লগইন করুন
মৃত্যুর সময় কথা জানতে পারলে তার পরিবার বর্গের উপর এই বিপদের সময় দুটি কর্ম ওয়াজেব হয়ঃ
১। আল্লাহ্র নির্ধারিত তকদীর ও বিধানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ধৈর্যধারণ করা। যেহেতু আল্লাহ এতে বান্দাকে পরীক্ষা করেন এবং যা কিছু হয় তা সবই মুমিনের জন্য মঙ্গলদায়ক। আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ٭ وَلَا تَقُولُوا لِمَن يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِن لَّا تَشْعُرُونَ ٭ وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ٭ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ٭ أُولَٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্যই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথী। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে এবং ধন-প্রাণ ও ফসলে নোকসান দিয়ে পরীক্ষা করব; আর তুমি ধৈর্যশীলদের শুভসংবাদ দাও; যারা তাদের উপর কোন বিপদ এলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করব। এই সকল লোকেদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আশিস ও করুণা বর্ষিত হয়, আর এরাই হল সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা বাকারাহ ১৫৩-১৫৭ আয়াত)
আনাস (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এক মহিলার পাশ দিয়ে পার হলেন। সে একটি কবরের পাশে বসে কাঁদছিল। তিনি তাকে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর, আর ধৈর্য ধর।” মহিলাটি (যেন রেগে উঠে) বলল, “সরে যাও আমার কাছ থেকে আমার যা মুসীবত তা তোমার কাছে আসেনি!’ আসলে মহিলাটি তাকে চিনতে পারেনি। পরে কেউ তাকে বলল যে, তিনি আল্লাহর রসূল! একথা শুনে তার যেন মরণদশা উপস্থিত হল। মহিলাটি আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর দরজায় এল। দেখল, দরজায় কোন দারোয়ান নেই। তার নিকট উপস্থিত হয়ে সে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি! আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “বিপদের প্রথম চোটেই ধৈর্য ধরা হল আসল ধৈর্য।” (বুখারী ৬৬২১ ক, মুসলিম ১৫৩৪ ক, প্রমুখ)।
বিশেষ করে কোন শিশু-সন্তান মারা গেলে তার উপর ধৈর্যধারণ করার প্রতিদান ও মাহাত্ম বেশী। এ ব্যাপারে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নবী (ﷺ) বলেন, “যে মুসলিমের তিনটি শিশু-সন্তান মারা যাবে সে আল্লাহর কসম বহাল রাখার মত সামান্য ক্ষণ ছাড়া জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা।” যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, "তোমাদের প্রত্যেককেই তার (দোযখের) উপর দিয়ে যেতে হবে। এ তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। (সূরা মারয়াম ৭২ আয়াত, বুখারী ১২৫১নং ফাতহুল বারী ৩/ ১৪৮, মুসলিম, প্রমুখ)।
“যে মহিলার ৩টি শিশু-সন্তান মারা যাবে সে মহিলার জন্য ঐ শিশুরা জাহান্নাম থেকে পর্দা-স্বরূপ হবে।” একজন মহিলা বলল, আর দু’জন হলে?” তিনি বললেন, “দু’জন হলেও।” (বুখারী ১২ ৪৯নং, মুসলিম প্রমুখ।
২। এই বিপদের সময় (মৃত্যু জানতে পেরে বা খবর শুনে এবং তার পরেও) পরিজনের জন্য বলা ওয়াজেব (إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ) ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজেউন। (যেমন পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লেখ হয়েছে।) আর এরপরই নিম্নের দুআ বলাও বিধেয়ঃ
اللهم اجرني في مصيبتي واخلف لي خيرا منها
উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা আ-জিরনী ফী মুসীবাতী অআখলিফলী খায়রাম মিনহা।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমার এই বিপদে তুমি আমাকে প্রতিদান দাও এবং এর বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম বস্তু দান কর।
