে যাওয়া বা তার অনুগমন করার দুটি পর্যায় রয়েছে; প্রথমতঃ মড়াবাড়ি হতে জানাযার নামায পড়া পর্যন্ত। দ্বিতীয়তঃ মড়াবাড়ি থেকে দাফন বা লাশ কবরস্থ করা পর্যন্ত। এই উভয় প্রকার আমলই মহানবী (ﷺ) কর্তৃক প্রমাণিত আছে। (দেখুন মাওয়ারিদুয যামআন ৭৫৩নং, হাকেম ১/৩৫৩, ৩৬৪,৬৫, বাইহাকী ৪/৭৪)।
তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মড়াবাড়ি থেকে নিয়ে দাফন কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত জানাযার অনুগমন করাটা কেবল জানাযা পড়ে ফিরে আসার চেয়ে বহুগুণে উত্তম। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি মড়াবাড়ি থেকেই ঈমানের সাথে এবং নেকী লাভের আশায় জানাযার অনুগমন করে নামায পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তার জন্য রয়েছে এক কীরাত সওয়াব। আর যে ব্যক্তি তার দাফন হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকে, তার জন্য রয়েছে দুই কীরাত সওয়াব।”
তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ২কৃীরাত পরিমাপ কেমন? উত্তরে তিনি। বললেন, “দুটি বড় বড় পর্বতের মত।” অন্য বর্ণনায় তিনি বললেন, “প্রত্যেক কৃীরাত উহুদ পাহাড়ের সমান।” (বুখারী ৪৫, ১২৪০ক, মুসলিম ১৫৭০, ১৫৭ ১ক, নাসাঈ ৪৯৪৬ক, আহমাদ ৯১৮৩ক)
সুতরাং মুলিমের উচিত, অকারণে নিজেকে এই বিশাল পর্বতসম সওয়াব হতে এবং তার এক মুসলিম ভাইকে তার (দাফনের পর) দুআ হতে বঞ্চিত করে জানাযা পড়েই পালিয়ে না আসা।
অবশ্য এই সওয়াব কেবল পুরুষের জন্য; মহিলাদের জন্য নয়। কারণ, মহিলারা কোন জানাযার অনুগমন করতে পারে না। মহানবী (ﷺ) মহিলাদেরকে জানাযায় অনুগমন করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ৩০২ক, মুসলিম ১৫৫৫)
জানাযার সাথে এমন কোন জিনিস নিয়ে যাওয়া বৈধ নয় যা শরীয়তের পরিপন্থী। সুতরাং উচ্ছরোলে বিলাপকারী বা মাতমকারী পুরুষ অথবা মহিলা কোন প্রকার ধূপধুনা, চন্দন বা আগর-কাঠের ধুয়া ইত্যাদি সুগন্ধি অথবা আগুন নেওয়া বা নিতে দেওয়া অবৈধ ও হারাম।
রসূল করীম (ﷺ) বলেন, “শব্দ বা আগুন নিয়ে জানাযায় অনুগমন করো না।” (আবু দাউদ ২৭৫৭ক, আহমাদ ৯১৫০, হাদীসটি যয়ীফ হলেও এর সমার্থক আরো অন্যান্য হাদীস ও আসার রয়েছে। দেখুন আহকামুল জানায়েয ৭০ পৃঃ)
আম্র বিন আস (রাঃ) তাঁর অসিয়তে বলেছিলেন, 'আমি মারা গেলে আমার লাশের সাথে যেন কোন মাতমকারিণী ও আগুন না যায়। (মুসলিম ১৭৩ক, আহমাদ ১৭১১২)।
আবু হুরাইরা (রাঃ) মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, 'আমার উপর তোমরা তাবু লাগায়ো না। আর কোন (সুগন্ধ কাঠের) ধুয়ো দেওয়ার পাত্র (ধুনুচি) বা আগুন নিয়ে আমার জানাযার অনুগমন করো না।” (আহমাদ ৭৫৭৩, ৯৭৫৩)।
এই অনুগমনের সময় নিঃশব্দে শান্তভাবে চলতে হয়। কোন প্রকার বচসা, তর্ক, পার্থিব কথাবার্তা ইত্যাদি উচ্চরবে করা বা বলা ঠিক নয়। ক্বাইস বিন উবাদ বলেন, নবী (ﷺ) এর সাহাবাগণ জানাযার সময়ে উচ্চস্বরকে অপছন্দ করতেন। (বাইহাকী ৪/৭৪)।
এই উপলক্ষ্যে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা কোন আয়াত দ্বারা নিঃশব্দে অথবা সশব্দে যিকর বিদআত। বরং এটা অমুসলিমদের অনুকরণে ভালো মনে করে কৃত কাজ। (আহকামুল জানাইয দ্রষ্টব্য)।
