লগইন করুন
ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল (রঃ) বলেনঃ আমাদের কাছে মুহাম্মাদ বিন জাফর হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেন আওন হতে, আর আওন বর্ণনা করেছেন হাইয়্যান বিন আলা হতে, হাইয়্যান বলেনঃ কাতান বিন কাবীসা আমাদের কাছে তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছেন,
«الْعِيَافَةُ وَالطِّيَرَةُ وَالطَّرْقُ مِنَ الْجِبْتِ قال عوف: العيافة: زجر الطير والطرق: الخطّ يخطّ بالأرض، والجبت قال الحسن: رنّة الشيطان. إسناد جيد ولأبي داود والنسائي وابن حبان في صحيحه المسند منه)
‘‘নিশ্চয়ই ‘ইয়াফা’, ‘তারক’ এবং ‘তিয়ারাহ’ হচ্ছে ‘জিবত’এর অন্তর্ভূক্ত। আউফ বলেছেন, ‘ইয়াফা’ হচ্ছে পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা। ‘তারক’ হচ্ছে মাটিতে রেখা টেনে ভাগ্য গণনা করা। হাসান বসরী বলেছেন, ‘জিবত’ হচ্ছে শয়তানের চিৎকার। এ বর্ণনার সনদ ভাল’’।[1] আবু দাউদ, নাসাঈ এবং ইবনে হিববান তাঁর কিতাব ‘সহীহ’তে এ হাদীছের শুধু মারফু অংশটুকু বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ তারা আওফের উক্তি বাদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।
ব্যাখ্যাঃ আহমাদ বিন হাম্বাল হলেন আবু আব্দুল্লাহ ইমাম আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল (রঃ)। মুহাম্মাদ বিন জাফর গুনদার নামে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন আল-হুযালী আল-বসরী এবং একজন ছিকাহ রাবী হিসাবে প্রসিদ্ধ। ২০৬ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আওফের পরিচয় হচ্ছে, তিনি হলেন আওফ ইবনে আবু জামীলাহ। তিনি হলেন আবাদী আলবসরী। আওফ আল আরাবী হিসাবে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনিও ছিকাহ রাবী ছিলেন। ৪৬ বা ৪৭ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। হাইয়্যান বিন আলাকে আবুল আলা হাইয়্যান বিন মুখারিকও বলা হয়। রাবী হিসাবে তিনি মাকবুল ছিলেন। অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য। ‘কাতান’ হচ্ছেন আবু সাহলা আলবসরী। তিনি সাদুক রাবী ছিলেন।
কাতান বর্ণনা করেন তার পিতা থেকেঃ কাতানের পিতার নাম আবু আব্দুল্লাহ কাবীসা আল হিলালী। তিনি ছিলেন একজন সাহাবী। বসরায় গমণ করে সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
الْعِيَافَةُ وَالطَّرْقُ وَالطِّيَرَةُ مِنَ الْجِبْتِ ‘‘নিশ্চয়ই ‘ইয়াফা’, ‘তারক’ এবং ‘তিয়ারাহ’ হচ্ছে ‘জিবত’এর অন্তর্ভূক্ত। আউফ বলেছেন, ইয়াফা হচ্ছে পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা’’ঃ অর্থাৎ পাখির নামসমূহ, পাখির আওয়াজ এবং পাখীদের চলাচলের পথের মাধ্যমে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করাকে عيافة বলা হয়। এটি ছিল প্রাচীন আরবদের অন্যতম একটি খারাপ অভ্যাস। তাদের কবিতাসমূহে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। পাখীকে তার স্থান থেকে তাড়িয়ে যখন ভালো বা মন্দের ধারণা করা হয়, তখন বলা হয়, عاف يعيف عيافة।