এই দুআ পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা বিগত ব্যক্তিত্ব অপেক্ষা উত্তম বিনিময় প্রদান করে থাকেন। উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, আমি শুনেছি আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন যে, কোনও মুসলিমের উপর যখন কোন বিপদ আসে এবং সে যদি আল্লাহর আদেশমত ইন্না লিল্লা-হি-----খাইরাম মিনহা’ বলে তাহলে আল্লাহ তার ঐ বিপদ অপেক্ষা উত্তম বিনিময় দান করেন।” উম্মে সালামাহ বলেন, অতঃপর যখন (আমার স্বামী) আবু সালামাহ মারা গেলেন তখন আমি বললাম, ‘মুসলিমদের মধ্যে আর কে এমন ব্যক্তি আছে যে (আমার নিকট) আবু সালামার চেয়ে ভালো হবে? যার পরিবার ছিল আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর প্রতি প্রথম হিজরতকারী পরিবার। আমি (মনে মনে) এরূপ বারবার বলতাম। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রসূল (ﷺ)-কে বিনিময় স্বরূপ আমাকে দান করলেন। তিনি হাত্বেব বিন আবী বালতাআহকে আমার নিকট বিবাহের পয়গাম দিয়ে পাঠালেন। আমি বললাম, আমার একটি মেয়ে আছে, আর আমি বড় (সপত্নীর বিষয়ে) ঈর্ষাবতী। কিন্তু তিনি বললেন, 'আমরা তার মেয়ের জন্য দুআ করব, যাতে আল্লাহ তার নিকট থেকে মায়ের প্রয়োজন দূর করে দেন এবং আরো দুআ করব, যাতে তার (উম্মে সালামার) ঈর্ষা দুরীভূত হয়ে যায়।” (মুসলিম ১৫২৫ ক, আহমাদ ১৫৭৫১ ক, বাইহাকী ৪/৬৫)
বলা বাহুল্য, উম্মে সালামাহ উক্ত দুআর ফযীলতে উত্তম স্বামীরূপে আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে লাভ করেন।
মা-বাপ, ভাই বা ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে মহিলারা অলঙ্কার ও প্রসাধন বর্জন করতে পারে। আর এমন কাজ ধৈর্য ধারণের পরিপন্থী নয়। তবে এমনটি কেবল তিন দিন বৈধ; তার অধিক নয়। অবশ্য স্বামী মারা গেলে তার জন্য ৪ মাস ১০ দিন (এবং গর্ভ হলে প্রসবকাল পর্যন্ত) অলঙ্কার, সৌন্দর্য, সুগন্ধি ও প্রসাধনাদি বর্জন করে শোক পালন করা বিধেয়। (বুখারী)
যয়নাব বিন্তে আবী সালামাহ বলেন, আমি নবী (ﷺ) এর এক পত্নী উম্মে হাবীবার নিকট গেলে তিনি বললেন, আমি শুনেছি আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসিনী কোন কোন মহিলার জন্য কোন মূতের উপর তিন দিনের অধিক শোক পালন করা হালাল নয়। তবে মৃত স্বামী হলে তার উপর ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করবে।” (বুখার ১২০ ১ক মুসলিম ২ ৭৩০ ক প্রমুখ)
পক্ষান্তরে কোন নারী যদি তার স্বামীকে মিলন দিয়ে খুশী ও সন্তুষ্ট করার জন্য কারো মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করে তবে এটা তার জন্য অতি উত্তম। কারণ এরূপ করার পশ্চাতে প্রভূত কল্যাণের আশা করা যায়। যেমন, ঘটেছিল উম্মে সুলাইম রুমাইসা (বিবি রমিসা) ও তাঁর স্বামী আবু তালহা (রাঃ)-এর সাংসারিক জীবনে।
তাঁদের একমাত্র সন্তান ব্যাধিগ্রস্ত ছিল। আবু তালহা এক সময় নবী (ﷺ) এর নিকট গেলেন। এদিকে বাড়িতে তাঁর ছেলে মারা গেল। উম্মে সুলাইম সকলকে নিষেধ করলেন, যাতে আবু তালহার নিকট খবর না যায়। তিনি ছেলেটিকে ঘরের এক কোণে ঢেকে রেখে দিলেন। অতঃপর স্বামী আবু তালহা রসূল (ﷺ) এর নিকট থেকে বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার বেটা কেমন আছে?” রুমাইসা বললেন, 'যখন থেকে ও পীড়িত তখন থেকে যে কষ্ট পাচ্ছিল তার চেয়ে এখন খুব শান্ত। আর আশা করি সে আরাম লাভ করেছে!
অতঃপর পতিপ্রাণা স্ত্রী স্বামী এবং তাঁর সাথে আগত আরো অন্যান্য মেহমানদের জন্য রাত্রের খাবার পেশ করলেন। সকলে খেয়ে উঠে গেল। আবু তালহা উঠে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। (স্ত্রীর কথায় ভাবলেন, ছেলে আরাম পেয়ে ঘুমাচ্ছে।) ওদিকে পতিব্রতা রুমাইসা সব কাজ সেরে উত্তমরূমে সাজ-সজ্জা করলেন, সুগন্ধি মাখলেন। অতঃপর স্বামীর বিছানায় এলেন। স্বামী স্ত্রীর নিকট থেকে সৌন্দর্য, সৌরভ এবং নির্জনতা পেলে উভয়ের মধ্যে যা ঘটে তা তাদের মাঝে (মিলন) ঘটল। তারপর রাত্রির শেষ দিকে রুমাইসা স্বামীকে বললেন, হে আবু তালহা! যদি কেউ কাউকে কোন জিনিস ধার স্বরূপ ব্যবহার। করতে দেয়, অতঃপর সেই জিনিসের মালিক যদি তা ফেরৎ নেয় তবে ব্যবহারকারীর কি বাধা দেওয়া বা কিছু বলার থাকতে পারে?’ আবু তালহা বললেন, 'অবশ্যই না। স্ত্রী বললেন, তাহলে শুনুন, আল্লাহ আযযা অজাল্ল আপনাকে যে ছেলে ধার দিয়েছিলেন তা ফেরৎ নিয়েছেন। অতএব আপনি ধৈর্য ধরে নেকীর আশা করুন!
এ কথায় স্বামী রেগে উঠলেন; বললেন, 'এতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না বলে চুপ থেকে, এত কিছু হওয়ার পর তুমি আমাকে আমার ছেলে মরার খবর দিচ্ছ?!” অতঃপর তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি----’ পড়লেন ও আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর নিকট ঘটনা খুলে বললে তিনি তাঁকে বললেন, “তোমাদের উভয়ের ঐ গত রাত্রে আল্লাহ বরকত দান করুন।” সুতরাং ঐ রাত্রের রুমাইসা তার গর্ভে আবার একটি সন্তান ধারণ করে। (ত্বায়ালিসী ২০৫৬ বাইহাকী ৪/৬৫-৬৬, ইবনে হিব্বান ৭২৫, আহমাদ ৩ ১০৫-১০৬ প্রভৃতি। দেখুন আহকামুল জানায়েয ২৪-২৬ পৃঃ)।