তদনুরূপ জানাযার সাথে শোকের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাওয়া বা বাজানো তো হারাম বটেই। (ঐ) এই সময় চাল-ডাল, খই-মুড়কী, মিঠাই, পয়সা ইত্যাদি সদকা করা বা ছড়ানো এবং ফুল ছড়ানো, জানাযার উপর পুস্পার্ঘ নিবেদনাদি প্রথা বিদআত ও অবৈধ।
জানাযা বহন করার কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি যেমন, পাল্টে পাল্টে খাটের চারটি পায়া ধারণ করে বহন ইত্যাদির ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এরূপ করাটা বিদআত। (ঐ, বিদআত নং ৫০)
মাইয়্যেত যদি ভালো লোক হয় তবে তাকে ভালো প্রতিদানের দিকে আগিয়ে দিতে এবং যদি মন্দ লোক হয় তবে নিজেদের দায় খালাস করতে শীঘ্র করা ওয়াজেব। সুতরাং জানাযা নিয়ে চলার সময় দ্রুতপদে চলা উচিত। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা জানাযা নিয়ে তাড়াতাড়ি চল। কেননা, সে যদি নেককার হয় তবে তো ভালো; ভালোকে তোমরা তাড়াতাড়ি তার ভালো ফলের দিকে পৌঁছে দেবে। আর যদি এর অন্যথা হয়, তবে সে খারাপ, খারাপকে তোমরা তোমাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে দেবে।” (বুখারী ১২৩১ক, মুসলিম ১৫৬৮ক, তিরমিযী ৯৩৬)
তিনি আরো বলেন, “লাশ যখন খাটে রাখা হয় এবং লোকে তাকে তাদের কাঁধে বহন করতে শুরু করে, তখন সে যদি নেককার হয় তাহলে বলে, ‘আমাকে নিয়ে অগ্রসর হও। নচেৎ, বদকার হলে বলে, হায় হায়! আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ আর তার এই শব্দ মানুষ ছাড়া সকলে শুনতে পায়। মানুষ শুনতে পেলে বেহুশ হয়ে যেত।” (বুখারী ১৩১৪ নং, প্রমুখ।
তবে যেন লাশের উপর কোন প্রকার ঝাকুনি না আসে সে কথাও খেয়াল রাখা দরকার।
উল্লেখ্য যে, মাইয়্যেত ভালো লোক হলে তার লাশের ওজন হাল্কা হবে এমন ধারণা ভিত্তিহীন ও বিদআত। (আহকামুল জানাইয) জানাযার সাথে চলার সময়। তার আগে-পিছে ও ডানে-বামে চলা বৈধ। তবে সব ক্ষেত্রে লাশের কাছাকাছি থেকে চলা উত্তম। এ ব্যপারে নবী করীম (ﷺ) বলেন, “আরোহী ব্যক্তি জানাযার পশ্চাতে পশ্চাতে যাবে, যে হেঁটে যাবে সে পশ্চাতে, সামনে, ডাইনে ও বামে তার কাছা-কাছি চলবে। আর শিশুরও জানাযা পড়া হবে এবং তার পিতামাতার জন্য ক্ষমা ও রহমত লাভের দুআ করা হবে।” (আবু দাউদ ২৭৬৬, আহমাদ ১৭৪৭৫ তিরমিযী ৯৫২, নাসাঈ ১৯ ১৬, ইবনে মাজাহ ১৪৭০, সহীহ আবু দাউদ ২৭২৩ নং)
জানাযায় আগে ও পিছে উভয় ধরনের চলাই নবী (ﷺ) কর্তৃক প্রমাণিত। যেমন, আনাস (রাঃ) বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) আবু বাকার ও উমার জানাযার সামনেও হাঁটতেন এবং পশ্চাতেও।' (ত্বহাবী ১/২৭৮)
অবশ্য সকলের জন্য জানাযার পশ্চাতে চলাটাই উত্তম। কারণ, নবী (ﷺ) এর উক্তি, “তোমরা জানাযার অনুগমন কর” উক্ত কথাই দাবী করে। কেননা, অনুগমন করার অর্থই হল পশ্চাতে পশ্চাতে চলা। আর এ কথার আরো সমর্থন করে আলী (রাঃ)-এর উক্তি, তিনি বলেন, জানাযার আগে আগে চলার চাইতে পিছে পিছে যাওয়া সেই রকম উত্তম, যে রকম একা নামায পড়ার চাইতে জামাআতে নামায পড়া উত্তম।” (ইবনে আবী শাইবাহ ৪/ ১০ ১, তাহাবী ১/২৭৯, বাইহাকী ৪/২৫)