الطرق: الخط يخط بالأرض ‘তারক’ হচ্ছে মাটিতে রেখা টেনে ভাগ্য গণনা করাঃ আওফ এভাবেই ‘তারক’এর ব্যাখ্যা করেছেন। এটিই ‘তারক’-এর সঠিক ব্যাখ্যা। আবুস্ সাআদাত বলেনঃ উহা হচ্ছে ভাগ্য নির্ধারণের জন্য যমীনে পাথর নিক্ষেপ করা। মহিলারা এমন করে থাকে।
الجبت ‘জিবত’ঃ এখানে জিব্ত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যাদু।
হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃالجبت হচ্ছে শয়তানের চিৎকারঃ ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ বলেনঃ বাকী বিন মিখলাদের তাফসীরে এসেছে, ইবলীস চারবার চিৎকার করেছিল। তার উপর যখন লা’নত বর্ষণ করা হয়েছিল, তখন সে একবার চিৎকার করেছিল। যখন তাকে জান্নাত থেকে বহিস্কার করে যমীনে পাঠানো হয়েছিল সেদিন দ্বিতীয়বার চিৎকার করেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেদিন জন্মগ্রহণ করেছেন, সেদিন আরেকবার চিৎকার করেছিল। আর যেদিন সূরা ফাতিহা নাযিল হয়েছিল, সেদিনও শয়তান চিৎকার করেছিল। হাফেয যিয়াউদ্দীন মাকদেসী স্বীয় কিতাব ‘মুখতারাত’-এ এ ঘটনা বর্ণনা করছেন। الرنة বা الرنين অর্থ হচ্ছে আওয়াজ করা, চিৎকার করা। বলা হয়ঃرن يرن رنينا অর্থাৎ সে আওয়াজ করল। এ বিশ্লেষণ হাসান বসরীর কথাকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।
আবু দাউদ, নাসাঈ এবং ইবনে হিববান তাঁর কিতাব ‘সহীহ’তে উক্ত হাদীছের শুধু মারফু অংশটুকু বর্ণনা করেছেনঃ অর্থাৎ তারা আওফ এবং হাসান বসরীর উক্তি বাদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«مَنِ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِنَ النُّجُومِ اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ»
‘‘যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যার কিছু অংশ শিখল, সে যাদু বিদ্যারই একটি শাখার বিদ্যা অর্জন করলো। জ্যোতির্বিদ্যা যে যত বেশী শিখলো, সে যাদুও তত বেশী শিখলো’’।[2] ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদ সহীহ।
ব্যাখ্যাঃ ইমাম নববী এবং ইমাম যাহাবী এ হাদীছকে সহীহ বলেছেন। ইবনে মাজাহ এবং মুসনাদে আহমাদেও হাদীছটি রয়েছে।
اقتبس অর্থ হচ্ছে অর্জন করল। আবুস সাআদাত বলেনঃ قبست العلم واقتبسته ‘‘আমি ইলম অর্জন করেছি’’। মোট কথা হাদীছে বর্ণিত اقتبس অর্থ অর্জন করা, শিক্ষা করা ইত্যাদি।
شعبة শাখাঃ অর্থাৎ ইলমে নুজুম জ্যোতির্বিদ্যার একটি শাখা বা অংশ। যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যার একটি শাখা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান অর্জন করল, সে যাদুর একটি শাখা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করল। হাদীছে এসেছে, الحياء شعبة من الإيمان ‘লজ্জা ঈমানের অংশ’।
যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যার একটি শাখার জ্ঞান অর্জন করল, সে যাদুর একটি শাখা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করলঃ অর্থাৎ সে এমন এক শিক্ষা অর্জন করল, যা শিক্ষা করা হারাম। শাইখুল ইসলাম বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ইলমুন নুজুম তথা জ্যোতির্বিদ্যা যাদুর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা সূরা তোহার ৬৯ নং আয়াতে বলেনঃ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَى ‘‘যাদুকর যেখানেই আসুক, সফল হবেনা’’।