গাড়ী ইত্যাদিতে সওয়ার হয়ে জানাযার অনুগমন বৈধ। তবে পায়ে হেঁটে যাওয়াটাই উত্তম। কারণ, এটাই ছিল নবী (ﷺ) এর আমল। তাছাড়া এ কথাও প্রমাণিত নেই যে, তিনি কিছুতে সওয়ার হয়ে জানাযার সাথে গেছেন। বরং সওবান (রাঃ) বলেন, 'একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) কোন জানাযার সাথে যাচ্ছিলেন। তার নিকট এক সওয়ারী পেশ করা হলে তিনি তাতে চড়তে রাজী হলেন না। অতঃপর ফেরার পথে সওয়ারী পেশ করা হলে তিনি তাতে সওয়ার হলেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “ফিরিশ্তাবর্গ পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাই তাঁরা পায়ে হেঁটে যাবেন আর আমি সওয়ার হয়ে যাব তা চাইলাম না। অতঃপর তারা ফিরে গেলে সওয়ার হলাম।” (আবু দাউদ ২৭৬৩ক, হাকেম ১/৩৫৫, বাইহাকী ৪/২৩)
সওয়ার হয়ে জানাযায় অনুগমন করলে জানাযার পশ্চাতে পশ্চাতে যেতে হবে। যেমন পুর্বোক্ত হাদীসে বলা হয়েছে, “সওয়ার ব্যক্তি জানাযার পশ্চাতে পশ্চাতে যাবে---।” পক্ষান্তরে ফেরার পথে সওয়ার হয়ে আসা সর্বতোভাবে বৈধ; যেমন সওবান (রাঃ) হাদীসের নির্দেশ।।
পরন্তু সকলের জন্য জানাযার পশ্চাতে চলার সবচেয়ে ভালো। কারণ, পশ্চাতে চলাকেই অনুগমন করা বলা হয়। যেমন পূর্বে আলোচিত হয়েছে।
জানাযার জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি বা যে কোনও গাড়িতে লাশ বহন করা এবং গাড়িতেই সকলের অনুগমন করা বিধেয় নয়। যেহেতু এরূপ অমুসলিমরা করে থাকে এবং তাদের অনুকরণ বৈধ নয়; যা বিদআত। (আহকামুল জানাইফ ৭৬-৭৭ পৃঃ)।
যেহেতু কাঁধে লাশ নিয়ে গেলে আখেরাতের স্মরণ দেবে; অন্য লোকেরা জেনে মৃতের জন্য দুআ করবে এবং এতে গর্ব ইত্যাদি হতে বাঁচা যাবে। পক্ষান্তরে ভারি বৃষ্টি, প্রচন্ড শীত বা গ্রীষ্ম অথবা লাশ বহন করার মত লোক না থাকলে গাড়ি ব্যবহারে দোষ নেই। (সাবউনা সুআলান ফী আহকা-মিল জানাইয ২২)।
লাশ বহন করার সময় মাথাটা কোন দিকে থাকতে হবে তার কোন সিদ্ধান্ত শরীয়তে নেই। তবে মাথাটা সামনে দিকে থাকাটাই স্বাভাবিক ও উত্তম। (ঐ ৩ ১পৃঃ)
জানাযা দেখে খাড়া হওয়া এবং লাশ মাটিতে না রাখা পর্যন্ত অনুগামীদের দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ মনসুখ (রহিত)। আলী (রাঃ) বলেন, 'আল্লাহর রসূল (ﷺ) জানাযা দেখে দাড়িয়েছেন, আমরাও দাড়িয়েছি। অতঃপর তিনি বসেছেন, আমরাও বসেছি।' (মুসলিম ১৫৯৯, ইবনে মাযাহ ১৫৩৩ আহমাদ ১০৪০ক) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, জানাযাতে শরীক হয়ে তিনি দন্ডায়মান থাকতেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি বসেছেন। (মুআত্তা মালেক ৪৯১ক, আবু দাউদ ২৭৬১ক, সহীহ আবু দাউদ ২৭ ১৮নং) আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, জানাযায় শরীক হয়ে তা মাটিতে রাখা পর্যন্ত আল্লাহর রসূল (ﷺ) দাঁড়িয়েছেন এবং লোকেরাও। তার সাথে দাড়িয়ে থেকেছে। অতঃপর পরবর্তীকালে তিনি বসেছেন এবং সকলকে বসতে আদেশও দিয়েছেন।' (আহমাদ ৫৮৯ক, ত্বহাবী ১/২৮২)
যে ব্যক্তি জানাযা বহন করে তার জন্য ওযু করা মুস্তাহাব। যেমন নবী (ﷺ) এর হাদীস পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি মাইয়্যেতকে গোসল দেয় সে যেন। গোসল করে এবং যে বহন করে যে যেন ওযু করে।”