زَادَ مَا زَادَ যে যত বেশী ইলমে নুজুম শিখলো, সে তত বেশী যাদু বিদ্যা শিখলোঃ সুতরাং বেশী পরিমাণ ইলমে নুজুম শিক্ষা করা বেশী পরিমাণ যাদু শিক্ষা করারই নামান্তর। বেশী পরিমাণ জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষার পাশাপাশি ‘গুনাহ’র পরিমাণও বাড়তে থাকে। যাদুর নিজস্ব প্রভাব থাকার কথা বিশ্বাস করা যেমন বাতিল, ঠিক তেমনি ইলমে নুজুমের নিজস্ব প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করাও বাতিল।
ইমাম নাসাঈ আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেনঃ
«مَنْ عَقَدَ عُقْدَةً ثُمَّ نَفَثَ فِيهَا فَقَدْ سَحَرَ وَمَنْ سَحَرَ فَقَدْ أَشْرَكَ وَمَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ»
‘‘যে ব্যক্তি গিরা লাগাল অতঃপর তাতে ফুঁ দিল সে যাদু করল। আর যে ব্যক্তি যাদু করল সে শির্ক করল। আর যে ব্যক্তি কোনো জিনিষ লটকায় তাকে ঐ জিনিষের দিকেই সোপর্দ করা হয়।
ব্যাখ্যাঃ লেখক এই হাদীছকে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন এবং নাসাঈর দিকে সম্বন্ধ করেছেন। ইমাম নাসাঈ হাদীছটি মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর ইবনুল মুফলিহ তাকে হাসান বলেছেন।
ইমাম নাসাঈ হলেন আবু আব্দুর রাহমান হাফেয আহমাদ বিন শুআইব বিন আলী বিন সিনান বিন বাহার বিন দীনার। আস্ সুনানুল কুবরা, আল-মুজতাবা এবং আরও অনেক কিতাব রচনা করেছেন। তিনি মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না, ইবনু বাশশার, কুতাইবা এবং আরও অনেক মুহাদ্দিছ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি ইলালুল হাদীছ বা হাদীছের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কিত বিদ্যায় অত্যান্ত পারদর্শী ছিলেন। আশি বছর বয়সে তিনি ৩০৩ হিজরী সালে মৃত্যু বরণ করেন।
مَنْ عَقَدَ عُقْدَةً ثُمَّ نَفَثَ فِيهَا فَقَدْ سَحَرَ যে ব্যক্তি গিরা লাগাল অতঃপর তাতে ফুঁ দিল সে যাদু করলঃ আল্লাহ তাআলা সূরা ফালাকের ৪ নং আয়াতে বলেনঃ وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ ‘‘আমি আশ্রয় চাচ্ছি গিরায় ফুঁ দানকারিনীদের অনিষ্ট থেকে’’। অর্থাৎ ঐ সমস্ত যাদুকর মহিলাদের অনিষ্ট হতে, যারা যাদুর মন্ত্র পাঠ করে সুতা বা চুল দিয়ে গিরা লাগায়। النفث অর্থ হচ্ছে মুখে থুথু থাকা অবস্থায় পাঠ করা। অতঃপর ফুঁ দেয়া। কিন্তু উহা থুথু নিক্ষেপের মত নয়।
যে ব্যক্তি কোনো জিনিষের উপর ভরসা করবে, তাকে সেই বস্ত্তর উপরই সোপর্দ করা হবেঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার অন্তরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো বস্ত্তর সাথে বেঁধে দিবে, তার কাছে কল্যাণের আশা করবে এবং তাকে ভয় করবে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে ঐ বস্ত্তর দিকেই সোপর্দ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হবেন এবং তিনি তাকে সমস্ত অকল্যাণ হতে বাঁচাবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।’’ (সূরা তালাকঃ ৩) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।’’ (সূরা মায়িদাঃ ২৩) সুতরাং কল্যাণ অর্জনের নিয়তে কিংবা অকল্যাণ দূর করার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে সম্পর্ক কায়েম করল, সে বিনা সন্দেহে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করল।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ«أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ هِىَ النَّمِيمَةُ الْقَالَةُ بَيْنَ النَّاسِ» ‘‘আমি কি তোমাদেরকে বলবনা, عضه (আয্হ) কাকে বলে? উহা হচ্ছে চোগলখোরী বা কুৎসা রটনো। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে কথা-লাগানো বা বদনাম ছড়ানো’’।[3]
ব্যাখ্যাঃ العضه- ‘আয্হ’-এর ব্যাখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, উহা হচ্ছে চোগলখোরী করা। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি, প্রিয়জনদের মধ্যে শক্রতা ও বিচ্ছেদ সৃষ্টির জন্য একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগানো। চোগলখোরের কাজকে আয্হ বা যাদু বলার কারণ হল সে যাদুকরের কাজই করে থাকে।
ইমাম ইবনু আব্দিল বার্ ইয়াহইয়া বিন আবু কাছীর (রঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ চোগলখোর এবং মিথ্যুক এক ঘন্টায় যে ক্ষতি করে, যাদুকর তা এক বছরে করতে পারেনা। ইমাম আবুল খাত্তাব স্বীয় কিতাব ‘উয়ুনুল মাসায়েলে’ বলেনঃ চোগলখোরী করা এবং লোকদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ ছড়ানোও এক প্রকার যাদু।
ইমাম ইবনে হাযম (রঃ) বলেনঃ গীবত ও চোগলখোরী হারাম হওয়ার উপর আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তবে যেখানে নসীহত করা আবশ্যক, সেখানে নসীহত করার জন্য গীবত করা বৈধ[4]। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, চোখলখোরী ও গীবত উভয়টিই কবীরা গুনাহ।
القالة بين الناس লোকদের মধ্যে ক্ষতিকর ও ফাসাদের কথা ছড়ানোঃ হাদীছে এসেছে,ففشت القالة بين الناس অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ফিতনা ও ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ল।
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ » «إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا‘‘নিশ্চয়ই কোনো কোনো কথার মধ্যেও যাদু রয়েছে’’। ইমাম মুসলিম এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ব্যাখ্যাঃ এখানে বয়ান দ্বারা ফাসাহাত ও বালাগাত দ্বারা অধিকতর বিশুদ্ধ ও উচ্চাঙ্গের ভাষা সমৃদ্ধ বক্তৃতা উদ্দেশ্য।
ইমাম ইবনে আব্দিল বার্ বলেনঃ একদল আলেম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদীছের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, এখানে বয়ান বা বক্তৃতার ভাষার মধ্যে ফাসাহাত ও বালাগাত ব্যবহার করাকে অপছন্দ করা হয়েছে। কেননা যাদু নিন্দনীয়। সুতরাং যাকে নিন্দনীয় বস্ত্তর সাথে তুলনা করা হয়েছে, তাও নিন্দনীয়।
তবে অধিকাংশ আলেম ও সাহিত্যিকদের মতে হাদীছে বয়ানের মধ্যে ফাসাহাত ও বালাগাত ব্যবহার করা প্রশংসনীয়। কারণ আল্লাহ তাআলা সুন্দর বর্ণনা ও বয়ানের প্রশংসা করেছেন।
লেখক বলেনঃ এক ব্যক্তি উমার ইবনে আব্দুল আযীযের নিকট সুন্দর ভাষায় তার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করল। উমার ইবনে আব্দুল আযীয লোকটির কথাকে খুব পছন্দ করলেন এবং বললেনঃ আল্লাহর শপথ! এটি হচ্ছে হালাল যাদু।
তবে প্রথম মতটিই অধিক বিশুদ্ধ। অর্থাৎ কথার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ফাসাহাত ব্যবহার করা অপছন্দনীয়। যাতে শ্রোতাকে ধোঁকা দেয়া বক্তার উদ্দেশ্য হয় এবং তাকে সংশয় ও সন্দেহে ফেলা হয়। কোনো কোনো কবি বলেছেনঃ
في زخرف القول تزيين لباطله + والحق قد يعتريه سوء تعبير
চমকপ্রদ বর্ণনা বাতিলকে খুব সুন্দর রূপে প্রকাশ করে + ভালভাবে উপস্থাপন না করার কারণে সত্যের সাথে কখনও বদনাম যুক্ত হয়। মূলত এ কবি অন্য এক কবির কবিতার দু’টি লাইনের সারমর্ম বর্ণনা করতে গিয়ে উপরোক্ত লাইনটি আবৃত্তি করেছেন। সেই কবি বলেনঃ
تقول هذا مجاج النحل تمدحه + وإن تشأ قلت ذا قيء الزّنانير
مدحاً وذماً وما جاوزت وصفهما + والحق قد يعتريه سوء تعبير
মধুর প্রশংসা করতে গিয়ে তুমি বলতে পার যে, এটি হচ্ছে মৌমাছির মধু। আর যদি মধুর বদনাম করতে চাও, তাহলে বলতে পার, এটি তো ভিমরুলের বমি ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রশংসা করো কিংবা বদনাম করো আসলে তুমি মধুর গুণাগুণ বর্ণনায় সীমা অতিক্রম করোনি। ভাল বয়ানের অভাবে অনেক সময় সত্যও বদনামযুক্ত হয়।
إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا নিশ্চয়ই কোনো কোনো কথার মধ্যেও যাদু রয়েছেঃ এ বাক্যটি تشبيه بليغ তথা উচ্চাঙ্গের সাদৃশ্যের অন্তর্ভূক্ত। কেননা উচ্চাঙ্গের বর্ণনা যাদুর কাজই করে থাকে। যাদুময় ও চমকপ্রদ বক্তৃতা সত্যকে বাতিলের পোষাক পরিয়ে দেয় আর বাতিলকে হকের জামা পরিয়ে দেয়। এর দ্বারা তারা জাহেলদের অন্তরসমূহকে আকৃষ্ট করে থাকে। ফলে তারা বাতিলকে কবুল করে এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু যেই বয়ান সত্যকে সুস্পষ্ট করে ও সাব্যস্ত করে এবং বাতিলের প্রতিবাদ করে ও মুখোশ উম্মোচন করে সেটি খুবই প্রশংসনীয়। রাসূলগণ ও তাদের অনুসারীদের অবস্থা এ রকমই ছিল। এ জন্যই আল্লাহ তাআলার নিকট তাদের সুউচ্চ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের নেকীসমূহও বিশাল হয়েছে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) ‘ইয়াফা’, ‘তারক’ এবং ‘তিয়ারাহ’ জিবতের অন্তর্ভূক্ত।
২) ‘ইয়াফা’, ‘তারক’, এবং ‘তিয়ারাহ’এর তাফসীর জানা গেল।
৩) জ্যোতির্বিদ্যা যাদুর অন্যতম প্রকার।
৪) ‘ফুঁ’সহ গিরা লাগানোও যাদুর অন্তর্ভুক্ত।
৫) চোগলখোরী করাও যাদুর মধ্যে শামিল।
৬) কিছু কিছু বক্তৃতাও যাদুর অন্তর্ভূক্ত।
[2] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ জ্যোতির্বিদ্যা। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৩০৫১।
[3] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ চোগলখোরী হারাম।
[4] - অর্থাৎ কারো কল্যাণ কামনার্থে এবং দ্বীনের সঠিক মাসআলা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে বিদআতী ও খারাপ লোকদের থেকে মানুষকে সতর্ক করা আবশ্যক। এটিকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে গীবত মনে হলেও মূলত এটি গীবত নয়। এটি হচ্ছে নসীহত তথা সদুপোদেশের অন্তর্ভুক্ত।